শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

একুশের প্রথম কবি ও কবিতা

শাহমুব জুয়েল
  ১৬ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ভাষাসৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী (জন্ম: ৭ নভেম্বর, গহিরা গ্রাম ১৯২৭ খ্রি. রাউজান চট্টগ্রাম, মৃত্যু: ২৩ ডিসেম্বর ২০০৭ খ্রি.) কালের চোখে তিনি অন্যতম। কিশোর বয়স থেকেই কবিতার হাত। চল্লিশের দশকে প্রায় সমবয়সী সুকান্ত ভট্টাচাযর্ ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রভাব তাকে পেয়ে বসে। প্রগতিশীল কবিতার ছাপ তার কবিতায় বেশ লক্ষণীয়। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময়ে বসন্তরোগের কাছে হার না মেনে কলমের খেঁাচায় ভাষাদ্রোহীকে আক্রমণ এবং বিচ‚ণর্ করে ভাষাভাষীদের মগজকে চেতনালব্ধ করেছেন। কালখÐের ওপর ‘কঁাদতে আসিনি ফঁাসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি সংগৃহীত পুঁজি হয়ে মাতৃভাষার প্রতি তৈরি হয় শানিত প্রেম, প্রাণিত করে শ্রেণিবিন্যাসে। বাঙালি যুবশক্তির মাঝে ফিরে আসে ভাষা রক্ষার একমুখী চিন্তা। সময়ের ক্লান্তিতে সাহিত্যচচার্র সুবাধে ‘সীমান্ত’ নামে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। সাময়িকীর নামকরণেও কেমন যেন আলাদা বৈশিষ্ট রয়েছে। সাহিত্যসাধনার পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলন, রাজনীতি, শিল্প সংস্কৃতিতেও সম্ভাবনার নতুনমাত্রার পথ তৈরি করেন। ধার-ভারের বিচারে ‘কঁাদতে আসিনি ফঁাসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কাব্যগ্রন্থের অন্যান্য কবিতায় ক্ষুরধার থাকলেও কিন্তু গ্রন্থনামী কবিতাটিই সমকালীন মানুষের সমকালীন সমস্যা উত্তোরণের নিদের্শনা হিসেবে সমৃদ্ধ করে। সবর্ত্র ঘটে অবাধ সঞ্চরণ। ভিনডানায় লাগে কবিতার বারুদ এ কারণে তারা বাজেয়াপ্ত করতে বুঁদ হয়ে যায় কিন্তু কবিতা কী থেমে থাকার বিষয় আগুনমুখে এগিয়ে যায় উচ্চকিত হয় বাংলা ভাষাভাষী মন। ধীরে ধীরে মুক্ত হতে থাকে পরাধীনতার নাগপাশ। কবিতাটি পূবর্ বাংলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছড়িয়ে যায়। বিপ্লবীবাতার্র কবিতাটিই ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা হিসেবে সবর্জন স্বীকৃত।

সীমান্ত পত্রিকাটি তৎসময়ে ছিল সমকালীন সাহিত্যমাঠ। যেখানে বাংলাদেশ ও কলকাতার লেখকদের সাহিত্য লেখা প্রকাশিত হতো। এ সম্পকের্ গোপাল হালদার ‘পরিচয়’ পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘সূযর্ পূবর্ দিকে ওঠে’। অন্ধকারের মধ্যেও মনুষ্যত্বের যে আলোকছটা পূবর্ বাংলা বাঙালি সংস্কৃতি-সৈনিকেরা দেখতে পেল- আমরা পশ্চিম বাংলার শিল্প সাহিত্যিকের ক’জন তার খবর রাখি। অন্ধকারে বাঙালি সংস্কৃতি যখন বিপন্ন, বাঙালি সংস্কৃতিবানদের পক্ষে যখন আর সেই গৌরবময় ঐতিহ্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না- এমনি সময়ে পূবর্ বাংলার পূবর্ ‘সীমান্ত’ থেকে আমরা ‘সীমান্ত’ পত্রের আহŸান শুনতে পেলাম- ‘সীমান্তের’ সকল বন্ধুকে আমরা অভিনন্ধন জানাচ্ছি।

