শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
আলেকজান্ডার বøক

আরক্ত সূযাের্স্তর আলোয় হেঁটে আসা কবি

ঊনিশ শতকের রোমান্টিক কবি ভেসিলি জুকোভস্কি ও আলেকজান্ডার পুসকিনের কবিতা পড়ে বøক তীব্রভাবে আলোড়িত হন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভাসেসর্ এবাউট বিউটিফুল লেডি’ ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি এ কাব্যগ্রন্থে বাস্তবতার সঙ্গে আদশির্ক রহস্যময় চিত্র সংযুক্ত করেন। ফলে গ্রন্থটির প্রকাশের পর তিনি প্রতীকাশ্রয়ী ঘরানার কবি হিসেবে সমাজের কাছে খুব শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন। তিনি তখন ভ্রাদিমির সলোভেবের দশর্ন এবং রহস্যময় কবিতা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ১৯০৬ সালের মধ্যেই আলেকজান্ডার বøক সাহিত্যসমাজে কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
সালাহ উদ্দীন
  ২৯ জুন ২০১৮, ০০:০০

বিশ্ববরেণ্য কবি আলেকজান্ডার বøকের জন্ম রাশিয়ার সেন্ট পিটাসর্বাগর্ শহরে, ১৮৮০ সালের ১৬ নভেম্বর। তার পিতা আইনজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ ও লেখক ছিলেন। বøকের জন্মের কিছুদিন পর তার পিতা-মাতা আলাদা হয়ে যান। তার মা ছিলেন অভিজাত ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারের মেয়ে। বøক পরে তার মায়ের পরিবারে সাংস্কৃতিক আবহে বড় হন। এই আবহই পরে তার প্রতিভা বিকাশের পথকে সুগম করে। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি লেখালেখির চচার্ শুরু করেন। অবাক করা বিষয়, মাত্র পঁাচ বছর বয়সেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। যদিও সেটা ছিল শৈশব সময়। কিন্তু তিনি সত্যিকার অথের্ সাহিত্যে পরিপক্ব হয়েছিলেন আঠার বছর বয়স থেকে। এ কথা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন। বøক তার আত্মজীবনী লিখেছেন, আঠার বছর বয়স থেকে আমার লেখায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। তিনি তখন সেন্ট পিটাসর্বাগর্ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। পরে বøক ভাষাতত্ত¡ এবং প্রতীকবাদ সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা করেন। এ বিষয়টি তার সাহিত্যজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ১৯০৩ সালে তিনি অভিনেত্রীকন্যা লাইউবভকে বিয়ে করেন। লেখালেখির প্রথমদিকে স্ত্রী লাইউবভ ছিলেন বøকের অনুপ্রেরণার উৎস। যদিও শেষ পযর্ন্ত পারিবারিকভাবে তারা সুখী ছিলেন না। তারা তাদের সম্পকর্ নিয়ে হঁাপিয়ে উঠেছিলেন। একপযাের্য় তারা আলাদা আলাদা থাকতেন এবং তাদের মধ্যে কদাচিৎ সাক্ষাৎ হতো।

ঊনিশ শতকের রোমান্টিক কবি ভেসিলি জুকোভস্কি ও আলেকজান্ডার পুসকিনের কবিতা পড়ে বøক তীব্রভাবে আলোড়িত হন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভাসেসর্ এবাউট বিউটিফুল লেডি’ ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি এ কাব্যগ্রন্থে বাস্তবতার সঙ্গে আদশির্ক রহস্যময় চিত্র সংযুক্ত করেন। ফলে গ্রন্থটির প্রকাশের পর তিনি প্রতীকাশ্রয়ী ঘরানার কবি হিসেবে সমাজের কাছে খুব শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন। তিনি তখন ভ্রাদিমির সলোভেবের দশর্ন এবং রহস্যময় কবিতা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ১৯০৬ সালের মধ্যেই আলেকজান্ডার বøক সাহিত্যসমাজে কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

