বাংলাসাহিত্যের বিতকির্ত এবং উজ্জ্বল নক্ষত্র কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসু (১৯২৪Ñ১৯৮৮) ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের রাজনগর গ্রামে জন্মেছিলেন, তার প্রকৃত নাম ‘সুরথনাথ’ আর ডাকনাম ছিল ‘তড়বড়ি’ আরো মজার বিষয় ‘সমরেশ’ নামটি দিয়েছিল, তারই বন্ধু এবং স্ত্রীর ভ্রাতা দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়। তারপরও সাহিত্য ক্ষেত্রে ‘কালকুট’ এবং ‘ভ্রমর’ ছদ্মনাম দুটো ব্যবহার করতেন। বাইশ বছরের একজন তরুণ সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিকায় লেখেন ‘আদাব’ গল্প, ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশ (১৯৪৬-এর শারদীয় সংখ্যায়) ‘ আদাব’ গল্পে পাঠক-সাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে গাল্পিক সমরেশ বসু। ‘উত্তরণ’ (১৯৫১) উপন্যাস সমরেশ বসুর প্রথম প্রকাশিত রচনা; ‘বিবর’ উপন্যাসটি শারদীয় দেশ (১৯৬৫) এ প্রকাশ হলে দেশ জুড়ে বাদানুবাদ শুরু হয়, ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটি শারদীয় দেশ (১৯৬৭) এ প্রকাশ হয় তারপর ‘পাপ-পূণ্য’ (১৯৬৫) গল্পটি ‘দেশ’-এ প্রকাশ হলে ব্যাপকভাবে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে, কিন্তু এই সমরেশ বসুর হাতেই ‘গঙ্গা’ (১৯৫৭) ‘কোথায় পাবো তারে’র (১৯৬৮) মতো রচনা পাওয়া যায়।
আমরা জানি, ১৯৪৬ থেকে ১৯৮৮ পযর্ন্ত বিয়াল্লিশ বছরের সাহিত্য জীবনে নামে-বেনামে গল্প এবং উপন্যাসের গ্রন্থের সংখ্যা দুইশত পঁচাত্তরটির কাছাকাছি ; ‘আদাব’ দিয়ে শুরু এবং অসমাপ্ত রেখে গেলেন ‘দেখি নাই ফিরে’ তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে অন্যতম শক্তিশালী লেখক, তার অধিকাংশ গল্পে সংবেদনশীল ও বলিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। ছোটদের জন্য গোয়েন্দা কাহিনীতে তার বিচরণ ছিল, যা বড়দেরও আকৃষ্ট করত, শিশু সাহিত্যিক না হয়েও গোগোল সিরিজের শিশু-উপন্যাসগুলোতে তার দক্ষতা স্পষ্ট। বিষয়-আঙ্গিক মানবভাবনা-জীবনচেতনা যেমন এসেছে সমরেশের গল্পে, তেমনি কালচেতনাবিষয়কে সময়ের কাছে নিয়ে স্থাপন করা তার গল্পের অভিনবত্ব। ছয় খÐে প্রকাশিত গল্পসংগ্রহে দুইশতকের অধিক গল্প পাওয়া যায়। তার শ্রেষ্ঠ কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা করলে বোঝা যাবে কত বড় সাহিত্যিক ছিলেন, দারিদ্র্যের সঙ্গে তাকে দঁাতে দঁাত চেপে লড়াই করতে হয়েছে, তার জীবন সংগ্রাম শুরু হয়েছিল কৈশোরে, তাই লেখাপড়া এগোতে পারেনি বেশিদূর, নিতান্ত অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলেন, ডিম বিক্রেতা থেকে পেশা শুরু, চাকরি করেছেন ছোট-বড় অনেক। বামপন্থী রাজনীতি করতেন, জেল খেটেছেন কয়েকবার। তারপরও সাহিত্যকের জীবনের শ্রেষ্ঠতর কাজ বলে বিবেচনা করেছেন।
