ওইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে, ত্রিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলেÑ কবিতার লাইন দুটি জসীমউদ্দীনের বিখ্যাত কবর কবিতার প্রথম দু’চরণ। সুদীঘর্ ও আবেগিক এ কবিতা এত সুপরিচিত যে নতুন করে এর পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। জসীমউদ্দীন পল্লী গঁায়ের কবি হিসেবেই সবাির্ধক পরিচিত। এর খুব সহজ ব্যাখ্যা হলো এই, জসীমউদ্দীনের অধিকাংশ কবিতাতেই উঠে এসেছে পল্লীর কথা। পল্লী মায়ের রূপ সুনিপুণ ও দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পল্লী কবির অন্তরে যেন সদা ধ্বনিত হতো পাড়া গঁায়ের কথা। কবি হিসেবে সবাির্ধক পরিচয় থাকলেও জসীমউদ্দীন ছিলেন একজন গীতিকার, লেখক, রেডিও ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষক। তিনি নিজে পল্লীর রূপে যেমন মুগ্ধ ছিলেন তেমনি কবিতার ভাষায় অন্যকেও তার গ্রামের সৌন্দযর্ দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তার বিখ্যাত নিমন্ত্রণ কবিতার কয়েকটি লাইনÑ
তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের
ছোট গঁায়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের
¯েœহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের
ছোট গায়।
নিমন্ত্রণ কবিতায় কবির যে আকুল আমন্ত্রণ সে আমন্ত্রণে প্রতিটি লাইনেই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে হাজার বছর ধরে চলে আসা গঁায়ের ভালোবাসায় ভরা রূপের কথা। তাকে পল্লী কবি কেন বলা হয় তা তার কবিতাগুলো একটু পড়লেই স্পষ্ট হওয়া যায়। তার রাখাল ছেলে কবিতাটি পড়লেও গ্রাম বাংলার প্রকৃতির রূপের দেখা পাওয়া যায়।
তার রাখাল ছেলে কবিতায় তিনি বলেছেনÑ
রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও
বঁাকা গঁায়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?
‘ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গঁা
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা।
তবে তিনি যে কেবলই পল্লীকবি তা বললে তার সাহিত্য কমের্ক গÐিতে আবদ্ধ করা হয়। তিনি কবিতা লেখার পাশাপাশি গ্রাম-বাংলার বহু ঐতিহ্যবাহী গান রচনা করেছেন। কারণ পল্লীর মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এক অপূবর্ মিল নিয়েই তিনি কেবল কবিতা লেখেননি। এ ছাড়াও বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কবিতা লিখে গেছেন। যেসব কবিতার আবেদন চিরন্তন। কোনো কোনো কবিতার একেকটি লাইন যেন মানব সংসারকেই সঠিক পথের দিশা দেখায়। তার প্রতিদান কবিতায় তিনি লিখেছেনÑ
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা,
আমি বঁাধি তার ঘর,
আপন করিতে কঁাদিয়া বেড়াই
যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী;
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;
দীঘল রজনী তার তরে জাগি
ঘুম যে হয়েছে মোর;
কবি জসীমউদ্দীন বাংলার বষার্র রূপ নিয়েও চমৎকার কবিতা উপহার দিয়েছেন। তার কবিতায় বষার্ ঋতুকে আমরা চিনেছি আরও বহু বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে। তিনি তার পল্লী বষার্ কবিতায় লিখেছেনÑ
আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়েছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে,
কেয়া বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল ধরে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন পল্লী জীবনধারার সঙ্গে প্রকৃতির রং মিশিয়ে তার কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। যা পাঠককে যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ রাখে। তবে পল্লী ধারার বাইরেও তিনি বহু কবিতা লিখে গেছেন। কখনো তা শিশুদের উপযোগী, কখনো মজার আবার কখনো ছবির মতো করে কোনো দৃশ্যপট কবিতার দ্বারা বণর্না।