বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

সালেহ্ বায়েজীদ

নেলপলিশ
  ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। আমার মা সাধারণত এ সময়টায় বাসায় থাকে না। কিন্তু আশ্চযের্র বিষয় হচ্ছে আজ মা গড়ানো বিকেলের বুকে পা রেখে বাসায় চলে এসেছে। ‘ফ্যানটা ছেড়ে দে রাফদি’ বলে মা ধুম করে সোফায় বসে। আমি ফ্যানটা ছেড়ে মার জন্য এক গøাস বিটের জুস নিয়ে আসি। ‘মা আজ যে তুমি এ বেলায় চলে এলে স্পা সেন্টার থেকে’

‘ভালো, লাগছিল না’

“কেন কী হয়েছে”

“না, কিছু না”

“একটা, ঘটনা ঘটে গিয়েছে”

আমার মা একটা স্পা সেন্টার দিয়েছে অনেক দিন হলো, স্পা সেন্টারের নাম “স্প্রিং স্পা’ এখানে শুধু মেয়ে, মহিলা অথবা মাঝবয়সি লোকজন আসে। তারা সবাই কেউ বডি ম্যাসেজ করতে, কেউ বা ফেসিয়াল করাতে, কেউ আসে ভ্রæ প্লাক করাতে অথবা কেউ আসে বউ সাজাতে। এরকম নানা কাজে শুধু আসে ওরা। মা কয়েকজন লোক রেখেছে ‘স্পিং স্পা’ সেন্টারের জন্য। কিন্তু উদ্যোগ গ্রহণের প্রথম দিককার কথা। আমি তখন সদ্য যৌবনে পা দিয়েছি। শামুকের খোলস ভেঙে কেবল নতুন করে পৃথিবী দেখার যুদ্ধ করছি। ঠিক তখন মার একজন খুব ভালো ওয়েল ওয়েসার। আমি আর মা একই রুমে তখন বাস করি। বারবার মনের মধ্যে আওড়ে যাচ্ছিল সেসব দিনের কথা। মা নিজেকে তখন কেবলই সূ² জালের মতো বিন্যাস করেছিল। সে সময় ছোট এক ফুটো দিয়ে ঢুকে যায় সেই মানুষটা। অথচ এ ফুটো দিয়ে ছোট ইঁদুরের ও ঢোকার কথা নয়। কিন্তু মানুষ কীভাবে ঢুকে গেল তা আমি বুঝিনি! সময় তার আপন আলোয় নিজে প্রতিচ্ছবি রপ্ত করছিল।

“কিরে, আজ বিটের জুসে এত বেশি লবণ হলো যে”

“আসলে কী কারণে যে লবণ বেশি পড়ে গেল বুঝতে পারিনি”

“লবণ, না অন্য কিছু দিয়েদিস”

“ও না, গোলমরিচ, না চিনি”

মার ‘স্প্রিং স্পা’ সেন্টার নারীদের সৌন্দযর্ চচার্য় এক জীবন্ত সরাইখানায় রূপান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু আসলে সেটা তা নয়। কেবল তা মৃত্যু অথবা বীজতন্ত্রের এক যুগসন্ধি। মা আর আমার সম্পকের্র সুতা এত দীঘর্ যে, তা পৃথিবীকে মুড়িয়ে শেষ করা যাবে না। অথবা সে সম্পকের্র সুতা কোনো সুইয়ে ফেঁাড়া হয়নি। মার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ ছিল, সে ঘটনার পর থেকে।

মা-ই কী করার ছিল এমনটার পেছনে। আমি রান্নাটা। ভালো করে রপ্ত করেছিলাম আমার নানুর কাছ থেকে। আমি প্রায়ই আমাদের দুজনের রান্না করে থাকি। ইদানীং আমি থাই রান্নার একটা কোসর্ করে এসেছি। মাকে স্কুইড, সিদ্ধ মাছ, এসব রান্না করে দিলে মা তা হঁাসের মতো খেয়ে ফেলে। কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথাতে কিছুতেই ঢুকে না। মা বিগত বাইশ বছর ধরে টানা ঘুমের ওষুধ সেবন করে ঘুমাতে যায় কেন?