‘উজান’ গল্পে দেখা যায় একজন নারাণ, যে বেচনকে অথার্ৎ তার সহকারীকে গালাগালি করছে, দুই থাপ্পড় কষে বসায়, অপরাধ তেমন কিছুই নয়, শনিবারের সন্ধ্যে, কারখানা রবিবার ছুটি, তাই একটু গান-বাজনায় আসর জমানো, কিন্তু বেচনও তেমন তেদোড়, পরক্ষণে সেও মোক্ষম ঘুষি মারে নারাণের মুখে। তখন সে বনষ্পতি ঘিয়ের কারখানা থেকে চলে যায়। কারণ সে হৈ-হট্টগোলের লোকালয়ে থাকতে চায় না, মন বড় উদাসীন, এককালে বউয়ের তিন-তিনটে ছেলেমেয়ে ছিল, সেগুলো বছর ভরে ভুগলো, একটা-একটা মরলো, তারপর মানুষটা বদলে গেল, বাবুসাহেব দীনদয়ালের ধাপার মাঠে কাজ নিয়ে নিজেকে উজার করে দিচ্ছে, জগৎ-সংসারের তাবৎ কিছু অথর্হীন, প্রকৃতির মাঝে জীবনের যত পাওয়া, অসীম দিগন্তজোড়া আকাশ-পাখপাখালি গাছগাছালিÑ দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত-খামার সবুজের ভেতর অরণ্যের ভেতর জীবনের সমস্ত চাহিদা যেন মেটে, নারাণ নিজের হাতে শুকনো খটখটে জমির বুকে ফসল ফলায়, বঁাধাকপি-শীম-বেগুন ঢেঁড়স-গাজরসহ বিভিন্ন সবজি সবুজ আনন্দে ভরে বুক, জীবন যেন থিতু মানুষহীন অরণ্যের নৈঃশব্দে, এভাবেই চলছিল জীবনের ছোট নদী, কাকতালীয়ভাবে একদিন সকালবেলা নারাণ দেখল, দু’তিন বছরের বাচ্চা নিয়ে একটা মেয়ে মানুষ মাথায় শাকের চুবড়ি নিয়ে লাফ দিয়ে তার সীমানায় এসে পড়ল, নারাণ সেভাবে পাত্তা দিতে চায় না, বরং দূর-ছাই করতে লাগল, কিন্তু মেয়ে মানুষ বড় নাছোড়বান্দা, সে জানাল, এ ঘরে একদিন আমিই ছিলুম, ছিলুম আমার সোয়ামীর সঙ্গে, মানুষটা মইল, তাই; নইলে...এখন শাক বেচে, ঢেঁড়স বেচে খাই...নারাণের নৈঃশব্দের বাগানে এক বিন্দু জল দিয়ে থিতু হওয়া জীবনে আগুন ঢেলে দিল, এভাবে কেউ তার জীবনে উজান বইয়ে দেবে কখনো ভাবেনি, গল্পের শেষপ্রান্তে দেখা যায়, বাধা দেয়ায় মেয়েটি যখন আসতে পারল না, তখন একদিন নারাণ তার বাড়ি যেয়ে বলল, পারলুম না আর থাকতে, চলে এলুম...মানুষ নিঃসঙ্গ থাকতে পারে না, বেঁচে থাকে ভালোবাসায়, তিরস্কার-ভৎর্সনা-উপেক্ষার মধ্য দিয়ে চাহিদার মৌলিকতাকে অস্বীকার করতে চায়, কিন্তু পারে না, কারণ মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পকর্ই চিরস্থায়ী, মৌল সেই ভালোবাসায় জীবনের কাছাকাছি ধাবিত করে। সমরেশ বসু আদতে ছিলেন ছোট গল্পকার, ব্যক্তিজীবনে সমস্যা ও নাটকীয় ঘটনার তাৎপযর্জনক ঝলকই তার মধ্যে হ্রম্ব-দীঘর্ গল্পের জন্ম দিয়েছে, একমুখী বক্তব্যের তাগিদ এনেছে, বিচিত্র বিষয় এবং বিচিত্র ভাবনার মানুষ নিয়েই বিশ্বসংসারের মানুষ, এমন জ্যান্ত মানুষ, তার খুঁটিনাটি নড়ন-চড়ন বাংলাসাহিত্যে এর আগে আসেনি, এমন বাহুল্য হীন একরোখা গল্প প্রায় অঙ্গভঙ্গির মতো অবিচ্ছেদ্য কাটা-ছঁাটা দ্রæতচালের নিরলঙ্কার বণর্না, ছবির মতো মনের গহনে বসে যায়, গেঁথে যায় সাবলীলভাবে।
