বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কান্না

শওকত নূর
  ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

যখনই দৃষ্টি সীমায় আসে, দেখি লোকটি কঁাদে। শুধুই কঁাদে। কঁাদে বলতে ঠেঁাট চেপে মুখাবয়বে কারুণ্য ফুটিয়ে নীরব অশ্রæ বিসজের্ন নয়। সে কঁাদে রীতিমত দুহাতে বুক চাপড়ে, মুখ হা-করে, উ-হু-হু ধরনের উৎকট শব্দ করে করে। প্রায় আমি তার এ কান্না নিয়ে খুব ব্যথিত বা কৌত‚হলী হই। মনে মনে এ যেন হৃদয় বিদীণর্কারী কান্নার কারণ জানতে মরিয়া হই। কিন্তু আশপাশের কাউকেই যেহেতু এ বিষয়ে ন্যূনতম বিচলিত হতে কিংবা টু’ শব্দটি করতে দেখি না, আমার অদৃশ্য কৌত‚হল উৎকণ্ঠা অদৃশ্যলোকেই চাপা পড়ে যায়। লোকটি আমাকে অতিক্রম করে যাওয়া মাত্রই তাই যথারীতি কাজে মনোনিবেশ করি। আনমনে মন থেকে মুছে ফেলার প্রয়াস করি ওই সব হৃদ-সঞ্চালক বিষয়াদি। ভুলে যাওয়াই মানুষের ধমর্; তাই কসরৎ সাপেক্ষে তাতে ক্ষণিক সফলও হই।

আমি শহরের এক মুদি দোকানের কমর্চারী, একমাত্র বিক্রেতা তথা দোকানরক্ষক। শহরের অন্যতম গুরুত্বপূণর্ সড়কে দোকানের অবস্থিতি। দোকানের ঝঁাপ তুলে বেচা-বিক্রির উদ্দেশ্যে মেঝেতে দঁাড়ালেই সম্মুখ পথটিতে নিত্য চোখ চলে যায়। ভোরবেলা দোকান খুলে ঘড়িতে দম দিয়ে দঁাড়ালেই দেখি কথিত লোকটি একই ভঙ্গিমায় কেঁদেকেটে আশপাশের বাতাসকে ভারি করে দিয়ে মানুষের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। একই দৃশ্য চোখে পড়ে প্রতি রাতে যখন বেচা-বিক্রি সাঙ্গ করে ঘরে ফিরতে যাব তখন। লোকটাও হয়তো তখন ফেরে। ঠিক একই ভঙ্গিমায় আকাশ বাতাস আরও বেশি ভারি করে ফেরে। আমি সারাদিনের ক্লান্ত অবসন্ন। মনে খুব ঘোর লেগে যায়। ঘোর নিয়ে ঘরে ফিরি, খাই, ঘুমাই। পরবতীর্ ভোরে একই ঘোরকে নতুন করে বরণ করি।

লোকটার বয়স পঁয়তাল্লিশ কিংবা তদূধ্বর্। উচ্চতা বেশ, গড়ন ছিপছিপে, গায়ের রং উজ্জ্বল ফসার্, মাথার চুল দেখার মতো ছোট, পরনের পোশাক অনাড়ম্বর আটপৌড়ে। তার চলার গতি ধীর এবং সমবেগসম্পন্ন। রাতে দোকানের ঝঁাপ ফেলে যখন বার তালায় চাবি দেই তখন সে মেইন পথ পেরিয়ে উপপথ ধরে ধীরে অদৃশ্য হয়। শুনতে থাকা কান্নাটা আচমকা অশ্রæত হয়। ভাবি, হয়তো উপপথের অনতিদূরেই তার বাস। আগেই বলেছি, তার রেখে যাওয়া কান্নার ঘোরে ফিরতি পথ চলা থেকে শুরু করে ঘুম নাগাদ অবতীণর্ হই-অভিন্ন পরিক্রমায় দিন রাত্রি চলে। কিন্তু এক ভোরে দোকানে উপস্থিত হওয়ার পর খানিকটা ব্যতিক্রম সূচিত হয়।