তার ‘কঁাদতে আসিনি ফঁাসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কাব্যগ্রন্থের যে কবিতাগুলো আড়োলন তৈরি করে- আমি এক দুরন্ত সৈনিক, ভালো লাগে, মালবিকা, সূযির্দন, মাটির গান, স্বাধীনতা, জাপানিরা হিরোহিতোর, প্রিয়তমাসু, কুকুরের কান্না, রবীন্দ্রনাথের প্রতি, পঁচিশে বৈশাখ, কঁাদতে আসিনি ফঁাসির দাবী নিয়ে এসেছি, জীবনের সফলতা, দুঃসময় ১৯৭১, জারজেরা সব শোন, স্বাধীনতা ১৯৮৪ প্রভৃতি।

তার কবিতায় স্বদেশীয় চিন্তা, রাজনৈতিক চেতনা, সংগ্রাম শোষণ বিপ্লব বিদ্রোহ নিঃসঙ্গতা, ধূসরতা, মানবতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, অপকৌশল, সমাজ সংস্কৃতি, বিজয়ের আনন্দ বিষয়গুলো শাব্দিক ভঁাজে ভঁাজে দায়বদ্ধ শিল্পীর মতো বাস্তবতার সঙ্গে মিশে বোধের প্রকাশ ঘটেছে। চিত্ররূপেও পাঠককে আকৃষ্ট করে। বলা বাহুল্য তার কবিতায় একটি মোহ কাজ করে যে মোহ দাবি শিখিয়ে মঞ্চে দঁাড় করায় খুঁজে পায় জীবনের সাফল্যভুবন।

‘নজরুলের উদ্দেশে’ কবিতায় নজরুলে প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধার ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়। বৃটিশ কোলাহলে সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ তখন বাঙালি শান্তির প্রত্যাশায় মুখরিত কখন নেমে আসবে শান্তির সুবাতাস। ঠিক তখনি নিভীর্ক নজরুলের আগমন ঘটে টানাপড়েন শুরু হয় দুঃখ বেদনার, পুষ্প পরাগের মতো বিদ্রোহের ছায়াপথে জীবনে পূণর্তার পরিচয় ঘটে এভাবেÑ ‘তবু এ পৃথিবীর নিঃসঙ্গতা যখনি করি অনুভব/ফুলের গন্ধের মতো তুমি আসো সারা মন ভরি/ তুমি আসো এ জীবনে বিদ্রোহের ছায়াপথ ধরি/ তুমি ছাড়া অথর্হীন মনে হয় জীবনের লক্ষ্য কলবর।’

‘আমি এক দুরন্ত সৈনিক’ কবিতায় দেশপ্রেম ভাষাপ্রীতির প্রকাশ ঘটেছে। সৈনিকের ভ‚মিকায় প্রেমবোধকে মিশিয়ে নববিকাশ ও জ্যোতিমর্য় অভ্যুত্থানের সমন্বয় সাধন করে আশাবাদের ইঙ্গিতও দিয়েছেন একারণেও পূণর্তা চান মানুষের ভাব ও ভাষার। শোসকের খড়গ থেকে মুক্তির প্রত্যাশা যাদের আঘাতে মানুষ সীমাহীন দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করছে প্রতিনিয়ত দুভোের্গর স্বীকার হচ্ছে। তা থেকে কবি মুক্তি কামনা করছেন। তাই প্রতিবাদের ভাব কবিতাসূত্রের মোড়কে পেশ করেছেন। তার চিন্তায় রয়েছে পীড়িত মানুষের মুক্তি সে সূত্রে তিনি সৈনিকের ভ‚মিকায়Ñ ‘যেদিকেই চাই জীবন জীবন-কেবলি জীবন দারিদ্র্য অপসারিতÑ বিপ্লবলব্ধ, সমুদ্র বিস্তার/ একটি বিশ্বাসবিহীন সীমাহীন সুন্দর অতি সুন্দর/ মধুর সুন্দর জীবনের অপেক্ষায় আছি/ প্রতীক্ষায় আছি।’