বøকের প্রথম দিকের কবিতাগুলো ছিল সংগীতধমীর্। কিন্তু পরে তিনি তার লেখায় সাহসিকতার সঙ্গে বিষম মাত্রিক ছন্দ প্রবতর্ন করেন। তার মধ্যে সহজাত ছন্দোবদ্ধ কবিত্ববোধ ছিল। তিনি ‘ফেবারিকা’ গ্রন্থে গতানুগতিক পরলৌকিক চিত্রের পারিপাশ্বির্ক বিশ্বাস, তুচ্ছ ঘটনার বলয়মুক্ত হয়ে অবিস্মরণীয় আবহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তার পরিপক্ব কবিতাগুলো প্লেটোনীয় আদশর্, নন্দনতত্ত¡ এবং হতাশাদায়ক ও দুদশার্গ্রস্ত শিল্পপ্রধান সমাজব্যবস্থার সঙ্গে দ্ব›দ্ব পোষণ করে। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত ‘লিটল ম্যাচ’ কাব্যগ্রন্থটি এ সত্য বহন করে। অন্যদিকে তিনি ‘দি সিটি’ (১৯০৪-১৯০৮) গ্রন্থে প্রতিচ্ছায়াবাদ ও অতিপ্রাকৃত ঘটনার ওপর নিজস্ব বিশ্লেষণ সংকলিত করেছেন। ‘ফেমিন অ্যান্ড দি মাস্ক অব স্নো’ গ্রন্থটি প্রকাশের পর বøক আন্তজাির্তক সাহিত্যাঙ্গনে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন হন। তাকে প্রায়ই আলেকজান্ডার পুসকিনের সঙ্গে তুলনা করা হতো। সমালোচকরা তাকে রুশ সাহিত্যের সিলভার যুগের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ১৯১০ সালের দিকে আলেকজান্ডার বøক সাহিত্যবোদ্ধাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন। নবীন লেখকদের অনেকেই তার সাহিত্যকমর্ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আনা আখমাতোভা, মারিনা তেজভেতাইবা, বরিস পাস্টারনেক, বøাদিমির নবকভের মতো লেখকরা আলেকজান্ডার বøককে শ্রদ্ধা এবং সমথর্ন জানিয়ে অতুলনীয় কবিতা লিখেছিলেন।

বøক রাজনীতি সচেতন ছিলেন। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত ‘দি টুয়েলভ’ কাব্যগ্রন্থে রুশবিপ্লব নিয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। গ্রন্থের দীঘর্ কবিতায় প্রদশির্ত হয়েছে উত্থান-পতনের বহুমাত্রিক ঝঁাঝালো শব্দ ও অপভাষা। ওই গ্রন্থের বণর্না অনুসারে পেট্রোগাডের্র (সেন্ট পিটাসর্বাগর্) রাস্তায় বারোজন (যার প্রতীকী অথর্ : যিশু খ্রিস্টের মনোনীত বারো অনুসারীর মতো) বিপ্লবী বলশেভিক সৈন্যদের কুচকাওয়াজের সময় প্রচÐ শীত এবং প্রবল তুষার ঝড় তাদের চারদিকে প্রচÐ ক্রোধে গজর্ন করছিল। বøক তার বণর্নায় বিদ্রোহকে অতীন্দ্রিয় প্রতীকরূপে প্রকাশ করেছেন এভাবে : ‘কালো রাত, শুভ্র বরফ/সারাবিশ্বে হচ্ছে স্রষ্টার আবতর্/ তোমায় আমি দেব না যেতে/হে বাতাস, হে বাতাস / শুভ্র বরফে বাতাস করছে কারুকাজ / নিচ থেকে দিচ্ছে উঁকি প্রিয় বরফ/ আছড়ে পড়েছে লোকজন/ সবাইকে কর করুণা, হে ঈশ্বর (এখানে যিশু খ্রিস্টকে বোঝানো হয়েছে)। আরেক কবিতায় তিনি আশা ও হতাশায় আন্দোলিত হয়ে লিখেছেন, ‘আমি মহান কিছু হারিয়ে আতঙ্কিত হই/এখন দ্বিধাহীনভাবে/সন্ধ্যার আলোছায়া নেমে যায় ঘন কুয়াশায়/অতিক্রান্ত দিনের কথা মনে পড়ে যায় পুনরায়।’ কবি প্রতীকীরূপে অন্য এক কবিতায় আশাবাদ ব্যক্ত করে লিখেছেন : ‘আমার আত্মা থাকবে জেগে/সূযোর্দয়ের গানের জন্যে/আমি আমার স্বপ্নের খুব কাছাকাছি/আরক্ত সূযাের্স্তর আলোয় / শিশির বিন্দুর ওপর আমি হেঁটেছি।’

তৎকালীন ক্ষমতাসীন বলশেভিক দল যখন তার পূবের্কার অতীন্দ্রিয়বাদ এবং তপস্যাব্রতকে প্রত্যাখ্যান করল তখন ‘দি টুয়েলভ’ গ্রন্থটি আলেকজান্ডার বøককে তৎকালিন রুশবিপ্লব সমথর্নকারী শিল্পীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। তাদের অভিযোগ ছিল বইটিতে শিল্পকমের্র অনেক বিচ্যুতি রয়েছে। ভিক্টর সেখোলভস্কি নামে একজন সংস্কৃতি পরিষদের সভ্য উল্লেখ করেছেন, ওই দীঘর্ কবিতাটি অপরাধীর ভাষায় বিদ্রƒপাত্মক ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে। কিন্তু বøক তার এই গ্রন্থটিকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করতেন। আধুনিক ভাষার ‘নতুন চিত্র’ মতে বøক অপ্রচলিত প্রথা এবং তথ্য থেকে তার প্রতীকবাদী কবিতা সৃষ্টি করেছেন। তিনি বিখ্যাত গায়ক মিখাইল সাবোইয়ারভ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। বøক তার কনসাটের্ ১৯১৫-১৯২০ সাল পযর্ন্ত যাতায়াত করতেন।