আগের রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি, তইি সেদিন মাথায় কী হলো তাকে দেখে খুব ব্যগ্র হয়ে উঠি। দোকান থেকে দৌড়ে বেরিয়ে রীতিমত তার পথ আগলে দঁাড়াই। এত দিন মনের ভেতরে দলামুচড়ে চলা প্রশ্নগুলোকে একে একে দ্রæত ঝারি। ফল বিস্ময়কর। কেন প্রতিদিন কঁাদেন, কী এমন বিয়োগান্তক বিষয় যে তার প্রতিকার হয় না, কেঁদেকেটে কোথায় যান, কোথায় ফেরেন এ জাতীয় যতশত প্রশ্নই তাকে করি, সে প্রতি প্রশ্নে সেই একই উ-হু-হু কান্না শব্দে প্রতিক্রিয়া জানায়। আমি ভগ্নমোনরথ হই। তার পথ ছেড়ে দঁাড়াই। পরম দুঃখের সঙ্গে বিস্ময়েরও ব্যাপার এই যে এবারও আমি লোকটির ভ‚মিকা বিষয়ে কাউকে কোন ভ্রƒক্ষেপে মাততে দেখি না। যা হয়েছে তাই যেন স্বাভাবিক। লোকটির কাছ থেকে এমনটিই যেন স্বাভাবিক প্রত্যাশিত। সে কঁাদার মানুষ কঁাদছে, কঁাদবে অনন্তকাল, তাতে কার কী যায় আসেÑ এই হচ্ছে অব্যক্ত মনোভাব। ফলে ভাবি, বেহুদা এতটা উৎকণ্ঠা ঝারতে যাওয়া আমারই বোধ করি ভুল। তাই উৎকণ্ঠা ঝারব না আর। অন্যদের মতোই বোবা কালা হয়ে থাকব। ভাবনা অনুসৃত পথে মাস ছয়েকের মতো থাকিও তাই। কিন্তু হঠাৎ এক রাতে সারাদিনের কমর্ক্লান্তিতে আমার মাথায় কী এক নাছোর পোকার আবিভার্ব হলো যে, আমি নতুন করে লোকটা সম্পকির্ত রহস্য উদঘাটনে দুনির্বার উদগ্রীব হয়ে উঠি।

দিনের বেচা-বিক্রি বন্ধ করে হিসাবের খাতায় ইতিটেনে স্বস্তির দম ফেলছি। লোকটি দৈনন্দিন ধারায় তার ফিরতি কান্নার সুর উড়িয়ে দোকান অতিক্রম করেছে মাত্র। আমি ত্বরিত দোকানের ঝঁাপ ফেলে তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকাই। দেখি সে অব্যাহত কান্নায় মেইন রোড ছেড়ে উপপথে পা তুলছে। আচম্বিত কেন জানি মনে হলো ওই তাকে অনুসরণের পরম এবং চরম সুযোগটি যায়। ও সুযোগ বুঝিবা হেলায় হারাবার নয়। প্রায় লাফের মতো করে নেমে যাই পথে। খুব দ্রæত পা চালাই। অকস্মাৎ লোডশেডিং নামে। দেখতে পাই অন্ধকারে ওই তো লোকটি যায়! ছায়ামূতির্র মতো দ্রæত বেগে কোথায় সে হাওয়া হতে যায়? উপপথ পেরিয়ে সে শহর শেষের কঁাচাসড়ক ধরে। ওদিকে এক পড়ো ভবন আছে। চোখের নিমিষে তাতেই সে হাওয়া হলো। এদিকে মেইন সড়কে বিদ্যুৎ ফিরে আসে। আমি ইতস্তত দঁাড়াই।