সমরেশ বসু গল্প লেখেন প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে, তার গল্পের জীবন গতানুগতিক নয়, বেশ পরীক্ষামূলক গল্পের আঙ্গিক, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের সঙ্গে শ্রেণিহীন মানুষের ভিড়টা দেখা যায়, পরকীয়া প্রেমকে একটা অন্যমাত্রা দেয়া যেন তার গল্পের রহস্য, সেই রহস্যের ভেতর দিয়ে নানান ইঙ্গিত, বাদাবনের খেত-মজুরনী বাসিনী গল্পের নায়িকা,‘বাসিনীর খেঁাজে’ গল্পে দুই সন্তানের মা বাসিনীকে দেখি, তার জীবন অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, শোচনীয় দারিদ্রতা জীবন-সংসারে লেপ্টে থাকলেও সে নদীর মতো চলতে জানে, ভেঙে পড়তে জানে না, অমানুষিক পরিশ্রম করলেও জীবন সেই তিমিরে কেঁদে যায়, স্বামী ফটিকের অকথ্য খিস্তি-খেউড় যেমন, তেমনি বরাদ্দ প্রহার, এদিকে নালটনের ড্রাইভার পবনচন্দ্র মৈত্তির একটু-একটু দেখাশুনা হতেই ভালোবেসে ফেলে, মন তার দিয়ে দেয় বাসিনীকে, স্বপ্ন যেন তাকে নিয়েই, সাজিয়ে তোলে জীবন-সংসার। কিসের নেশায় পবন মজেছে কেউ না জানুক সেই শুধু বোঝে, এ যে ভালোবাসা! যার টানে সে অধীর, বাসিনীর ঠেঁাটে যে পেলবতা, চোখে যে মাধুযর্ যেন সে এক অপ্সরী, গেমোবনের ছায়া পড়া নদীর সেই স্ফটিক জলের মতো বাসিনীর সত্ত¡া, ওর থাকা না থাকা, হাসি-চলা-ফেরা ছায়া-ছায়া অবয়ব পবন সবর্সময় টের পায়, নিজেকে বিলীন করে তার মাঝে, গল্পে দেখা যায় বাসিনী যখন কলকাতায় যায় সঙ্গিসাথীদের সঙ্গে, কৃষক আন্দোলনের একজন কমীর্ হিসেবে, তার ধারণা কলিকাতায় মন্ত্রীর কাছে মিছিল নিয়ে গেলে চালের দাম বাড়বে না, দু’মুঠো খেয়েপরে বঁাচবে তারা, সে কারণে বাসিনীর মতো মানুষগুলো কলিকাতার রাজপথে মিছিল নিয়ে আসে। পবন তার নালটন চালিয়ে কলিকাতায় আসে বাসিনীর খেঁাজে, কিন্তু সান্ধ্য আইনের মধ্যে সহজ-সরল পবন পড়ে, তখনো বাসিনীর মুখটাই স্মরণে আসে, কারণ বাসিনীকে সে ভালোবাসে যা বলতে পারেনি, হয়তো কখনো বলতে পারবে না, বাসিনী একমাত্র তার কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু। মানব মনের এই ভালোবাসা অকৃত্রিম, কোনো ফাকি না থাকলেও বাধা রয়েছে, এবং সে বাধার পথ ধরেই মানুষ ছুটে যায় পিপীলিকার মতো, কখনো সে সমান্তরাল পথে রহস্যের ভেদ খঁুজে পায়, কখনো পায় না।
‘উত্তাপ’ গল্পের নায়ক হরেন রায়, আট বছর ধরে শিউড়ি শহরের কলেজে পড়ে, বাপের আছে জমি-জিরাত ঘর-পুকুর, কিন্তু ছেলে বিদ্যাজের্নর পরিবতের্ অন্য নেশায় বঁুদ, যার দরুন একই ক্লাসে দীঘর্সময়, গল্পে বীরভূম অঞ্চলের দৃশ্যপট ফুটে উঠেছে, সে বার স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে দেখে প্রচÐ ভিড় এবং সঁাওতাল দিনমজুর মানুষরা বৃষ্টিতে ভিজছে, দূরে কোথাও কাজের সন্ধানে যাচ্ছে, বৃষ্টির কমতি নেই, আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে, মাঠঘাট