‘ভালো লাগে’ কবিতায় তার কবিদৃষ্টি অন্যরকম। প্রেমকে নিয়েই স্বদেশীয় সমস্যা মানুষের দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব, নিমর্ম জীবন সংগ্রামের আখ্যানভাগ তুলে ধরেছেন। এখানে ভালো লাগার প্রধান উপমা আকাশ যার সীমানা নেই কিন্তু সীমা-পরিসীমায় সমস্যা উপস্থিত থাকে। রাষ্ট্রকে মনে করা হয়েছে প্রিয়তমার কবিতা এ কবিতার জন্য সংগ্রাম সমসময়। কবিতার মধ্যদিয়ে প্রিয় দেশের রূপসৌন্ধযর্ ভালোলাগা, প্রেমবোধ এবং বন্ধনের চিত্রভাষ্য এঁকেছেন। এ দেশের দিকে তাকালে কয়েকটি ছবি সম্মুখে এসে যায় ঠিক প্রিয়তমার মতো। সে ছবিগুলো হলো জীবনের রোমাঞ্চের চঞ্চলতার এবং উদ্দাম জয়যাত্রার। সেই কবিতাকে রোমাঞ্চ হিসেবে ভাবতে ভালো লাগে। ‘প্রিয়তমা তুমি আমার কাছ থেকে চেয়েছিলে/ জীবনের সমস্ত রোমাঞ্চ সমপির্ত একটি প্রেমের কবিতা/ প্রিয়তমের কণ্ঠচ্যুত মালার মতো একটি কবিতা/ অন্ধ যার গতি নগ্ন চঁাদের মতো যার রূপ/ তুমি আমার কাছ থেকে চেয়েছিলে তেমন একটি কবিতা।’

‘মালবিকা’ আক্ষেপ ও হারানোর বিষয় কবিতায় অভাবিত আকুলতা নিয়ে উপস্থিত হয়। হৃদয়ের টনক নড়ে রোমান্টিকতায়। কবির আক্ষেপ জীবনে বসন্ত এলো না। হৃদয়ে ঠঁাই পায়নি আরেকটি হৃদয় দেশে বসবাস অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ভিনদেশী হিং¯্র পশু বারবার হানা দিচ্ছে। কারোরই রেহাই নেই বঁাচার তাগিদ অনুভব করছে কিন্তু সুযোগ মিলছে না শত্রæরা নিমর্মভাবে হত্যা করছে মানুষ। মানুষ সারিবদ্ধভাবে পার করছে দুঃসহ সময়Ñ

‘মালবিকা এদেশের সকল জননী/ শহরে বন্দরে/ শত্রæর নিমর্ম গুলিতে তাহলে কি/ মরে গেছে দুঃসহ মন্বন্তরে।’

‘সূযির্দন’ কবিতায় পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে কালের সরোবরে কবিতাই মুক্তির পথনিদের্শনা দিয়েছে। কবির সূযির্দন কবিতায় তিনি মনে করেছেন বাঙালি জাতি ভাব ভাষা ও স্বদেশীয় অধিকারের প্রশ্নে পরাধীন। যেখানে বসবাস করে সেটা একটি কারাগার। যেখানে প্রতিটি মানুষ সুন্দর স্বপ্ন দেখে তাদের সুন্দর মন আছে পৃথিবীর আলো-বাতাসে অধিকার আছে প্রত্যেকেই চায় জীবনের নিশ্চয়তা। তাদের পিপাসা নতুন জীবনের সৌরজগতের হাওয়ার। যদি কোনো কারণে তা থেকে বঞ্চিত হয় প্রাণের পরশে মেখে যাবে রক্তের চুমো কিন্তু এটি কাম্য নয় প্রতিক্ষণে বিশ্বাস লালন শোষণবিহীন নিশ্চিত সময় আসবে গ্রাসমুক্ত হবে ইতিহাসের পাতা। কবিতায়- ‘যেতে হয় যদি সেই আকাক্সক্ষার অস্থিরতা লয়ে/ চলে যাব মৃত্যুর শান্তির স্বাদ দুই চোখে মাখায়ে/ শুধু রেখে যাবো নৈবেদ্যের থালে/ প্রাণের পরশমাখা দুই ফেঁাটা রক্তের চুমো।’