লোকটি যে পড়ো ভবনে অদৃশ্য হয় সেটি আমার দীঘর্ দিনের চেনা। ব্রিটিশ শাসনামলেরও প্রারম্ভে গড়া এক ভবন। এতটা পুরনো, জরাজীণর্ যে কোনো কাজেরই আর উপযুক্ত কিংবা সংস্কারযোগ্য নয় বিধায় পড়ো। আমি এর অতীত ইতিহাস যেমন জানি, তেমনি জানি এর বতর্মান দশা সম্পকের্ও। এর আশপাশে ঘুরে এটুকু আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি যে এতে গমনাগমনের জন্য রয়েছে একটি গোপন পথ, যেটি এর নিমার্তা মালিক কতৃর্ক ব্যবহৃত হতো। পথটিতে কখনো ঢুঁ দেয়ার চিন্তা মাথায় না এলেও এর নিশানাটা আমার জানা। তাই কাল বিলম্ব না করে এর বহিঃমুখের প্রাচীন ক্ষয়ে যাওয়া ঢাকনা সরিয়ে মোবাইল জ্বেলে ঢুকে যাই পথে। কিছুক্ষণের প্রচেষ্টায় আমি পথ অতিক্রম করে বাড়ির ভেতর সীমানায় নিজেকে হাজির করি। আমার সম্মুখে একটি মাঝারি উচ্চতার ঝোপ, যা আমাকে সাহায্য করে নিজেকে আড়াল রেখে চারদিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি বোলাতে। হ্যঁা, বিশেষ প্রচেষ্টা ও কৌশলে আমি ভবনটার ভেতর আঙিনা দেখতে পাই। ফুটবল খেলার মাঠের মতো, তবে ডিম্বাকার এক মাঠ হচ্ছে এ জীণর্ তথা পড়োবাড়ির আঙিনা। এতক্ষণ ধরে আমার কানে সমবেত কান্নার সুর এসে আঘাত হানছিল। সেই সঙ্গে এতক্ষণে ভীষণ চমকিত হই মাঝ মাঠের বিস্ময়কর এক দৃশ্য দেখে। আবছায়ার মতো অন্ধকারে সেখানে গোলাকারে বসে আছে একদল কারা। তাদের থেকেই ভেসে আসছে কান্নার রোল। ওই লোকটির মতো সুরে দশ-বার জন মিলে একত্রে উচ্চস্বরে বিলাপ করলে কানে যেমনটি বাজার কথা তেমনটিই বেজে চলেছে অবিরাম। আমি দৃষ্টি ধরে এক এক করে গুনে দেখি সংখ্যায় তারা ঠিক বার জনই।

এবারে আমি ঝোপের আড়ালে দৃঢ় আসন করে বসি। কারণ, এখানে হাজির হয়েই যা দেখছি তা ভীতিপ্রদ হলেও রীতিমত বিস্ময়কর ও কৌত‚হলোদ্দীপক। গভীর মনোযোগে কান্নার শব্দ শোনার ফঁাকে কিছুক্ষণের মধ্যে কী ভেবে আমি ভবনের চার দেয়াল নিংড়ে আলগোছে আমার দৃষ্টি উগরে দেই ওপরে। ভীষণ অবাক হই। শহরের সঙ্গে এ ভবনের যে অবস্থিতি দূরত্ব তাতে এখান থেকে শহরের আলো দেখা যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনো আলো নেই। শহরের সুউচ্চ ভবন, পানির ট্যাংকি, মোবাইল টাওয়ার বা স্টেডিয়ামের বাতি কিছুই চোখে পড়ে না। যেদিকে তাকাই শুধু ধূসর অন্ধকার। যেখানে অবস্থান করছি তা যেন বিচ্ছিন্ন কোনো স্থান। নগর কেন, জগতের কোনো কিছুর সঙ্গেই যেন এর কোনো সংস্রব নেই। খাড়া ওপরে মুখ তুলে যে আকাশ চোখে পড়ে তাতে আপাদমস্তক বেশ ঝঁাকুনি খেয়ে যায়। এমন অচেনা আকাশ যেন এই প্রথমবার চোখে পড়ছে। দূরের ওই নক্ষত্র বীথি, ওই গ্যালাক্সি, ভেনাস, মারস-মাকাির্র আর চারধারের নভোদেয়ালের অদ্ভুত অসম সব আকার অবয়ব আবহের সঙ্গে এই আকস্মিক পরিচয় যেন শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, জীবনের শ্রেষ্ঠতম বিস্ময়েরও।