দিগন্ত কঁাপিয়ে, ট্রেন থেকে নেমে হরেন তার নিদির্ষ্ট গরুগাড়ির দেখা না পেয়ে হতবিহবল হয়, তারপর দেখে সঁাওতাল মজুরদের মধ্যে কম বয়সি কালো এক যুবতিকে, বেশ ডাগর-ডোগর, বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বুড়ো-বুড়িদের সঙ্গে গালগল্প হাসি মসকরা করতে-করতে হঁাটতে থাকে হরেনও, ওর দৃষ্টি চঞ্চলা হরিণীর দিকে, মেয়েটির বলিষ্ঠ ঋজু পেছনটি যেন সমস্ত দলটিকে সাপটে হস্তিনীর মতো দুলে-দুলে চলেছে, মেয়েটির হাসি মহুয়ার রসের নেশায় মাতাল করা, দৃষ্টি যেন তীরবাণ, হরেন নেশাগ্রস্ত হয়, যুবতির ছলাকলায়। সে ছুটে যায় মজুরদের সঙ্গে, শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে প্রতিনিয়ত। চূড়ান্ত প্রাকৃতিক দুযোর্গ আর শরীরিক দুবর্লতার জন্য এক সময় হরেন অচেতন হয়ে বৃষ্টিভেজা পথের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ভিজে শরীরের হাড় কেঁপে অচৈতন্য হয়েছে, বুড়ো বলে, হে ভগবান, ইয়ার জ্ঞান লাই যে গো! পরবতীর্ সময়ে দেখা যায়, সেই যুবতি কালো হস্তিনী মেয়েটি নগ্ন বুকের উত্তাপ দিয়ে তার চেতনা ফিরিয়ে আনে, সঁাওতাল একটি অপরিচিতা মজুর যুবতি কি এক স্বগীর্য় ভালোবাসায় বুকে টেনে বঁাচায় বিনা স্বাথের্, হরেনের মধ্যে যে উগ্র কামতা-যৌনসুখের আনন্দ ছিল, যা দেখে স্টেশন থেকে ওদের সঙ্গে এসেছে, তা যেন একনিমেষে অন্য এক ভালোবাসায় রূপায়িত হলো, মানুষের ভেতর মানুষ এভাবেই হয়তো কদাচিৎ ধরা দেয়, জেগে ওঠে এবং তখন সে নিজেকে শুধায়, আমি কে? কি আমার পরিচয়?
‘ আদাব’ বাংলাসাহিত্যের কালজয়ী একটা গল্প, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপরই ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্টে অবিভক্ত মুসলিম লীগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে’র ডাক দেয়, তারপর শুরু হয় হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ইতিহাসে যাকে বলে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা, ক্রমে তা সারা ভারতে ছড়িয়ে যায়, উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাস-ঘৃণা দ্বেষ-হিংসা আক্রোশ আর সন্দেহ প্রবলভাবে দেখা দেয়, ‘আদাব’ সেই পটভূমিতেই নিমির্ত, দা-সড়কি ছুরি-লাঠি যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে নিধনে উন্মক্ত, দাঙ্গাকারী মানুষ মুহূতের্ যেন সব জানোয়ারে রূপায়িত হয়েছে, আগুন-উল্লাস চারদিকে, মরণভয়ে শিশু-নারীর আত্মচিৎকার, কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা, এর মধ্যে দুজন শ্রমিকের পরিচয়, কেউ কাউকে চেনে না, একজন সুতাকলের মজুর আরেকজন নায়ের মাঝি, কাকতালীয়ভাবে দুজনের মধ্যে অবিশ্বাসের মধ্যে একটা মিলবন্ধন রচিত হয়, কারণ তারা দুজনই শ্রমিক, দিনমজুর, পরবতীর্ সময়ে নিজেদের পরিচয় বেরিয়ে