শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

ফেরা

সাজ্জাক হোসেন শিহাব
  ১৩ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

স্বামীর সাথে সামেনার ছাড়াছাড়ি হয়েছে অনেক আগেই। জীবনবন্ধু হবে বলে শপথ নেয়া পুরুষের সাথে বিচ্ছেদ হলে বাঙালি মেয়েরা যা করে, সামেনার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। বিচ্ছেদের পর সেও সদ্য সাবেক হওয়া স্বামী মনু শেখের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখলো না। ঠিক একই ঘটনা ঘটলো তার বেলায়ও। তারবেলায় মানে, মনু শেখের ক্ষেত্রে। সেও সামেনার কোনো খেঁাজ রাখতো না। অবশ্য মনু শেখ এদিক দিয়ে আরও এগিয়ে। ঢাকায় রিকশা চালানো মনু শেখ সামেনাকে তালাক দিয়ে হুট করে আবার আরেকটা বিয়ে করে। সময় নেয়নি মোটেও। দ্বিতীয় বিয়ের আগে একটিবারও ভাবেনি আগের জীবনের কথা। সে এখন ঢাকাতে থাকে। সামেনার অপরাধ ছিলো, তার গভের্ সন্তান আসে না। মনু শেখ সারাদিন বংশের প্রদীপ প্রদীপ করে মুখে ফেনা তুলতো। কিন্তু সামেনার গভের্ কিছুতেই সন্তান আসতো না। এলাকার ফকির, কবিরাজের কেরামতি কাজে লাগেনি। সামেনার গভের্ সন্তান এলো না। মনু শেখের সাথে সামেনার এ-নিয়ে প্রতিদিন ঝামেলা লেগেই থাকতো। সামেনাও সন্তানের আক্ষেপ নিয়ে থাকতো। এক সময় তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। মনু শেখের নতুন বৌ মমেনা, মানুষের বাড়িতে ঘণ্টা চুক্তিতে চাকরি করে। যাদেরকে শহরের কতার্বাবুরা ঝুটা বুয়া বলে ডাকে। মনু শেখ তাকে নিয়ে ঢের আছে। নিজের আগ্রহ না থাকলেও লোকমুখে উড়ে আসে সেই কথা। একটা সন্তানের জন্য এতো কিছু! সেই সন্তান যার জন্য সামেনা লুকিয়ে লুকিয়ে ডুকরে ডুকরে কঁাদে। তাই এসব ফেলে মনের কষ্টে দেশ ছেড়ে বাইরে যাচ্ছে সে। যেখানে সব ভুলে সে বঁাচতে চায়। অন্তত তার চোখের জল কেউ যেনো না দেখে, সামেনা সেই আয়োজন করে। সে সৌদি আরবে যাবার প্রস্তুতি নেয়। যে মনু শেখ ভুল করেও সামেনার কোনো খোঁজ নিতো না, সামেনা বিদেশে যাচ্ছে- এ-খবর জেনে যায় সে। খবর শুনে সেই সাবেক স্বামী আবার তার খেঁাজ নেয়া শুরু করে! এমনকি মনু শেখ ঢাকা শহর ছেড়ে সামেনার এলাকায় আসে। লোকজনকে লুকিয়ে সে সামেনাকে নানানভাবে বুঝানোর চেষ্টা করে। অনেক প্রচেষ্টার পর সে সামেনকে এটা বুঝাতে পারলো যে, তার নতুন বৌ তার জীবনে অভিশাপ হিসেবে এসেছে। কারণ, তার চরিত্রের নাকি ঠিক নেই। গৃহকতাের্দর সাথে সে হেলেদুলে কথা বলে। যদিও মনু শেখ কখনো কোনো বাড়িতে যায়নি। নিজে দেখেওনি। তারপরও সে সহজেই সরল মনের সামেনাকে এটা বুঝাতে সক্ষম হয়। আসলে সে সামেনাকেই ভালোবাসে, এমনটি বুঝাতে তার বেগ পেতে হয়নি। মনু শেখ আবার আগের জীবনে ফেরত যেতে চায়। সে একটা ভুল করেছে। সেই ভুল শোধরাতে চায়। সে সামেনার পিছুপিছু লেগে থাকে। সামেনার ঠিক মনে আছে, সৌদিতে যাবার আগে সে যখন ঢাকায় এলো তখন আবার তাকে বিয়ে করলো মনু শেখ। তখনও মনু শেখের ঘরে আছে নতুন বউ! কিভাবে যেনও কী হয়ে গেলো! সৌদিতে যাবার পূবের্র রাতে মধুময় এক সময় কাটলো তাদের। মনু শেখ, সামেনাকে নিয়ে ঐ রাতে একটা হোটেলে উঠেছিলো! তাদের কথায় কথায় ভরে উঠেছিলো রাত। সামেনা চোখ বন্ধ করলেই সেই রাতের সুবাস