মাঝমাঠে হঠাৎ কান্নার রোল তীব্রতর হলে ঊধ্বর্ থেকে মুখ নামাই। আবারো দৃষ্টি দেই সেদিকে। এবারে ভিন্নতর এক দৃশ্য নজরে আসে। ওদিকে দৃষ্টি ধরতেই সমবেতদের একজন ত্বরিত উঠে দঁাড়ায়। হ্যঁা, এ সম্ভবত সেই লোকটি, দীঘর্ দিন ধরে আমি যার কান্নারহস্য উদঘাটনে মরিয়া হয়েছি এবং শেষ অবধি তাকে অনুসরণ করে আজ এখানে আবিভ‚র্ত হয়েছি। অন্ধকারে হলেও আমি নিশ্চিত, সে-ই লোকটিই হবে সে। পরম বিস্ময়ে দেখছি কী এক অত্যাশ্চযর্র্ আলোয় চোখের নিমিষে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সে। তৎক্ষণাৎ তার নড়ন্ত ঠেঁাট থেকে অবিকল টিভি স্ক্রিনে বাজতে থাকা সংবাদ ভাষ্যের মতো ঘোষিত হলো এই বাতার্:

ভ‚মধ্যসাগরে জাহাজ ডুবি। নাবিক ক্রুসহ নারী-পুরুষ শিশু মিলে সাতশ আরোহীর সলিল সমাধি।

মুহ‚তের্ দÐায়মানের তামাম শরীরটি ভিন্ন আলোয় প্রজ্বলিত হয়ে তাতে উদ্ভাসিত হতে লাগল তামাম বিশ্বের নানা খÐচিত্র : অফিস, ঘরবাড়ি, পথঘাট, নৌ-পথ, রেলপথ, সড়কপথ, হাটবাজার, দোকান, স্টেশন, বন্দর, হোটেল, রেস্তোরঁা, চায়ের স্টল, আদালত, পালাের্মন্ট, উদ্যান, ডাকবাংলো, গিরিপথ প্রভৃতি। মানুষেরা : অতি সাধারণ থেকে অত্যুচচ-প্রত্যেকে যার যার কাজে ব্যতিব্যস্ত, নিলির্প্ত। স্ক্রিনবৎ শরীরটি স্বচ্ছ ফঁাকা হয়ে এলে দÐায়মান ধুপ করে বসে যায়। সমবেতদের মধ্য থেকে কেউ বলে ওঠে: এই যে এক মহামমাির্ন্তক খবর বিশ্বজুড়ে বয়ে গেল। বিশ্বজনীন হয়ে কাউকে কঁাদতে দেখা গেল কি? এক ফেঁাটা অশ্রæ বিসজর্ন? সমবেতদের মধ্য থেকে উচ্চরব উঠল : না-না-না। কেউ সেসবে নেই; তাই আমরা আছি। উ-হু-হু-উ............। কেউ কঁাদে না, তাই আমরা কঁাদি। উ-হু-হু।

সমবেত কান্না সেই নিভৃতকোণকে প্রকটভাবে ভারি করে তুলল। তবে খুব বেশি সময় ধরে চলল না তা। অকস্মাৎ থেমে গেল। তখন নতুন এক মূতির্র দÐায়মান দশা হলো। সেও ছিপছিপে দীঘর্, গায়ের রং বোধকরি কুচকুচে কালো, মাথার চুল নিশ্চয়ই ঝঁাকড়া কেঁাকড়ানো। তার কণ্ঠ থেকে একই রূপ আবহ ধারায় বেরোল, দুভির্ক্ষ করালগ্রাসে দুশ শিশুর অকাল প্রয়াণ।