এলেও ক্রমে তা সৌহাদর্্য আর স¤প্রীতি দেখতে পাওয়া যায়, কেউ কারো ক্ষতি করবে না এমন বিশ্বাস নিয়ে গল্পটি এগিয়ে যায়, মাঝি এক সময় পোলামেয়ে বউয়ের কাছে ফিরে যেতে চায়, কারণ আগামীকাল ঈদ, সুতাকলের শ্রমিক তাকে যেতে দিতে না চাইলেও আনন্দের পরব বলেই ছেড়ে দেয়, তারা দুজনে আদাব সম্ভাষণ করে, কিন্তু সুতাকল মজুরের বুক কষ্টে এবং উত্তেজনায় টনটন করে, ভয়ে আর অনুকম্পায় তার গলা ভরে ওঠে, তারপর মাঝি অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। সমরেশ বসু এ গল্পে সা¤প্রদায়িকতার চিত্র যেমন চিত্রায়িত করেছেন, তেমনি মানুষের ভেতর যে অন্ধকার, তার একটা দিক দেখিয়েছেন, গল্পের ছত্রেছত্রে মানুষেরই স¤প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন, প্রকৃতপক্ষে মানুষই মানুষের পরম আত্মীয়, মানবধমর্ বা মানবপ্রেম যা বলা হউক না কেন, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়, নয় কিছু মহীয়ান। এভাবেই গল্পে মানুষের জয়গান গেয়েছেন।
‘গুণিন’ গল্পে দেখি হরিমতিকে ফিরে পাওয়ার জন্য নকুড় গুণিন ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার রাত্রে ব্যানাহাটি ও পালদীঘি গঁায়ের সীমানায় যে গোরস্থান, বিবস্ত্র হয়ে সেখানে যায়, কোদালে কোপ দিয়ে মাংস লেগে থাকা একটা কংকাল তোলে, গল্পটি ভৌতিক হলেও রহস্যের ভেতর দিয়ে সমাপ্তি টেনেছেন গাল্পিক; পরদিন গুণিনের লাশ দীঘির জলে ভেসে ওঠে, সবাই দেখে অদূরে মাটি খেঁাড়া কবরের পাশে পড়ে আছে কোদাল, মানুষ বুঝলো ভূত-পেতনী চুবিয়ে মেরেছে, হরিমতি জলভরা চোখে চেয়ে বলল, গুণিন তুমি হরিমতির মন বুঝলে না, আমি যে এখনো সেই তোমার আছি এবং তোমাকে নিয়ে আবার বঁাচতে চেয়েছিলাম তাও জানলে না। গল্পের প্রথমাধের্ দেখা যায়, নকুড় একজন বেকার বাউন্ডেল ছেলে, কাজ-কামে মন নেই, ললিতের দিদি কান্ত খুড়োর মেয়ে হরিমতিকে ভালোবেসে ফেলে, কিন্তু আয়-রোজগার নেই, লোকে টিটকারি মারতো, মা ধিক্কার দিত, সেই নকুড় একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। দীঘর্কাল পরে আবার নিজ গঁায়ে ফিরে আসে নকুড়, কিন্তু সে গুণিন হয়ে এসেছে, কবরেজি চিকিৎসাও জানে, এসে দেখে তার হরিমতির বিয়ে হলেও বিধবা হয়ে বাপ-ভায়ের ঘাড়ে, তারপর শুরু হয় তাকে পাওয়ার আকাক্সক্ষা, কিন্তু হরিমতি নিজেকে সমাপর্ণ করে দিলেও বোঝে না নকুড় নারীর মন। অথার্ৎ যে হরিমতি একদিন প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই কিনা তার গুণিনত্ব বা অথের্র কাছে পরাজিত হয়ে নিজেকে মেলে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু গুণিন নকুড় ওইটুকু ইঙ্গিত বোঝেনি, যার কারণে অকালেই প্রাণ দিতে হলো।
নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীনদের গল্প লিখতে জুড়ি নেই সমরেশ বসুর, সমাজের পোড়খাওয়া মানুষগুলো গল্পে প্রাণ ফিরে পায় আবার মরে নতুন করে, বিভিন্ন ধরনের গল্পে বৈচিত্র্য এবং মনস্তত্ত¡বিন্দুতে বহু ধরনের স্তরভেদ আছে, ‘অকাল বৃষ্টি’ গল্পে দুজন পোড়খাওয়া মানুষ ভ‚তেশ হালদার এবং সিধু ডোমের কাহিনী কথা বলে উঠেছে, গল্পের প্লট গ্রাম্য একটা শ্মশানকে ঘিরে, ভ‚তেশ চিত্রগুপ্তের অবতার অথার্ৎ রেজিস্ট্রার, মাইল কয়েক এলাকার মৃত্যুর খতিয়ান তার হাতে, আর তারপরের কাজ সিধু ডোমের, সে মরা পোড়ায়, বিনিময়ে দুজনেই বকশিস পায়, দুজনে একই গঁায়ের মানুষ, তাই তাদের মধ্যে চমৎকার মিলও আছে, লোকে বলে, একজন ডোম আরেকজন বামুন। একদিন সিধু ডোম একটা মেয়ে মানুষ শ্মশানের ঘরে তোলে, ভূতেশ বলে, দেখিস ও কেটে পড়বে... আগেরটা পালিয়েছে আবার পালাবে...সিধু বলে, যাবে, একটা পালিয়েছে, আরেকটা নিয়ে আসলাম, যত পালাবে, তত আনব...ভূতেশবাবু ক্ষেপে গেলে একদিন সিধু বলে, তুমি শালা কি, অমন অন্সরীর মতো বউ, কন্দপর্কান্তি ছেলে তুমি ছেড়ে এলে... তখন ভূতেশ নিজের জীবনের গল্প জানায়, বিয়ের রাত্রে নতুন বউ বলে কিনা, মা গো মরা কাঠ, ভূতেশ বলে, তারপর জুতো খুলে বেধড়ক ঠ্যাঙালাম, তারপর আরেকদিন ওদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম, কাতিের্কর মতো ভগ্নিপতির বুকে মুখ গুঁজে বলছে, ওই রাক্ষসটার কাছে যদি পাঠাও তো গলায় দড়ি দেব! এভাবেই নিজেদের মধ্যে দুঃখ-কষ্টের গল্প বলে, তবে সিধুর বউটা বেশ দেখতে, কালো হলেও শক্তিসোমক্ত বেশ, হাসতেও পারে, গানও গাইতে পারে গলা ছেড়ে, ভূতেশের মন কখনো-সখনো বড় উদাস হয়ে যায়, কারণ তার চেহারা ভয়াবহ আবার নামটাও কেমন বিদঘুটে, হঠাৎ একদিন সিধু জানালো, কেটে পড়েছে ছুঁড়ি...অথার্ৎ সুলোচনা ওলাউঠায় বেদবাক্যি সত্যি করে একেবারে চলে গেছে, ভূতেশ নিবার্ক হয়ে যায়, এভাবে কেটে পড়বে, তা তো কখনো বলেনি সে। ওমন একটা তরতাজা মানুষ চলে গেল, ভাবতেই কষ্ট হয়, যে শুধু ভালোবেসে ভূতেশ-সিধুর মতো মানুষকে সহ্য করেছে, শ্মশানের মতো জায়গায় আনন্দে বসবাস করেছে, সে চলে গেল। সমরেশের গল্পে কাহিনী যতটুকু না থাকে, তার চেয়ে অধিক থাকে জীবনের কথা, মানুষের কথা, মানুষকে জানার প্রয়াস থেকেই গল্পরচনা, তাই তার গল্পে দেখি আধুনিক যুগের জটিল মানসিকতা, ফ্রয়েডীয় মনস্তত্তে¡র কুটিল প্রভাব।
সমরেশ বসুর গল্পের ভুবনটা একেবারে অন্য ধারার, প্রাচীন মূল্যবোধকে ধ্বংস করে ফেলার দানবীয় প্রবৃত্তি, বাস্তবতাকে মেনে নিতে না পারার দুঃখ-কষ্ট; যদিও তার গল্প চরিত্র প্রধান, একটা চরিত্রের ভেতর দিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রকে দেখে, ‘সোভাবাজারের শাইলক’ গল্পে এক সুদখোর শাইলকে দেখতে পায়, তার প্রকৃত রাবন হালদার, যে শালিক নামেও পরিচিত, জীবনের প্রথমাধের্ সে বঁাক কঁাধে করে গঙ্গাজল সরবরাহ করতো লোকের বাড়ি, পরবতীর্ সময়ে সে