পায়। হোটেলের ঐ ঘরটি কেমন মাদকতায় পূণর্ ছিলো। জানালা খুলে সামেনা আকাশে তাকিয়েছিলো। আকাশে সেদিন অনেক তারা ফুটেছিলো। সেখানে পূণর্ চঁাদ ছিলো। ধবধবে সাদা। ঐদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কখন যে রাত পার হলো তার, তা টেরই পায়নি সামেনা! পরেরদিন রাতে এমিরেটসের একটা ফ্লাইটে সামেনা উড়াল দেয়। দুবাইয়ে হয়ে স্বপ্নের দেশ সৌদিতে পৌঁছে যায় সামেনা। সেখানে সামেনা একটা কাজ পায়। এভাবেই চলতে থাকে তার নতুন দিন। অল্প কিছুদিন যেতে না যেতেই সামেনা মনু শেখকে কল দিয়ে বলে, আমি তুমারে একসাথে দুইড্যা খুশির খবর কইতাম। মনু শেখ, সামেনার এমন রহস্য আর দরদভরা কণ্ঠের কথাশুনে গলা দিয়ে বয়ে যাওয়া আবেগের স্রোত থামিয়ে বলে- দুইড্যা! তাড়াতাড়ি কও না ক্যান! জলদি কও। সামেনা ওপাশ থেকে আবার বলে, আমার মালিকের বৌ খুবই ভালা। আমারে মাস শ্যাষ হওনের আগেই কিছু ট্যাহা দিছে। আমি তুমারে আর আব্বারে ট্যাকাডা পাঠামু। তুমারে যে আমি আবার বিয়া করছি, এইড্যা কিন্তু আমার বাবায় জানে। আমি সব কইয়্যা দিছি। এক নিঃশ্বাসে বলে সামেনা। মনু শেখ এপাশ থেকে বলে, ভালা করছো। আরেকখান খবর কী? সামেনা ঠাসা গলায় বলে, আমার প্যাডে বাচ্চা। কয়দিন ধইরা বমি হইতাছিলো। মালিকের বৌ চেক কইরা আকারে-ইঙ্গিতে কইছে, আমি পুয়াতি। আমি হেগের কথা এখন একটু-আধটু বুঝি। সামেনার এই কথাশুনে মনু শেখ মহাখুশি হয়। তার আনন্দ আর দেখে কে। এই বাচ্চার জন্যই তো কতকিছু! এমনকি একটা বাচ্চার জন্য সে সামেনাকে তালাকও দিয়েছিলো! এমন খুশির কথাশুনে তাই সে জোরে জোরে হাসতে থাকে। সে হাসির আওয়াজ ব্যস্ত নগরীর গাড়ির শব্দের সাথে মিশে যায়। ওপাশ থেকে সামেনা বলে, খঁাড়াও। একবারে এতো হাইসো না। রিক্সা চালাও নাকি? একটু জিরায়া লও। আমার মালিকের বৌ কইছে, আমার মেহমানকে এই দ্যাশে হওয়োনের পর বাংলাদেশে পাঠাবো। এই কথাশুনে মনু শেখ বলে, তা হবো ক্যা? তুমি চইল্যা আহো। আমার ট্যাহা লাগবো না। আমার ছেলে আমার দ্যাশে হবো। কিন্তু মনু শেখের কোথায় জোর ছিলো না। সামেনাও অনাগত সন্তানের কথা ভেবে ওখানেই থাকতে চায়। মনু শেখও এক সময় সম্মতি দেয়। এভাবেই তাদের দিন কাটে। ছেলের কথাশুনে মনু শেখ তার নতুন বউরে তালাক দেয়। তালাকের কথাশুনে সামেনা, মনু শেখকে আরও টাকা পাঠায়। তার ঘরে একটা বড়ো টিভি কিনতে বলে। ঘরটা ভালো করে সাজাতে বলে। নতুন সন্তান আসবে বলে কথা! সামেনা এর মাঝেই বাবা-মাকেও টাকা দেয়। একদিন সামেনার বাচ্চা প্রসব হয়। ছেলে। একটা সাদা বাচ্চা। মনু শেখ, সামেনাকে ছেলের ছবি পাঠাতে বলে। সামেনা একটা ছবি পাঠায়। একই ছবি পাঠায় তার বাবা-মায়ের কাছে। এরপর থেকে তারা সামেনার সাথে আর কথা বলেনা। বাচ্চা হবার পর সামেনার আয় নাই। কারণ, সে যে বাড়িতে থাকতো, সেই বাড়ির গৃহকত্রীর্ তাকে খুব ভালোবাসতো। বাচ্চার চেহারা দেখে তারও সবকিছু বদল হয়ে যায়। তাকে সে দ্রæত দেশে পাঠায়। সামেনা দেশে আসে। সে এখন একটা বেসরকারি সংস্থার অধীনে একটা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর তার সন্তান আছে একটা এতিমখানায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<3227 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1