কণ্ঠ নিবৃত্তিতে এ লোকটারও দেহ জুড়ে একই রূপ আলোক প্রভায় একই রূপ বিশ্বচিত্রসমূহ প্রস্ফুটিত হতে লাগল। সে সব দৃশ্যে আবারও বিশ্ব মানুষেরা, সাধারণ থেকে উঁচুস্তর-প্রত্যেকে এইরূপ কমর্ব্যস্ততায় লিপ্ত, একই রূপ আবেগনিলির্প্ত। শীঘ্র দৃশ্যপটগুলো একে একে নিভে গেলে এ লোকটিও পূবর্ৎ লোকটির মতো বসে গেল। এবারেও সমবেতদের মধ্য থেকে সেই একই প্রশ্নের উত্থাপন ঘটল: এই যে এক পরম মমাির্ন্তক বাতার্ আমাদের যত স্বগীর্য় পুষ্প মঞ্জরিদের প্রাণপাতের কথা বলে গেল। তাতে বিশ্ব সাধারণের হয়ে কারো নেত্রকোণ সিক্ত কিংবা কারও কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হলো কি?

উত্তরে সমবেত কণ্ঠে একই রব উঠল: না-না-না। কারো নেত্রকোণ লোনা হয় না, তাই আমাদের হয়। কারো কণ্ঠ বাষ্পিত হয় না। তাই আমাদের হয়। উ-হু-হু........।

এবারে তৃতীয় ব্যক্তির উত্থান মাত্রই নজরে এলো পূবর্বতীর্ দুই ব্যক্তির চেয়ে আকারে তার বেশ একটু ছোট হওয়ার বিষয়টি। তার ক্ষেত্রে শ্রæত ভাষ্যটি হচ্ছে: আরাকানে অগণিত গণকবরের সন্ধান, পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি, জনপদ, আশ্রয়হীন অগণিত নারী শিশুর অসহায় আতর্নাদে ভারি সীমান্তের আকাশ বাতাস। এবারো একইভাবে একই রূপ বিশ্বচিত্রগুলো ফুটে উঠতে লাগলো। লোকটি নিভে যাওয়া তথা বসে যাওয়া মাত্র উত্থিত হলো সেই একই প্রশ্ন! প্রতিউত্তরে এলো সেই একই জবাব ও কান্নার রোল।

কান্না নিভলে সমবেত অবশিষ্ট ব্যক্তিদের একে একে দÐায়মান হওয়ার সঙ্গে যেসব মমর্ন্তুদ বাতার্ভাষ্য ঘোষিত হতে থাকে তাদের মধ্যে উল্লেখ্য হারে থাকে বিভিন্ন দেশ, জনপদে, নগরে, বন্দরে আত্মঘাতীসহ নানা আঙ্গিকে বোমা বিস্ফোরণ, শেল মটার্র নিক্ষেপণ, ব্রাশফায়ারসহ নানা মনুষ্যসৃষ্ট দুযোের্গ অগুনতি নারী শিশুর প্রাণপাত। সঙ্গে থাকে বিচ্ছিন্ন বিছিন্ন কলহ, যুদ্ধ, খুন, ধষর্ণ, লুটতরাজ, রাহাজানিতে নিরীহ সাধারণের প্রাণপাত। বিশ্বচিত্রগুলো প্রতিবার একইরূপ উদ্ভাসিতের সঙ্গে থাকে সাধারণ থেকে সমসাময়িক বিশ্ব নেতৃবৃন্দ পযর্ন্ত একইরূপ ব্যস্ততম তথা নিলির্প্ত দিনাতিপাত চিত্র; থাকে সাবেক বিশ্ববরেণ্যগণের নিলির্প্ত দিনাতিপাত চিত্রও। প্রতি ভাষ্য শেষে সেই অভিন্ন প্রশ্নবাণ, সেই অভিন্ন কান্নার রোলÑ উ-হু-হু।