আমি, আমার শৈশবের কঁাচা হলুদ সময় টুকু আমার নানুর বাড়িতে কাটিয়েছি। মা তখন আমার থেকে যোজন দূরত্বে এই ‘স্প্রিং স্পা’কে নিয়ে থাকত। আমার শৈশবের গায়ে সোনালি সূযের্র যে ছায়া সেখানে মা উপস্থিত ছিল না।

মা এখন গোসলে যাচ্ছে। একটু পর হয়তো বা বলবে ‘কই, তুই এদিকে আয়, আমার পিঠ মেজে দেয়’

এটা মার প্রতিদিনের অভ্যাস অধের্ক গোসল হওয়ার পর মা আমাকে বলবে পিঠ মেজে দেয়ার জন্য। আমার মা প্রচÐ সাজুগুজু করে। আর আমাকে প্রায়ই বলবে, “সব সময় ক্লিন সেভ করে থাকবি”

কারণ, থাইল্যান্ডের নাকি জাপানের লোকজন সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকে। মাকে সারাটা জীবন দেখেছি খুব পরিপাটি হয়ে ইস্ত্রি করা শাড়ি পরে থাকে। আমি ও মার কাছ থেকে এ ব্যাপারটা শিখে গিয়েছি। কারণ এতে নাকি তার মন ভালো থাকে আমার নানু প্রায়ই বলতো তোর মা প্রচÐ জেদি একটা মেয়ে ছিল। তার নাকি ছেলেদের দেখতে অসহ্য লাগত। তার একজন খুব ভালো বান্ধবী ছিল। এরপর নানু আমাকে আর মার খুব ভালো বান্ধবীর কথা বলেনি। অথচ “স্প্রিং স্পা” দেয়ার সময়টা থেকে মার অস্তিত্বে ছিল তার সেই পুরনো আখড়।

“কোথায়, ভালো করে মেজে দিবি, তা না তাড়াহুড়া করছিস”

“মা আজ আর পারব না, আমার কাজ আছে”।

“ কী এমন কাজ, আমার কাজ কি তোর কাজ মনে হয় না”

মা কথা বলেই যাচ্ছে। আশ্চযের্র বিষয় হচ্ছে মা এতো কিছুর পরও আমাকে প্রচÐ ভালোবাসে। কত রকম ভাবে আমি মাকে যন্ত্রণা দিয়েছি, অথচ মা যেন এসবের ঊধ্বের্।

স্পা সেন্টারটা দিনকে দিন তার ডানা প্রসারিত করছে। মার ব্যস্ততা ক্রমেই বাড়ছে। আর হাতে জাদু আছে, না হলে এমন সুন্দর করে বউ সাজায় কী করে। মা ঘুমাতে যায় প্রায় শেষ রাতে। পৃথিবীতে বহু মানুষ দেখেছি। কিন্তু আমার মার মতো এমন শক্ত মানুষ আমি কখনো দেখিনি, যেমন ব্যক্তিত্বে ও গাম্ভীযে। এমন কি নানুর মৃত্যুর সময় মার চোখে এক ফেঁাটা জল গড়ায় নি। ঠিক যেন পাথর। অথচ যে অতীত অনেক বছর পর আমি জেনেছি তার জন্য ভয় হয়।

মার চোখের দিকে তাকালে আমার আত্মার পানি শুকিয়ে যায়।

তিন নয় ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। বণর্নাটুকু কোনো এক অজানা কণ্ঠস্বরের...

সেদিন সন্ধ্যায় তোমার মার স্পা সেন্টারে এসেছি, সেই মানুষটাও এসেছে। দু’জনের অন্তরঙ্গটুকু যখন শেষ পযাের্য় তোমার মা তার বুকের উপর চেপে বসে। আর একটা ধারালো ছোরা দিয়ে তার বুকের ওপর এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করতে থাকে। দেহটা নিথর হয়ে যায়। গোলাপের পাপড়ির মতোন সে ঝরে যায়। তার পর শূন্য থেকে একটা আজানা আগুন এসে মানুষটাকে পুড়িয়ে দিয়ে যায়। “অথচ দেখ তোমার মা কত নিস্পৃহ”।

“কত সরলভাবে জটিল অংকটা কষে ফেলেছে”

এ ঘটনাটুকুর এখানেই পরিসমাপ্তি টানা যেত।

কিন্তু এ ঘটনার সাথে আমার জন্ম রহস্য লুকিয়ে ছিল কিনা আমি বলতে পারব না। পারব না এ জন্য কারণ আগুনের হল্কা এখনো মার চোখে আশ্চযর্ এক বিহŸলতা তৈরি করে।