‘জাপানিরা হিরোহিতোর জন্য হারিকিরি করে’ সনাতন ধারায় হিরোহিতো দীঘর্সময়ের সম্রাট আজীবন ক্ষমতায় ছিলেন তার সম্মানাথের্ জাপানে ইচ্ছামৃত্যু একটি পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। কবি সমসাময়িক বিষয়কে কবিতায় এনেছেন। দেশবিভাগ, প্রজাতন্ত্র ও ইসলামী বিধিবিধান, নারীর স্বাধীনতা, রক্তের দাম, পরাধীনতা, ভিক্ষা লাভ, ভৌতিক খাদ্য, গোলামীর ভাব, আমির, নিরক্ষর মানুষ, হারিকিরির মতো উপসের চিন্তা, শান্তি প্রত্যাশা, আরবি অক্ষরে বাংলা প্রণয়ন, জাতীয় মূলধনের অভাব, ভোগ বিলাস, ইতিহাস শেখার চেষ্টা চমৎকার তথ্য বুননের মাধ্যমে ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগোত্তর এবং পরবতীর্ সময়ের হালচাল চুম্বকীয়ভাবে এসেছে। দেশ বিভাগ হয়েছে কিন্তু সমস্যা বদলেনি। নতুন করে শাষক ও শোষিতের কক্ষ স্পষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতাকামী মানুষ নতুন করে স্বাধীনতার কথা চিন্তা করতে হয়েছে মানুষে মানুষে বিভাজন নারী জাতির নতুন করে বঁাচার স্বাদ পেয়েছে শিখেছে আত্মত্যাগের মূলমন্ত্র। নতুন করে ভিক্ষা করার ক্ষেত্র পেয়েছে পশ্চিমবাংলার দয়া-দক্ষিণায় বেঁচে থাকতে হয়। তাদের কতার্ ব্যক্তি ভাবতে হয় তারাই শাসক-শোষক। নিরক্ষর মানুষ রাজা রাষ্ট্রপতি বোঝে না তাদের আজন্ম গোলামি করতে হবে। দেশ বিভাজন করে যে উপকার তারা করেছে। রামরাজ্য আর ইসলামী হুকুমতের ক্ষেত্র, নিজ অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতির মান-উন্নয়ন কিন্তু পূবর্ বাংলার মানুষের ভাগ্যবিড়ম্ভিত হয়েছে। এতকিছু সত্তে¡ও জাপানি হিরোহিতোর জন্য হারিকিরির মতো তাদের সম্মানে উপোস থাকার মতো ত্যাগ স্বীকার করা যেতে পারে। জনসাধারণকে বোকা ভেবে তো শায়েস্তা করার জন্য পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয় কিন্তু জনগণের সমস্যাকে সমাধানের চেষ্টা করা হয় না। এ ক্ষেত্রে জনগণকে জাপানিদের ইতিহাস শেখানোর নিরন্তর চেষ্টা।

‘আমরা এদেশের নিরক্ষর মানুষ/ রাজা আর রাষ্ট্রপতির তফাৎ বুঝি না/ আমরা আপনাদের রাজা বলেই জানি/ হলেনই বা রাজা তবু স্বদেশী তো/ রাজা হিরোহিতোর সম্মানের জন্য/ জাপানিরা এখনো হারিকিরি করে’