একে একে বারটি সম্মোহনকারী বুলেটিনের পর যখন কান্নার রোলে আকস্মিক ছেদ পড়ে তখন হকচকিয়ে ভাবি সেদিনের মতো ওখান থেকে উঠে যাওয়াই বোধকরি শ্রেয়। সম্মোহিতের মতো উঠে দঁাড়াই। ইতস্তত সে গোপন পথটির মুখে পা বাড়াই। তখনই পেছনের সমাবেশটি কী এক গুঞ্জরণে সরব হয়ে ওঠে। প্রায় দৈবস্বরের মতো কথাগুলো কানে এসে ওঠে:

মজলুম যত বিশ্ব সাধারণ থাকে, তাদের জন্য বিশ্ব সাধারণ হয়ে কেউ আর আজকাল কঁাদে না, তাই আমরা কঁাদি। সবই যেখানে গা সওয়া হওয়ার পথে, সেখানে নিস্তব্ধতায় স্থান করে নেয় প্রতিকারহীন, নিবার্ক অসার পৃথিবী। আমরা কেঁদে কেঁদে এক ভিন্ন ভুবন দাবি করি। হে অঁাধার পথের যাত্রী, আছে কি তোমার নিজস্ব এমন কোনো গল্প যা আমাদের করতে পারে এমনতর অশ্রæসিক্ত, সরব? আমি মোহাচ্ছন্নের মতো হঁা সূচক মাথা নাড়ি। ওখান থেকে ধ্বনিত হয় : তবে সে গল্পটি কাগজে লিখে কাল ভরদুপুরে এই চত্বর কেন্দ্রে একাকি রেখে যেও। আর শেষ বেলায় সঠিক ক্ষণে চলে এসো যেমনটি আজ এসেছ।

আমি আনমনে ঘরে ফিরি। বিনা বিশ্রামাহারে কলম তুলে নেই। লোকটির কথামত যে গল্পটি লিখি তা নিম্নরূপ:

আমার গল্প

ধনিক পরিবারে জন্ম নিলেও, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলেও আমার ভাষাজ্ঞান খুব দুবর্ল বিধায় গল্প লিখার মতো উপযুক্ত নয়, তবুও লিখছি। আমার পিতা যিনি একজন সরকারি কমর্কতার্ ছিলেন, তার আকস্মিক অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর আমাকে বাধ্যতামূলক পরিবারের হাল ধরতে হয়। ধনীর দুলাল হিসেবে ননীর পুতুল খ্যাতিটা আমার ছিল। কাজে অনভ্যস্ত, ছোট চাকরিতেও তাই ছিল তীব্র অনীহা। কিন্তু খুব বড় চাকরি হুট করে আমাকে কে দেবে? তাই ব্যবসায়ের নামে আমি বাবার রেখে যাওয়া তথা তার চাকরি বাবদ প্রাপ্য যাবতীয় অথাির্দ নিজ হস্তগত করি। তাতেও সংকুলান না হলে বাবার নিমার্নাধীন বাড়িটি বিক্রি করে দেই। ছোট দুই ভাইকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করিয়ে বিদেশে পাঠাই। বোনদেরকেও পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিই। সবশেষে মাকে নিয়ে যখন স্ত্রীর সঙ্গে ভাড়া বাড়িতে সংসার পাতি তখন নগদ অথের্র পুরোটাই শেষ। ছোট ভাইদের বিদেশ থেকে প্রেরিত অথের্ সংসার চলে।

নতুন সংসার জীবনে কিছুদিন না যেতেই লক্ষ্য করি আমার মায়ের সঙ্গে স্ত্রীর বনিবনায় বড় ধরনের ফঁারাক। ক্ষুদ্র তুচ্ছ কারণে খুনসুটি নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে ওঠে। পরম পরিতাপের বিষয়, ভালো মন্দ বাছবিচার না করে প্রতি খুনসুটিতে অন্ধের মতো আমি মায়ের বিপক্ষ নিই অথার্ৎ স্ত্রীর পক্ষাবলম্বন করি। এতে করে স্ত্রীর ঔদ্ধত্য ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং এক সময় তা চরমে ওঠে। কোনো এক সময় তা এমন অপ্রকাশযোগ্য পযাের্য় পৌঁছে যে, আমার মা সহ্য করতে না পেরে হাটর্ ফেইলিয়র হন।