“মা দেখ, আজ তোমার প্রিয় ডিশ পাথ-থাই” রান্না করছি।

“ভালো হয়েছে”

“শোন, আমাকে একটু ডেজাটর্ দেতো”

“মা, আজ ভেজাটর্ হিসেবে আছে লাউয়ের লাড্ডু”

“ভালো, শোন তোকে রিমকী যেতে বলেছে ওদের বাসায়”

“রিমকীটা যে কে? ও তোর রিমকী খালা”

“আচ্ছা যাব”

কিন্তু আমি কখনো মার বন্ধবীদের বাসায় যাই না। আমার শরীরের ওপর যেন জেঁাক বসেছে। এমন অবস্থা হয় মার বন্ধবীদের বাসায় যাওয়ার ফলে। হয়তো বা আমি ঘটনা জানি। স্প্রিং স্পা যে সমাজের কত মানুষের উপকার করছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। মা সাধারণ কোনো ঘটনার বিচারে যায় না। কেন এমনটা হলো। কেন ওটা হয়নি। মুখর সময়টা মা প্রায় নিঃস্তরঙ্গ ভাবে কাটিয়ে দেয়। এইতো সেদিন নিচ তলার এক লোকের বউ মারা গিয়েছে। আমরা সবাই গিয়েছি। মা যাননি। ব্যাপারগুলো প্রায়ই আমাকে খুব পীড়া দিত। আমি মাকে ভেতরে ভেতরে এখনো প্রচÐ ভয় পাই। সেই ঘটনা জানার পর থেকে যেন ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। কেবল মাকে প্রচÐ ভালোবাসি বলেই। ছেড়ে যেতি পারছি না। যাওয়া উচিত কি-না তাও জানি না। কেন জানি এতকিছু জানার পরও মার প্রতি ভালোবাসা যেন কমে না গিয়ে বরং বেড়েছে। ঘৃণার বদলে সেখানে জন্মেছে সোনালী ফুল। তবে কি আমার স্খলন হয়েছে। নাকি আকাশ থেকে চঁাদ খসে পড়বে মাথায় সে চিন্তায় কাতর। বলা যাচ্ছে না। মা আমাকে একটা সূত্র শিখিয়েছে কীভাবে সবকিছুর মধ্যে থেকেও কিছুতেই নেই সেই সূত্র আমার মুখস্ত। এটার জন্য ওটা হলো না তার জন্য করিনি পারিনিÑ মা এসব বলতে নারাজ। আমার মনে মনে সংশয় ছিল। কিন্তু পেঁয়াজের খোসার ভিতরে যে কখনো কালো কীট থাকে তা এ মহিলাকে দেখে আমি বুঝতে শিখেছি। দুঃখিত, মহিলা বলা ঠিক হয়নি, মাতো কেবল মা।

“মা কখন এলে”

“এইতো কেবল”

রাতে আমি আমার রুমের দরজা ভালো করে লক করে তারপর ঘুমাই। কারণ শত হোক একটা ভয় তো কাজ করেই। শত শত ভুলের ভিতর দিয়ে যখন জীবন অতিবাহিত হয়, তখন কেউ যখন জেনে যায় তার ঘরে গুঁইসাপ আছে। আর সে যে কোনো সময় ডিম খেয়ে ফেলতে পারে। আমার মা কী সেরকম কোনো কিছু। না আমি আর ভাবতে পারছি না। শিরা দপ দপ করছে।

মহিলাটা টের পায়নি। তাদের ধস্তাধস্তি দেখছে কেউ। অকস্মাৎ আমার মা সেই মানুষডার বুকে উঠে যায়। ঘটনাটুকু হয়ত বা সুন্দর কোনো আখ্যানে ঢাকা যেত কিন্তু আমি ঘটনাকে অন্যদিকে নালা কেটে দিয়েছি। যাতে তার প্রবাহ ভিন্ন দিকে যায়। তাহলে কি আমিও খুনি। না তা কেন হবে।