স্থানীয় হাইস্কুলে বেয়ারার কাজ জুটিয়ে নেয়, সুদে সে টাকা ঋণ দেয়, স্কুলের মাস্টার মশাই থেকে শোভাবাজারের নানান পেশার মানুষই হলো শাইলকের খাতক, সে টাকা দেয় সুদ নেয়, যারা সুদে টাকা নেয় এবং যারা নেয় না তারা কখনো ওকে দেখতে পারে না, পেছনে ঘৃণা করে, স্কুলে সে বেয়ারা হিসেবে কাজ করলেও মাস্টারদের ওপরেও ক্ষমতা দেখায়, কারণ সুদে টাকা যে তারাও নিয়েছে, শুধুমাত্র হেডমাস্টারের ওপর কোনো খবরদারি করতে পারে না, কারণ সে ঋণ নেয়নি ওর কাছ থেকে, একদিন দেখা যায় এই শাইলক, হাতিবাগান বাজারের কোনো এক তরকারীউলী বিধবা সুখদার ষোল বছরের মেয়ে ময়নার বিয়ের জন্য পঁাচশো টাকা দেয়, পাত্র শিয়ালদহ বাজারের দোকানদার, ময়নার বিয়ের দিন সিল্কের শাড়ি দেয়, অনেক অতিথি নিমন্ত্রিত হয়, শাইলকের অনেক চেনাজানা ফড়েকেও দেখা যায়, নিমন্ত্রণ খেয়ে ফিরবার পথে অন্ধকার খালের ধারে কারা যেন শাইলকের ওপর আক্রমণ করল, প্রচÐ মারল গালিগালাজ করে বলল, শালা এতদিনে বুঝেছি, কেন তুমি মাগীর পেছনে টাকা খাটাও, গরীবের টাকা মারো! গল্পে জীবনের অসাধারণ একটা অথের্ক দঁাড় করেছেন সাহিত্যিক, যার ভেতর দিয়ে মনুষ্যত্বকে দেখতে পাওয়া যায় স্পষ্টভাবে। মানুষ কখনো-সখনো ইচ্ছে করেই প্রকৃতির মতো দিলদরিয়া হয়ে যায়, হয়তো তা স্বভাবের বাইরে কিন্তু তারপরও নিজের তৃপ্তির জন্য যা করার তাই করে, করতে সে ভালোবাসে। তরকারীউলীকে ভালোবাসে বলেই তার মেয়ে ময়নার জন্য অথর্ব্যয় করতে কাপর্ণ্য করেনি। সমরেশের গল্পের কুশীলবরা শ্রমের স্বেদাত্ত সংগ্রামে অবতীণর্, অল্পপূঁজির দোকানদার-মজুর-কুলী-শ্মশান ডোম-বাউল-সন্ন্যাসী-বেশ্যা-জেলে-ভূমিহীন কৃষক-বেকার প্রভৃতি।
মনস্তাত্তি¡ক উপলব্ধি থেকেই ‘সোনাটর বাবু’ গল্পটি রচিত, দূবির্সহ জীবনযন্ত্রণার ভেতর দিয়ে মানুষ অতিবাহিত হয়, তখন তার মধ্যে কোনো ক্রিয়া কাজ করে না, সব যেন অকেজো হয়ে যায়, তারপরও মানুষ বঁাচে এবং বঁাচতে হয়, হয়তো সেই বেঁচে থাকাটাই বিড়ম্বনা, বিষ্টুপদ মিউনিসিপ্যালিটির কনসারভেন্সি সুপারভাইজার, ডোম-মেথর আর ধাঙড়াধাঙড়িদের নিয়েই কাজ এবং ফ্যালা ডোম, দুজনে চাকুরে, বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করে আর কি! উভয়ের সংসারে অনেক দারিদ্র্যতা-অভাব নিমজ্জিত, ১নং ওয়াের্ড বেওয়ারিশ কুকুর মারার দায়িত্ব পড়ে দুজনের ওপর, সারাদিনে বেশ কয়েকটি কুকুর মারে রসগোল্লায় বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে, এভাবেই কুকুর নিধন চলে, প্রাণী হত্যা করেই তাদের জীবিকানিভার্র, ওদিকে দুজনের ঘরেই স্ত্রীরা সন্তানসম্ভবা, জীবন-জীবিকার কারণে প্রাণী হত্যার খেলায় মেতে ওঠে তারা, গল্পে জীবনের যে সন্ধান দেখা যায়, সেখানে মনুষ্যত্ব জেগে উঠেছে, মূল টাগের্ট যে খেপী কুকুরটা তাকে এক সময় একটা ছেলে দেখিয়ে দেয়, তখন বিষ্টু