বøক তার রচিত কাব্যকে তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। তার লেখা প্রথমভাগের কবিতাগুলো ছিল কোনো এক আদশর্ প্রেমিকা সম্পকের্। দ্বিতীয় ভাগে বণির্ত ছিল অসম্ভাব্য আদশর্ অজের্নর কথা। যার জন্য তার আকাক্সক্ষা ছিল। তৃতীয় ভাগের বক্তব্য ছিল রুশ বিপ্লবকালের কবিতার বৈশিষ্ট্য। যা ছিল অধিক জীবন্ত। বøকের কবিতায় ‘রং’ ছিল খুব গুরুত্বপূণর্ বিষয়। কবি যখন তার কাক্সিক্ষত প্রেমিকাকে ভ্রান্তিজনক মনে করেন তখন তার কাছে নীল এবং বেগুনি রংকে মনে হয় হতাশার রং। রাস্তার হলুদ রঙের বাতি, জানালা এবং সূযাের্স্তর আলো হলো বিশ্বাসঘাতকতা এবং তুচ্ছ বিষয়ের রং। কালো রং ভয়ঙ্কর এবং মারাত্মক কিন্তু রহস্যপ্রকাশে সম্ভাব্য সক্ষম। এভাবে বøক তার কাব্যে প্রতীককে একটা জটিল পদ্ধতি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তার প্রথম দিকের কবিতায় বাতাসকে বোঝানো হয়েছে প্রেমিকার প্রস্তাব উপস্থাপনকে। অন্যদিকে ‘সকাল এবং বসন্তকালকে’ খুব সম্ভবত প্রেমিকার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। কবি এবং তার প্রেমিকা যখন পরস্পর থেকে দূরে থাকেন তখন অশুভ সময় হিসেবে শীত এবং রাত্রিকে বোঝানো হয়েছে। আধ্যাত্মিক আলো থেকে বঞ্চিত প্রতিদিনের জীবনকে বোঝাতে কাদায় নিমগ্নতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কবির ছিল রহস্য উদ্ঘাটনের অনিশ্চিত আকাক্সক্ষা। তিনি প্রায়ই আশা ও হতাশায় আন্দোলিত হতেন। ১৯১৭ সালে তিনি তার ডায়েরিতে লেখেন, ‘আমার মনে হয় বড় কোনো কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কি তা আমি উদ্ঘাটন করতে পারছি না।’ বøক তার কবি বন্ধু এবং প্রশংসাকারীদের হতবাক করে দিয়ে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবকে প্রবল আগ্রহের সঙ্গে সমথর্ন করেছিলেন। তার কবি বন্ধু ও প্রশংসাকারীরা এতে আশ্চযর্ হয়েছিল। তিনি এই বিপ্লবকে ‘বিশোধক শক্তির বিস্ফোরণ’, পরিপক্ব সৃজনশীলতা ও রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য আকুল আকাক্সক্ষা হিসেবে দেখেছেন।

১৯২১ সালে রুশ বিপ্লব সম্পকের্ বøকের মোহমুক্তি ঘটে। এরপর তিন বছর তিনি কোনো কবিতা লেখেননি। তিনি প্রখ্যাত লেখক ম্যাক্সিম গোকির্র কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, ‘মানবতার জ্ঞানের প্রতি তার বিশ্বাস শেষ হয়ে গেছে।’ তিনি তার বন্ধু ক্রোনি চুকোভস্কিকে বলেছেন, তিনি আর লিখতে পারছেন না। এর অল্প কিছুদিন পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ডাক্তার তাকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার জন্য পরামশর্ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। অবশেষে ম্যাক্সিম গোকির্ তাকে ভিসা দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। ১৯২১ সালের ২৯ মে তিনি আনাতলি লুনাসাকর্সকে লিখেছেন : ‘বøক রাশিয়ার একজন চমৎকার কবি। তুমি যদি তাকে বাহিরে যাওয়ার অনুমতি না দাও এবং তিনি যদি মারা যান, তবে তুমি এবং তোমার কমরেডরা তার মৃত্যুর জন্য দোষী সাভ্যস্ত হবে।’ যার কারণে পরে বøককে ১৯২১ সালের ২৩ জুলাই দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ততদিনে বøক এতই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন যে, তাকে দেখাশোনার জন্য তার স্ত্রীকে ভিসা প্রদান করতে গোকির্ কতৃর্পক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন। অনেক জটিলতা পেরিয়ে শেষ পযর্ন্ত তাদের হাতে ভিসা এসে পেঁৗছে ১০ আগস্ট। কিন্তু তার আগেই ৭ আগস্ট আলেকজান্ডার বøক চিরনিদ্রায় শায়িত হন। আরক্ত সূযাের্স্তর আলোয় শিশির বিন্দুর ওপর হেঁটে আসা কবি বøক মাত্র ৪১ বছর বয়সে প্রয়াত হলেও বিশ্ববাসীর জন্য তিনি রেখে যান তার অমর কবিতা সম্ভার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে