শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্তিকালগ্ন মানুষের কবি আমিনুল ইসলাম

ড. মুহাম্মদ জমির হোসেন
  ২১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মাটি ও মানুষকে স্বীকরণ করেই কবি প্রতিভার রসস্ফ‚তির্ সম্ভবপর হয়ে ওঠে। কোনো রকম বিছিন্ন-বিভক্তি এ ব্যাপারে মারাত্মক অন্তরায় বটে। অথবা কোনো রকম অভিসন্ধি মতবাদ বা হীনতম প্রবৃত্তি কবি প্রাণতার শক্র হিসেবে চিহ্নিত। মূলত একটা সবার্নুগ দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, যা সাবর্জনীন রূপাবয়ব নিয়ে সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ পায়। এমনিতেই কাব্যশিল্প ব্যক্তিক অনুভবের পাখায় ভর করে সাবর্জনীন চৈতন্যস্তরে উত্তীণর্ হয়ে থাকে। এর মধ্যে কোনো জাতপাত সম্প্রদায় বিশেষ বা ভৌগোলিক সীমারেখা স্বীকৃত নয়। বিশ্বমানবতার সুষম পথ বেয়ে তা যুগন্ধর মহিমা অজর্ন করে থাকে। এক অভিন্ন আত্মার পরিমÐল ঘিরে এই কাব্যসৃষ্টি অনুরণিত হয়। এর পেছনে রয়েছে সবিশেষ জীবনবোধ, অধীত জ্ঞানাজর্ন, পারিবারিক আবহ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সংসৃতিÑ ইত্যকার অনুষঙ্গ উপাদান। এর ফলেই ব্যক্তিচরিত্র একটা সবিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে ওঠে। নিবিড় অনুধ্যান অনুশীলন সাধনসিদ্ধির সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

কবিতার জন্য দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সৃষ্টি, সংস্কৃতি, সমাজ, ধম,র্ শাস্ত্র-সংবিধান-প্রায় সবকিছুই প্রয়োজন। তবেই কবিতা হবে জনমনপরিসিক্ত শিল্পমাধ্যম। এখন এর মধ্য দিয়ে কবির জীবনাকাক্সক্ষা একটা পূণর্তার পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। তা ছাড়া কবিতার বেলায় নিসগর্-প্রকৃতির সান্নিধ্য-সহযোগ অপরিহাযর্। এর মধ্য দিয়ে মননচৈতন্যে একটা আধ্যাত্মিক-অনুভব পল্লবিত হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়ে ¯্রষ্টা, সৃষ্টি ও মানবতার মধ্যে একটা মেলবন্ধন রচিত হয়। এ অবস্থার মধ্য দিয়েই কবিতা শাশ্বত মহিমা অজর্ন করে থাকে।

এসব আলোচনার প্রেক্ষাপটে কবি আমিনুল ইসলামের ব্যক্তিসত্তা ও কবিসত্তার কাব্যসমূহ বিচাযর্। আমিনুল ইসালাম উচ্চশিক্ষা, পরিশ্রæত রুচিবোধ, সমুন্নত মননশীলতা—-সবিশেষ জীবনবোধ ও মাজির্ত সংস্কৃতির অধিকারী। গভীর জ্ঞানানুশীলন ও অন্তগর্ত জীবনবীক্ষা সবসময় তাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। পেশাগত জীবনেও কবি আমিনুল ইসলাম সবকারের প্রায় সবোর্চ্চ পদে অধিষ্ঠিত আছেন। এ সুবাদে তিনি দেশ-বিদেশের নানান জীবনবোধ সম্পকের্ অবহিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। নানা শ্রেণিপেশার মানুষের কাছাকাছি আসার একটা সুযোগ ঘটে। এমনিতেই আমিনুল ইসলাম ভ্রমণপিপাসু চিত্তবৃত্তির অধিকারী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তঁার অধীত বিদ্যাশিক্ষা ও অপরিসীম জীবনবোধ। যা তাকে কবি অভিধায় চিহ্নিত করতে সহায়তা করেছে। তিনি সীমাহীন কৌত‚হল নিয়ে দেশ-বিদেশের প্রতœতাত্তি¡ক নিদশর্নসমূহ পযের্বক্ষণ করেন। ঐতিহাসিক স্থানসমূহ পরিদশর্ন করে এর সঙ্গে ঐতিহ্যের যোগাসাজশ আবিষ্কারের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হন। এ পযাের্য় কবি ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিপযর্য়কর অবস্থাদৃষ্টে ব্যথিত হয়ে ওঠেন।