‘মাটির গান’ কবিতায় মাটির সঙ্গে কৃষাণের সম্পকর্ সুনিবিড়। ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যাবে কৃষাণ ফসল বুননে মাটিকে পরম মমতায় অঁাকড়ে ধরে মানুষের আহারেই তারা বড় অংশীদার। কিন্তু দুভার্গ্য হলেও পরম সত্য কৃষাণকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বরাবরের মতোই দূরে রাখা হয়। মহাজনী প্রথা তাদের উৎপাদনের ভ‚মিকায় বাদ সাধে। ভাগ-বাটোয়ারার ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি করে পৃথিবী মিথ্যে ও বোবাদের ভ‚মিকায় অনড় থাকে অথচ মাটিই তাদের দান ও প্রাণ।

‘মাঠভরা ক্ষেত সোনালী ধান মোদের প্রাণ/ মাটির দান/ কিষাণ কণ্ঠে রাখালিয়া সুরতান/ মাটির দান’

‘স্বাধীনতা’ কবিতায় শোষণের বিরুদ্ধে বীর সন্তানেরা বুলেটকে তোয়াক্কা করেনি জয়ের প্রতিজ্ঞা করেছে তারা চায় অবসান হোক শোষণের উত্তোরণ হোক মানুষের। কবিতায়-/‘স্বাধীনতা লাগি কত যে লক্ষ বীর/ বুলেটের মুখে রক্তের বিনিময়/ প্রাণ দেয়া নেয়া প্রতীজ্ঞা সুগভীর/ জয়ের চিহ্ন না জানি সুনিশ্চয়।’

‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ ও ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতায় জীবন সংগ্রাম, সংস্কৃতির উপমিত নদী, সম্প্রীতির হিসেব-নিকেষ নানাভাবে এসেছে। বলা চলে রবীন্দ্রনাথ বাংলাসাহিত্য গগনের উজ্জ্বল তারকা। তার লেখনী সমকালের রৈখিকতাকে স্পশর্ করে এবং বাঙালি তার কাব্যিক সুষমাকে মনের গহীনে নিয়ে যায়। মনের আবজর্না দূর করে কবিতাই হয়েছে প্রধান উপকরণ। যে মানুষ বাংলার রূপলাবণ্যকে অনুধাবন করতে পারত না। তার বিচিত্র সংগীত সোনার প্রতিমা, কীতির্নাশা, ধলেশ্বরী, পদ্মা-মেঘনা-বিশাখা প্রাণের সুষমা হয়ে হৃদয়কে রাঙিয়ে কীতির্মান হয়ে ধরা পড়েছে বাঙালির চেতনায়। পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্রনাথের জন্মবাষির্কী এদিনে বাঙালি নতুন চিন্তা-চেতনাকে উপজীব্য করে ঘুরে দঁাড়ায়। কবি, সংস্কৃতি কমীর্, সংগীতশিল্পীদের গানে কবিতায় মুখরিত হয় বাঙালি প্রাণ। পাকিস্তানি শাষক গোষ্ঠীকতৃর্ক নিষিদ্ধ বাঙালি মনে যে হিন্দু-মুসলীম, মসজিদ-মন্দির, রাম-রহিম, হোলি-মহরতের বিষয় দেশপ্রেমিকদের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে দ্বিধা-দ্ব›েদ্বর বিলুপ্তি ঘটে, প্রশ্নের সমাধি রচিত হয়। জীণর্ পুরাতন মলিন অবস্থার বুকে গজায় মঞ্চ ও বংশীবদন। শয়তান উপশয়তানের অপ-কৌশল ছিন্ন করে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, কবিকে প্রতিবছর স্মরণ করার মানসিকতা তৈরি হয়। কবিতায়- ‘গত বছর ঠিক এমনি দিনে/ এইখানে আমরা পঁচিশে বৈশাখের/ আয়োজন করেছিলাম।

বিদেশি শয়তানের অপ-কৌশলে/ হিন্দু মুসলমানের যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল/ আমার ও তোমার মনে- বাঙালির মনে।’

‘কঁাদতে আসিনি ফঁাসির দাবী নিয়ে এসেছি’ অমর একুশের প্রথম কবিতা চট্টগ্রামে গঠিত সবর্দলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়ক ছিলেন মাহবুব আলম চৌধুরী তার হাতে একুশের প্রথম সাহিত্য সৃষ্টি এ কবিতাটি রচিত হয়েছিল। প্রকাশের ক্ষণকাল পরেই তৎকালীন মুসলীম লীগ সরকার কতৃর্ক কবিতাটি বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। কবিতাটি প্রকাশের ইতিহাস এরকম- ‘১৯৫২ সালে দশম শ্রেণির ছাত্রী মনজুরা বেগম ভাগ্যক্রমে এই কবিতার অংশ বিশেষ পেয়ে যান। বড় ভাই পুলিশ বিভাগে কমর্রত ছিলেন এবং সলিমুল্লাহ হলে পুলিশি হামলার কালে ছাত্রদের যে সব কাগজপত্র আটক করা হয় সেখানে হাতে লেখা কবিতাংশও ছিল।

ভাষা আন্দোলন প্রায় সব বাঙালি পরিবারকেই কোনো না কোনোভাবে স্পশর্ এবং উদ্দীপ্ত করেছিল। পুলিশের কমর্কতার্ ভাই সস্নেহে আবেগ উদ্দীপ্ত ছোটবোনের হাতে আটক করা কবিতাটি তুলে দিয়েছিলেন এবং কবিতাপাঠে অভিভ‚ত কিশোরী তার ডায়েরিতে তখন এটা টুকে রেখেছিলেন।

পরবতীর্ জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কখনোই এই ডায়েরিটি সঙ্গ ছাড়া করেননি তিনি। অতি সম্প্রতি একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এই কবি এবং তার কাব্যকৃতি বিষয়ক আলোচনা দেখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটি লেখকের হাতে তুলে দেন।

স্কুল শিক্ষয়িত্রী মনজুরা বেগম সোনালি বোডর্ ও পেপার মিলসের নিবার্হী কমর্কতার্ গোলাম মাওলা খানের স্ত্রী এবং দুই কন্যা ও এক পুত্রের জননী।’

কবিতায় ভাষা শহীদের রক্তের বণর্না দিতে কৃষ্ণচ‚ড়া ও আগুনের ফুলকি সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। পাকিস্তানি শাসকের হুকুমে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র শিক্ষক জনতা কোলের শিশু এবং মেহেদী পাতার রং না খসা রমণী চল্লিশটি তাজা রতœ প্রাণ দিয়েছে। কবি মনে করেন তারা বেঁচে থাকলে লিংকন রঁল্যা, আঁরাগ, আইনস্টাইন হতো। বাঙালি কী ছেড়ে দেয়া প্রাণী তাদের রয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারকের চেতনা, রবীন্দ্রনাথ, কায়কোবাদ, নজরুল রামেশ্বর ও আব্দুস সালামের কচি বুকের রক্ত, হীরের মতো ছেলেদের ওপর নিবির্চারে গুলি ছুড়েছে। প্রগতিশীল মতবাদ হলো চল্লিশটি রতœ যেখানে প্রাণ দিয়েছে তাদের জন্য কঁাদতে আসিনি খুনি জালিম নিদর্য়দের ফঁাসির দাবি নিয়ে এসেছি তাদের মধ্যে কেউ কেরানি, বাবা, সরকারি চাকুরে, সদ্য বিয়ে বসা কেউ, মায়ের চিঠিপ্রাপ্ত ছেলে, মূতির্মান স্বপ্নবাজদের প্রাণতে তেড়ে নিয়েছে। জালিমের নিদ্দেশ্য মাতৃভাষাকে নিবার্সন করা তাদের ফঁাসির দাবি নিয়ে সমবেত। মৃতদেহের ওপর যে বিশ্বাসঘাতকরা বিচার চাই, যাদের দিয়ে একটি সুন্দর সংসার হতো শান্তি ও সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে যারা কবিতার মতো একটা দেশের সূচনা করতে পারত। তারা শহীদ, তাদের হত্যা করে বাংলার মাটি, আলো-বাতাস থেকে মুছে দিতে পারবে না। নিপীড়নকারির কঠিন হাতকে উপড়ে দিতে নিস্তব্ধতার মাধ্যমে ন্যায়-নীতির বলিষ্ঠতায় স্বাধীনতার বলিষ্ঠ কণ্ঠ নিয়ে বিজয়ের সূচনা করবে। ইতিহাসে থেমে যায়নি অগ্নিময় হয়ে প্রতিশোধের মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনা ও স্বস্তির অবস্থা নিয়ে এলো। যাত্রা হলো একটি স্বাধীন ও সাবের্ভৗম দেশ। কবিতায় -