এবং ফ্যালা ধাওয়া করে, তাকে বিষ মেশানো রসগোল্লা ছঁুড়ে দিলেও খায় না, শুধু দেঁৗড়ে ছুটে যায় দুধের বঁাট দুলিয়ে-দুলিয়ে, প্রায়ই নিখেঁাজ থাকে আবার দেখা দেয়, এক সময় মাদী কুকুরটাকে দেখতে পায়, পুষ্ট স্তনগুলোর ওপর ঝঁাপিয়ে পড়েছে কতোগুলো নধর তুলতুলে ছোট-ছোট বাচ্চা, ফ্যালা ডান্ডটা তুলতেই বিষ্টু নিষেধ করল, এভাবেই মানুষ নিজের মধ্যে নিজেকে দেখে, নিজেই পরাজয় মেনে নেয়, মানবিকতার কাছে হার মানা নাকি ফিরে আসা, সমরেশ বসুর গল্প বিশ্ব পরিক্রমা শেষে মনে হয়, এত গøানি-রিক্ততা ও অন্ধকার সত্তে¡ও জীবনের মতো রহস্যময় আর কিছুই নয়। আর বাস্তব বলতে সাধারণভাবে পরিচিত যে অভিজ্ঞতার বলয়, তার নিরেট ও একঘেয়ে উপস্থিত নিয়ে দেখা দেয়, দ্রষ্ঠাচক্ষু সম্পন্ন গল্পকারের কল্পনা প্রতিভা তারই মধ্যে আবিষ্কার করে একাধিক স্তর থেকে। মাটি ও মানুষ, অবলা প্রাণীর অজেয় এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তির ওপর অগাধ আস্থা পুনজর্ন্ম দান করে, সে সঙ্গে সম্ভাবনা নিমার্ণ করে নতুন জন্মের, নতুন উৎস নিমাের্ণর। সমরেশের ভাষা-শব্দাবলি নিয়ে সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যতখানি না ধরা পড়েছে, তার চেয়ে গল্পের শরীরে জীবনের ভাবমাধুযর্ ফুটে উঠেছে, তিনি জীবনের তলানিটুকু ছেঁকে নিংড়ে গল্পের মূল্যবোধে ও নৈতিকতায় প্রতিস্থাপিত করেছেন। জীবন ও জগৎকে দেখবার পাঠ নিতে গিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বসাহিত্যের বরেণ্য সাহিত্যিকদের তাবৎ লেখা খঁুটিয়ে খঁুটিয়ে পড়েছিলেন, তার মধ্যে গোকীর্র সাহিত্য তাকে সব চেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল, অন্তনিির্হত ভাবাদশের্র ক্ষেত্রে গোকীর্ বা রাশিয়ার অন্যান্য সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে তাকে উদ্বুদ্ধ করে, সমরেশ বসুর ক্ষেত্রেও দেখা যায়, দেশীয় বা বাংলাভাষী সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি, কমলকুমার মজুমদার-বুদ্ধদেব বসু-জগদ্বীশ গুপ্ত-কমলকুমার মজুমদার-সতীনাথ ভাদুরী বা তিন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতিমান সাহিত্যিকের কথাসাহিত্য বা প্রবন্ধসাহিত্য বিশেষ করে মাকসর্বাদী চিন্তাধারার রচনা পাঠের সুযোগ পেয়েছেন এককথা অনস্বীকাযর্। চেতনায় এবং আঙ্গিকে নিজস্ব বলয়ে থেকে মনে হয়েছে, কোথায় একটা গন্ধ, কোথায় সে প্রকরণে গ্রামীণ জীবনের ডিটেইলস’এ মিশে যেতে আপন অস্তিত্বে-শিল্পবোধে-চেতনায় উদ্ভাসিত হয়েছে তার গল্প। মূলত সমরেশ বসু বাংলাসাহিত্যের পাশাপাশি প্রাচ্য ও পাশ্চ্যাত্যের মিলবন্ধন ঘটিয়েছেন সাহিত্যের সঙ্গে, যেহেতু রাশিয়া-ইউরোপীয় এবং ল্যাতিন অ্যামিরিকার সাহিত্য পাঠের অবাধ সুযোগ অজর্ন, যথেষ্ট সুনাম ঈষৎণীয় অবস্থানে পেঁৗছে দিয়েছে বলা অপেক্ষা রাখে না।