আমার মা ছিলেন অতি সহজ সরল এক আদশর্ স্নেহপরবশ মা। তার এহেন মৃত্যুর পর আমার ভাই-বোনরা স্বাভাবিকভাবেই একজোট হয়ে আমার বিপক্ষে চলে যায়। অথর্কড়ি প্রেরণ বন্ধ হয়। এ সময় আমি ছোট ভাইদের বিশেষ কাজে গচ্ছিত আমানত বার লাখ টাকা আত্মসাৎ করে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজি। ভাবি এতেই বুঝি বাকি জীবনটা নিবিের্ঘœ চলে যাবে, কিন্তু বিধি বাম। মাস খানেকের মাথায় এক অসৎ বন্ধুর পাল্লায় ওই টাকাটি খোয়াই। তখন আমি পথের ফকির। স্ত্রী সন্তানকে দুইশ মাইল দূরে শ্বশুর বাড়িতে রেখে কোনো একটা চাকরির খেঁাজে পথে পথে ঘুরি। বুঝতে পারি, আমি সবর্ত্রই এক অবিশ্বস্ত লোক। কে দেবে চাকরি? এক সময় শিক্ষা জীবনের সব সাটিির্ফকেট বন্ধকী রেখে বিশেষ হলফ নামায় এক অশীতিপর বৃদ্ধের মুদি দোকানে বিক্রেতা কাম দোকান রক্ষকের চাকরি নেই। সেখানেই এখন পযর্ন্ত আছি। গেল মাসে স্ত্রী সন্তানকে কাছে নিয়ে এসেছি। এটুকুই আমার গল্প।

সে লোকটির কথা অনুসরণ করে এ গল্পটি আমি যথাসময়ে যথাস্থানে রেখে আসি। আর দিনের কমর্সম্পাদন শেষে সেখানে হাজিরও হই যথা সময়ে। ওই আশ্চযর্ দলটির সমবেত কান্না শুনে নিজের ব্যথর্ জীবনের সাথর্কতা খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশায় খুব উদগ্রীব হই। এবারে সমবেতদের মধ্য থেকে সেই লোকটি উঠে দঁাড়িয়ে আমার গল্পটি সশব্দে পাঠ করতে থাকে। আমি বেশ আশান্বিত হই এই ভেবে যে, গল্পপাঠ শেষে সমবেত কান্নাটি শুনে বহুদিনের অতৃপ্ত আত্মাকে আজ তৃপ্ত করে যাব। কিন্তু সেদিন সত্যিকারে কী হল সে গল্প পাঠ শেষে? যা হলো তা খুবই বিস্ময়কর। আমার জন্য বড় হতাশাব্যঞ্জকও । কারণ, গল্প পাঠ শেষে সমবেত কান্নার পরিবতের্ শুরু হলো সমবেত অট্টহাসি। যেন কোনো বিয়োগান্তক গল্প নয়, বরং কোনো দম ফাটানো হাসির কৌতুক পরিবেশিত হয়েছে, যার প্রতিক্রিয়ায় কেবল অট্টহাসিই থাকে। আমি খুব লজ্জিত ও বিব্রত হই। কারণ, ওসব ছিল ভীষণ তুচ্ছ তাচ্ছিল্যকর। আমাকে নিদারুণ উপহাসের।

হাসি থামলে আমি খুব সংকোচে উঠে দঁাড়াই। ভাবি, এখানে এই শেষ। আমি নিশ্চয়ই আমার উপযুক্ত প্রাপ্যটুকুই পেয়েছি। তবে আর কেন? মাথা নিচু পা বাড়াই। গোপন সে পথটির মুখে পা ফেলবÑ এরই মধ্যে পেছনে অকস্মাৎ ধ্বনিত হয়: হে অন্ধকার পথের যাত্রী, ক্ষণিক দঁাড়াও! আমি স্তম্ভিত দঁাড়ালে আবারো কণ্ঠটি সরব হয়:

মনে কিছু নিও হে পথিক! কারণ, আমাদের কান্নার বদলে হাসতে হলো, যা তোমার প্রত্যাশিত নয়।

কান্না নয় কেন? আমার বিষণœ কণ্ঠ আপনা থেকে বেজে ওঠে।

কারণ, তুমি যে গল্পটি আমাদের উপহার দিয়েছ তা আদতে তোমার গল্প নয় এবং সে গল্পমতে ওটুকুই তোমার প্রাপ্য, যা এ মাত্র আমাদের তরফ থেকে পেলে। আমরা তাতে দুঃখিত যদিও তা ছাড়া আমাদের কিছু করার ছিল না।

মানে? খুব কৌত‚হলে আমি বলি।

খুব গভীর করে ভেবে দেখ বিয়োগান্তক গল্পটি আসলে কার? ওটি সত্যিকারে তোমার? নাকি তোমার সে হতভাগী মায়ের? যদি পার তো নতুন একটি গল্প জমা দিয়ে যেও। কান্না বিষয়ে আমরা নতুন করে বিবেচনা করে দেখব। এবার তুমি যেতে পার।

আমি আবারও আনমনে বাসায় ফিরি। রাত জেগে খুব করে ভেবেচিন্তে ওই গল্পটিই ভিন্ন শিরোনামে আমার হতভাগ্য মায়ের জবানীতে লিখি। যথারীতি, যথাসময়ে, যথাস্থানে তা রেখে আসি। রাতে যথাসময়ে হাজির হই। এরপর যা ঘটল তা নিম্নরূপ:

এবারও ওই লোকটিই যথারীতি উঠে দঁাড়িয়ে সশব্দে গল্পটি পাঠ করতে থাকে। আমি অধীর আগ্রহে গল্প শেষের অপেক্ষা করি। গল্প পাঠ শেষে সমবেতদের মধ্য থেকে একজন পূবর্বৎ কণ্ঠে বলে ওঠে, এই যে এ নিষ্ঠুর ধারাধামে এক হতভাগ্য জননীর নিমর্ম প্রাণপাতের কাহিনী বণির্ত হলো। এমন তো কত শত জননী আছেন; কতশত জননী, কতশত গল্প। এমন গল্পে হৃদয় বিগলিত হয়ে, বিশ্বজনীন হয়ে কোনো নেত্র অশ্রæশিক্ত হয়েছে কি, যা ভবিষ্যৎ জননীদের অকাল প্রয়াণে সুরক্ষা দিতে পারে? এবার সমবেতদের মধ্য থেকে সেই পূবর্বৎ না সূচক জবাবটি এলো। তারপর সেই সমবেত কান্নার রোল। আকস্মিক ঝেঁপে আসা বৃষ্টির মতো কান্নার রোল।

আমি কী এক অপূবর্ মোহাবেশে উঠে দঁাড়াই। ইতস্তত সে গোপন পথে পা বাড়াই। হঁাটতে হঁাটতে কখন শহরের অপর প্রান্তের কবরস্থানে চলে এসেছি কিছুই জানি না। নিজেকে যখন মায়ের কবরের সামনে আবিষ্কার করি তখন কান্নায় আমার গাল, ঘাড়, বুক ভিজে উঠেছে। এই প্রথম অনুভব করি আমার মায়ের কাছে আমি সত্যিকারে অনুশোচনা প্রকাশে সক্ষম হয়েছি। এরপর থেকে সেই লোকটিকে এবং তার সঙ্গীদের আমি আর কখনো দেখিনি। এখন প্রতি রাতে কাজ শেষে সেই ভীষণ নিজর্ন নিরালা মাঠে আমি একা বসে মায়ের জন্য কঁাদি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<29206 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1