‘সে অসংখ্য ভাইবোনদের নামে/ আমার হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত/ যে ভাষায় আমি মাকে সম্বোধনে অভ্যস্ত/ সেই ভাষা ও স্বদেশের নামে এখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে/ আমি তাদের ফঁাসির দাবী নিয়ে এসেছি/ যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে/ নিবির্চারে হত্যা করেছে।’

‘দুঃসময় : ১৯৭১’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালি একটি দেহের মতো আত্মীয়তার পরম বন্ধনে সম্পৃক্ত ছিল তা প্রাসঙ্গিক আকারে বিন্যস্ত হয়েছে। সে দুঃসময়ে মানুষ নিজেকে ছাড়া কাউকেই ভালোবাসতো না, কেউ কাউকে সহযোগিতা করা, সন্তানের মৃত্যুতে বাবার শিশুর মতো কান্না, বাজারে বিষের দাম বাড়িয়েছে নারী কারণ মৃত্যু শ্রেয়, নিরস্ত্র যুবকের বুকে বৃত্ত অঁাকা পতাকা, স্বামীর সোহাগ বঞ্চিত লজ্জাবতী মেয়ে, কোরান ও কলেমা পাঠ, মুক্তির প্রেরণায় স্বাধীনতা সংগীত গভীর অনুভ‚তির মাধ্যমে অভিন্ন চিন্তন ধারা দিয়েছে। বেয়োনেটের মুখোমুখি দঁাড়িয়ে জয় বাংলা ¯েøাগান দিয়ে মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছে। বঁাচার জন্য আশ্রয় নিয়েছে বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে কিন্তু অন্ধকারে ডুবে গেছে তাজা তাজা প্রাণ। তরুণ দম্পতি স্বামীর কাছে নববধূর প্রত্যাশিত আদর সোহাগের কিছুই পায়নি। কণর্ফুলিতে তার লাশ ভেসে উঠলেও যুবককে শনাক্ত করবে এমন অবস্থা কারও ছিল না কারণ ভালোবাসা ছিল শুধু স্বদেশের জন্য। অশ্রæ রক্তে শোধিত হয়ে নিমির্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকা মুক্তির প্রেরণায় স্বাধীনতার সংগীত। নিমর্ম হত্যার নিদের্শ দিয়ে বাংলার বুদ্ধিজীবী শহীদ সাবের, লেখক মুনীর চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান এভাবে মুক্তিযুদ্ধের অমর বাহিনী ও কাহিনীকে হৃদয়ের তলদেশ থেকে মুছে দেয়ার পরিকল্পনায় নেমেছে। তারা চায় শহীদের স্মৃতির মিনার মুছে দিতে, প্রেরণা উৎস, মযার্দার স্মারক ভুলে যেতে চান না বাঙালির মতোই মনে এঁটে রাখতে চান। শকুনগুলো রক্তমাখা হাত নিয়ে রাষ্ট্রের পতাকা জাতীয় সংগীত স্পশর্ করুক, সংসদে বসে গাড়ির সামনে পতাকা লাগিয়ে ভাগ্য নিধার্রণ করুক। স্পষ্ট ভঙ্গিতে বলেছেন এটি মানা যায় না সম্ভবও নয়। যারা ইতিহাসের পতাকাকে ক্ষত-বিক্ষত করে বিদ্রƒপ করে বরকত সালামের মতো ভাষাসৈনিকের অমর স্মৃতিকে মুছে দিতে এগিয়ে যায়। আবহমান গ্রাম বাংলার মানুষের সে শংকিত না হয়। সময়ের পদচারণায় মুখরিত হয়ে স্মৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে জয় ও অজের্নর লয় আসে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমবেদনা প্রাণের ওজস্বিতায়। ‘আমি চাই না রক্তমাখা হাতগুলো/ শকুনের থাবা হয়ে আমার রাষ্ট্রীয় পতাকা/ আর জাতীয় সংগীতকে স্পশর্ করুক।.../ আমি চাই না সংসদে বসে/ তারা আমাদের ভাগ্য নিধার্রণ করুক/ তাদের বুটের আওয়াজে আবার শংকিত হয়ে উঠুক/ আবহমান বাংলার স্বাধীন মানুষ।’