কবি আমিনুল ইসলাম মৃত্তিকামূলের কবি। তিনি বাংলার বৃক্ষ-নদী, ফল-ফুল,আকাশ-বাতাস, ঋতু-প্রকৃতি কবিতার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তার কবিসত্তা ও বাঙালির জাতিসত্তা প্রায় একাকার হয়ে ধরা পড়েছে। আমরা যেন কবি, আমিনুল ইসলামের কবিতার মধ্যে দিয়ে বারবার এবং অবিরাম নিজেকে খঁুজে পাই। অস্তিত্বগত শেকড় সন্ধানের এই প্রবৃত্তি কবিদের প্রধান ও মহত্তম ধমর্। ঐতিহ্যভ্রষ্ট জাতির জীবন তা পুনরুজ্জীবনের অমিয় মন্ত্র হিসেবে কাজ করে। যা আমাদের ব্যক্তিগত সমাজজীবনে বারবার প্রয়োজন। কবি আমিনুল ইসলাম এই শুদ্ধতম দায়িত্বটি পালন করেছেন। এ সুবাদে তিনি বাংলা ও বাঙালির কবি প্রতিনিধি হয়ে বেঁচে থাকবেন।

কবি আমিনুল ইসলামের কাব্যিকতা বরাবরই স্বতঃপ্রবৃত্ত উচ্চারণে মুখর। তার কবিতায় ঘুরেফিরে বারবারই নদীর কথা এসেছে। যা আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। আমিনুল ইসলামের কাব্যিক অভিব্যঞ্জনাও ¯্রােতস্বিনী নদীর মতো প্রবহমান রয়েছে। যা স্বতঃস্ফূতর্ প্রণোদনায় ভাস্বর। যুগে যুগে পৃথিবীবিখ্যাত কবিদের মধ্যেও অনুরূপ ভাবপ্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কবি বাল্মীকি কালিদাস, চÐীদাস, ভারতচন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ কবিদের বেলায় অনুরূপ প্রবণতা লক্ষণীয়। কবি-দাশির্নক প্লেটো-এরিস্টটলও এ ব্যাপারে স্বকীয় অবস্থান তুলে ধরেন। মূলত কবিত্ব হচ্ছে সহজাত প্রবৃত্তির স্বতঃপ্রণোদিত সুষমাময় উচ্চারণ। এরই আলোকে আমিনুল ইসলামকে কবি হিসেবে অভিষিক্ত করতে কোনো কাপর্ণ্য নেই। তার কবিতাসমূহ একবার পড়া শুরু করলে তা ভাবতন্ময়তার জগতে নিয়ে যায়। সেখানে আমার অস্তিত্বগত উপাদানের পুষ্পকুমুদ একে একে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। আমি যেন আমার ঐতিহ্যিক অনুভবের নান্দনিক অধিকারকে ফিরে পাই । অন্তত এ অথের্ আমিনুল ইসলাম বাংলা কাব্যধারায় একটা স্বমহিম অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

আমিনুল ইসলাম মূলত প্রেমের কবি। পৃথিবীর সব বড় কবিদের অন্বিত-অনুষঙ্গও প্রেম। তবে তা বণর্বহুল ভাষারূপে প্রকাশিত হয়। আমিনুল ইসলামের প্রেম মূলত সবার্নুগ মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। সমাজের যতসব অনাচার অনাসৃষ্টি দশের্ন তিনি বিদ্রোহী প্রেমিকচিত্ত হিসেবে আবিভূর্ত হন। আসলে প্রেম কি কেন এবং কোথায় প্রযুক্ত হতে পারে তাই তিনি উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং সবকিছু ছাপিয়ে প্রেমের একটা সুষম সুন্দর স্বপ্নময় পৃথিবী গড়ার প্রতয় ব্যক্ত করেন। তার অজ¯্র কবিতার ভঁাজে ভঁাজে অনুরূপ ভাবপ্রবণতা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। আমরা এই কবি ও কবির সুমহান কাব্যিক অভিব্যঞ্জনার প্রতি সুদীপ্ত শ্রদ্ধাবোধ নিবেদন করছি।

কবিগণ মূলত কেমন প্রকৃতির অধিকারী? সমাজ সংসারের অন্যসব ব্যক্তির চেয়ে এরা কি ভিন্ন? অথার্ৎ, কবির ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে বরাবরই পাঠক সমাজের একটা কৌত‚হল থাকে। কেমন করে কি উপায়ে কবিরা কাব্যিকতার পালে হাওয়া লাগিয়ে ভেসে বেড়ান। এ নিয়ে কৌত‚হলের কোনো সীমা নেই। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণাও হচ্ছে। অনেকে আবার এর মধ্যে অলৌকিকত্ব জুড়ে দেন। যা প্রাচীনতম কাল থেকেই আমাদের ধারণার একটা বদ্ধমূল অংশ হিসেবে চিহ্নিত। তবে যতকিছুই বলা হোক, কবিরা এ সমাজেরই অন্য দশ-বিশটা মানুষের মতো জীবনযাপন সম্পন্ন করে থাকেন। তাদের আমরা খুব কাছ থেকেই পযের্বক্ষণ করার সুযোগ পাই। বরং বলতে গেলে কবিদের সাহচযর্-সান্নিধ্য আরো বেশি আন্তরিক ও জীবনঘনিষ্ঠ। ফলে এ অবস্থায় তাদের সবিশেষ জীবনদৃষ্টি আমাদের কাছে ধরা পড়তে বাধ্য। কারণ দেশ ও জাতির প্রতি একপ্রকার দায়বোধ ও প্রতিশ্রæতি সবসময় কবির আত্মাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে এর মধ্যে তাদের চিন্তাচেতনায় কিছু প্রবৃত্তগত প্রাণনা নিবিড়ভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন, স্বপ্ন, কল্পনা, আবেগ, শুদ্ধতা, সবলতা, মূল্যবোধ, দায়িত্ব-কতর্ব্য, ঔচিত্যবোধ, নৈতিকতা, দেশাত্মবোধ ইত্যাকার মানবিক প্রবৃত্তি কবিচিত্তকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। এর ফলেই সৃজনমুখর লেখক নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। আর যাবতীয় সৃজনশীলতার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে কাব্যিকতার অবস্থান। আর কবিরা হলেন এই কাব্যযজ্ঞের রাজপুরোহিত। তা ছাড়া অন্যসব সৃষ্টিচৈতন্যের মূলেও কাব্যিকতার সমূল অবস্থান প্রোথিত রয়েছে। তা ছাড়া এই কাব্যকতার সঙ্গে একটা আধ্যাত্মিক যোগসূত্র নিবিড় সাজুয্য রক্ষা করে চলে। মূলত আত্মিক সম্পকের্র নিগূঢ় পথ বেয়ে আধ্যাত্মিকতার জয়যাত্রা সূচিত হয়। কবিতা এই আধ্যাত্মবোধের সৃষ্টিফসল হিসেবে কীতির্ত। শত-সহ¯্র বছরŸ্যাপী প্লেটো এরিস্টেটল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি প্রায় সবাই কবিতার অধ্যাত্ম-অনুষঙ্গ স্বীকার করে নিয়েছেন। পৃথিবীখ্যাত সব কবিদের কবিতা পড়েই তা অনুধাবন করা সম্ভব।

কবি আমিনুল ইসলামের কবিতায় অনুরূপ ভাবপ্রবণ চিত্তচেতনার রূপকল্প অনুভূত হতে দেখা যায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে একজন কবি দেশ ও জাতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে আবিভূর্ত হন। একেবারে সবকিছুই তার সৃজনমুখর লেখনীর মধ্যে খেলা করে—- একেবারে সমূল সংসৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি যেখানে জায়গা করে নেয়। এ প্রসঙ্গে তার অজ¯্র কবিতা উদ্ধৃত করা সম্ভব। কবির কবিতা ও দেশমৃত্তিকা একাকার রূপে ধরা পড়ে। কবি যেন এ দেশের অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে সবকিছুর সঙ্গে মিশে আছে। এর মধ্য দিয়ে কবির দেশত্মবোধ নিবিড়ভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। পাশাপাশি যতসব অনাচার অসঙ্গতি ও সামাজিক অবক্ষয়ের চালচিত্র অভিব্যঞ্জিত হতে দেখা যায়।

কবিগণ ত্রিকালদশীর্। ভূত, ভবিষ্যৎ বতর্মান তাদের নখদপের্ণ প্রতিফলিত হয়। তাদের মধ্য দিয়ে দেশ-জাতির পরিচয় নিণীর্ত হয়ে থাকে। দেশের আকাশ বাতাস, নদী-পাহাড়, ফল-ফুল, বৃক্ষ-প্রকৃতি, সাগর-বনানী ভাষা খঁুজে পায়। এর মধ্য দিয়ে আমরাও আমাদের স্বত্ব,পরিচয়, খুঁজে পেতে সক্ষম হই। আমিনুল ইসলাম সেই প্রকৃতির কবি। তার যে কোনো একটি কবিতা পাঠ করেই অনুরূপ উপলব্ধির প্রমাণ করা সম্ভব। সবোর্পরি, আমিনুল ইসলাম বাংলা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধের নান্দনিক প্রতিভূ হিসেবে সমাদৃত হওয়ার যোগ্য। তার শত-সহ¯্র কবিতার ভঁাজে ভঁাজে এ দেশের অন্তগর্ত চিত্র-চারিত্র্য নিবিড়ভাবে ব্যাপ্ত হয়ে আছে। এখানেই তার কবি হিসেবে সাফল্য। বিশেষত, দেশ-মাতৃকার প্রাণমূলের সঙ্গে তা গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে। আমরা তার এই মহত্তম কাব্যপ্রয়াসের পারম্পাযির্নষ্ঠ-সমৃদ্ধি কামনা করছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<28043 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1