আমি একবার স্প্রিং স্পা সেন্টারে বডি ম্যাসেজ করিয়েছি এক চাকমা ছেলে করে দিয়েছে। ছেলেটা এত সুন্দর ম্যাসেজ করে। মনে হয় শরীরের ভিতর হাড়গোড় থেকে ক্লান্তি দূর করে দিয়েছে। তাই বুঝি স্পা সেন্টারের এতো সুনাম। মহিলাটা আমাকে বলেছিল তার পর থেকে নাকি আমার মা এমন বিকারহীন হয়েছে। আসলে মার শৈশবে নাকি তার এক দূর সম্পকের্র খালাতো বোন তাকে এমন করে তৈরি করে ছিল মার সাথে যে মানুষটার ধস্তাধস্তি হয় তার বৃদ্ধাআঙুলে নেইলপলিশ ছিল। আমি কখনো মোমের স্তর ভেদ করে স্নায়ুতে কামড় বসাতে পারিনি। যেটুকু হয়েছে কেবল নিজের আগ্রহের জোড়ে। তবে মা এমন কাÐ ঘটিয়ে কেবল বেঁচে আছে, তা নয়। দিব্যি সুখের পায়রা নিজের ভিতর পুড়ে শান্তিতে আছে। অথচ এই সমাজ বাস্তবতায় চোখে তা ধরা পড়েনি। পড়বেই বা কী করে। সমাজ নামক কাঠামাটি যে ভঙ্গুর হয়েছে নেইলপলিশের কাছে। আসলে মা কে আমার বড্ড রহস্যময় মানুষ মনে হয়। একদিকে মুখোশ উন্মোচিত এক নিমর্ম সত্য অন্য দিকে মার পবিত্র মুখ। আমাকে বেশ কঁাপিয়ে দেয়। অশ্বথ গাছের রস খেলে যেমন শরীরে তাপ হয়, ঠিক সে রকম তাপ হয় ভিতরে।

আজ আবার বহুদিন পর মার সাথে ডাইনিং টেবিলে বসেছি এক সাথে খাব বলে মা চুপচাপ। আমিও চুপচাপ। হঠাৎ নেইলপলিশটার কথা মনে পড়ছে। মাকে কি জিজ্ঞেস করব। তাছাড়া মা যদি চৌদ্দ শিকের ভিতর চলে যায়। তাহলে আমার কী হবে স্প্রিং স্পার কী হবে? এসব ভাবতে ভাবতে আমার ভিতরে চক্রাকারে একটা গরম শ্বাস উঠতে থাকে। আমি বেশ দ্বিধায় পড়ে যাই। মা আমাকে সেদিন একটা সুন্দর চাবির রিং উপহার দিয়েছে। আসলে নতুন গাড়ির চাবির রিং। স্পা সেন্টার যে মার মৃত্যু সরাইখানা অথবা আমার মা যে স্পা সেন্টারকে স্বগর্ বানিয়েছে, তা মার অভিব্যক্তিই বলে দেয়।

মানুষটার সারাটা শরীর রক্তে ভিজে যায়। মার দিকে সন্দেহের তীর কেউ ছুড়তে পারেনি। কারণ মা মানুষটাকে হরণ করে কোথায় যে রাখে, তা ঐ মহিলাটা বলতে পারবে। শুধু নেইলপলিশ ছিল বৃদ্ধাআঙ্গুলিতে। মারএ অভ্যাস অথবা চাহিদা যাই বলি না কেন। এটা সৃষ্টি করা নয়। প্রকৃতিগত। অথচ আমার জন্ম। আমি উড়–ক্কু মাছ। মার জীবনে বার বার গোত্তা খাই। অন্য কোথাও যেতে পারি না। এই সমাজ অথবা বাংলাদেশে উড়ি আবার ডুবি। আমি যেন ওড়া আর ডুবার জন্যই জন্মেছি। এসব নিয়ে মাকে ভাবতে হয় না। মাতো দিব্যি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ভালো আছে।

আর কী কিছু দেব”

“না লাগবে না, মা জানো আজ না স্ট্রবেরি দিয়ে চিকেন রান্না করেছি”

“ফ্রিজে আছে গরম করে দিব”

“লাগবে না, রাতে খাব”

এর পর মার সাথে অনেকক্ষণ আলাপ করি। মা তুমি নাকি খুব সন্দুর করে নেইলপলিশ দিতে পার এক মহিলা বলল”। মা সাথে সাথে তিনটি ঘুমের বড়ি খেয়ে শুতে যায়। মার দৃষ্টি যেন আমাকে পুড়িয়ে দেবে। “নেইলপলিশ হায়রে। নেইলপলিশ...”

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<13499 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1