যুবশক্তিকে মাতিয়ে তুলতে নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার সূত্রঘর অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের মতো ভাষাসৈনিকের মনে কঁাদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি কাব্যগ্রন্থটি সমরৈখিকতা রক্ষা করছে বলে মনে হয়। দুটো কাব্যগ্রন্থই জননন্দিত বিপ্লববাদের দিকে ধাবিত করে। লক্ষ্য অভিন্ন, শোসকের ভীত গুড়িয়ে সমকালের চাকাকে সচল করা, স্বাদেশিক চেতনায় বঁাক ফিরে সাফল্য বয়ে আনা। জনমুক্তি ভাষা ভাবমুক্তির জন্য সব সীমাবদ্ধতা উপড়ে সবর্জনীন দ্বা›িদ্বকতা দূর করা। আলোচনায় পঠনে মনে হতে পারেÑ এবিষয়গুলো তার কাব্যগ্রন্থে চিরন্তনের আসন গ্রহণ করেছে। যখনই যেখানেই অস্তিত্ব সংকট ধরা দেয় সে অস্তিত্ব ভাষার অধিকারের, তা রক্ষায় জীবন ও ভালোবাসার অনুভবে তা প্রবলভাবে নাড়া দেয়। সময়ের গতরে আমরা পূবের্ সমস্যায় ছিলাম এখনো তাড়া করছে। মুক্তি লাভের জন্য যুদ্ধ হয়েছে এখন যুদ্ধ হচ্ছে মূল্যবোধের সাথে। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কঁাদতে আসিনি ফঁাসির দাবী নিয়ে এসেছি কাব্যগ্রন্থটি মনে হচ্ছে দিকবদলের হাওয়া আর তিনি সমাজ পরিবতর্নবাদী কবি। তার কবিতায় মানুষের অন্তজর্গতের অনুভ‚তির পূণর্ প্রকাশ রয়েছে। স্বদেশ ভাষা এবং প্রেমের ত্রিমাত্রিক সমন্বয় রয়েছে চোখে পড়ার মতো। সে কারণে সময়ের ভয়ঙ্কর রূপের সামনে তিনি আসন্ন আলোর প্রতীক হয়ে ধরা দিয়েছেন। তৈরি হয়েছে কবিতার শৈল্পিক গুণগ্রাম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<22611 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1