শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কসাই

প্রত্যয় জসীম
  ২৫ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

তোন্দা থেকে ফালি ফালি মাংস সরিয়ে রক্তমাখা মাংসগুলো গামছা দিয়ে মুছে নেয় মতি। ভেজা গামছায় গরম মাংসের ছেঁায়া অনুভব করে সে। আজকের গরুটা ভালো পড়েছে। ভোর ছয়টা থেকে কাজ শুরু। গরু জবাই ছাড়াও চামড়া ছিলানো, নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার, শেষমেশ মাংসগুলো ফালি ফালি করে ‘এস’ আকৃতির শিকে গেঁথে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। পাল্লা বাটখারা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হয় প্রতিদিনই। গরু খুব নিরীহ প্রাণী হলেও এর রক্ত-চবির্ নিরীহ নয়। চবির্ খুবই বিত্লা। বাটখারায় লাগলে উঠতে চায় না। আর যদি বাটখারায় চবির্ লেগে থাকে ওজন বেড়ে যায়। ওজনে কম দেয়া এটা হলো কসাই হবার প্রথম যোগ্যতা। দ্বিতীয় যোগ্যতা হলো ভালো মাংসের সঙ্গে খারাপ একটু মিশিয়ে দেয়া, এক কেজি মাংসে অন্তত একশ গ্রাম চবির্ দিয়ে দেয়া। চবির্ পাল্লায় এমনভাবে ঠেলে দিতে হবে, ক্রেতার কাছে মনে হবে- চবির্টা বুঝি বেশিই পেল সে। এসব খুটিনাটি নয়-ছয়ে ইতোমধ্যে মতি বড় কসাইকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। খলিল মাংস বিতান। সাইনবোডর্টা পুরনো হতে হতে এখন যা পড়ার যোগ্য তা পড়লে হবে- খলি মা বিতা। সাইনবোডর্ যাই থাকুক না কেন এই এলাকায় খলিল কসাইকে সবাই এক নামে চেনে। খলিল যখন পান চিবুতে চিবুতে মাংস ফালি ফালি করে সেই দৃশ্য মতির কাছে খুবই মনোরম লাগে। মাঝে মধ্যে ধামাটা লোহার শিকে কুরুৎ কুরুৎ... আওয়াজ এটা মতির খুবই প্রিয়। কবে সে সহকারী কসাই থেকে খলিলের মতো প্রধান কসাই হবে সেটা উপরওয়ালাই ভালো জানেন। খলিল কসাইয়ের পুরো নাম রেজাউদ্দিন খলিল। আশপাশের দোকানিরা তাকে ডাকে খইল্ল্যা। খলিলকে খইল্ল্যা বলে ডাকলে সে রাগ হয় না। কসাই মানুষ। গরু-ছাগল জবাই আর মাংস কাটাকুটি করাই যার পেশা তার আবার রাগ কিসের। খলিল এবং মতি দুজনই রাগহীন মানুষ। মতির বিড়ি টানার অভ্যাস আছে। খলিল বিড়ি খায়না তবে জদার্ দিয়ে পান খাওয়া এটাই জগতে তার একমাত্র বিলাসিতা। হাকিমপুরী জদার্ তার খুব প্রিয়। আবুল বিড়িতে টান মেরে মতি বলে, ‘ওস্তাদ সিনার মাংস এক ফালি আছে মাত্র।’ খলিল বলে ‘সিনার মাংস নিয়ে চিন্তা নাই ওইটা যাইবোগা, তবে রান আর চাপার মাংসটা কায়দা করে চালাইতে হইবো।’ ঠিক কইছেন ওস্তাদ কথাটা বলে খেজুরপাতার ঝাড়– দিয়ে মাংসের মাছি তাড়ায় মতি। অযথাই মাংসগুলো নেড়ে-চেড়ে ঝুলিয়ে রাখে। কাস্টমার না থাকলে মতি শিকে ঝোলানে মাংসের ফালিগুলো এদিক ওদিক নেড়ে চেড়ে রাখবে, সিনার মাংসটার তৈলাক্ত দিক রাস্তার দিকে যেন থাকে সেইভাবে ঝুলিয়ে দেবে।

খলিল জলচৌকিতে বসে পান চিবোতে চিবোতে বলে, ‘মতি গরুর কোন মাংসটা সবচেয়ে মজার বল তো।’

মতির মনে পড়ে সেই ছোটবেলায় শবেবরাতের দিন তার বাপ তিন সের গরুর গোস্ত এনেছিল। তাদের গ্রামের গৃহস্থ ঘরে যেন ঈদের আনন্দ নেমেছিল সেইবার শবেবরাতের দিন। চালের রুটি আর গরুর গোশতের ঝোল সেকি মজা। এখনো মুখে যেন স্বাদ লেগে আছে, মায়ের হাতের সেই রান্নার। মনে মনে মতি ভাবে, সিনার গোশতই বেশি মজার। সে বলে, ‘ওস্তাদ সিনার গোশত বেশি মজার। ‘তুই জীবনেও কসাই হতে পারবিনা, মইত্যারে মইত্যা খলিল মতিকে বেশি ভালোবাসা দেখাতে গেলে মইত্যা বলে ডাকে। মানুষের ভালোবাসা প্রকাশের কত রকম ঢং আছে। ‘গরুর সবচেয়ে মজার মাংস হলো লেজের মাংস।

-খলিলের কথা শুনে মতি অবাক হয়। লেজ দিয়ে মশা মাছি তাড়ানো, তা ছাড়া লেজের সঙ্গে সবসময় গরুর চনা-গোবর এসব লেগেই থাকে। তাই বলে কি লেজের মাংস মজার হবে। সে এই প্রথম ওস্তাদের কথা বিশ্বাস করতে চায় না। সহকারী কসাই হয়েও কখনো লেজের মাংস সে খায়নি। লেজের মাংস আসলে কেমন খেতে মতি তা জানবে কি করে! সে একটা দীঘর্শ্বাস ছেড়ে বলে,Ñ ‘ওস্তাদ লেজের মাংস যে খুব মজার, তা আমার জানা নেই। তা ছাড়া জীবনেও লেজের মাংস খাইনি।’

কথাটা শেষ করে মতি চাপাতিটা কাঠের গুঁড়ি যাকে কসাইরা বলে ‘তোন্দা’। সেই তোন্দাতে অযথাই কয়েকটি কোপ মারে। আড়াআড়ি টান মেরে তোন্দায় লেগে থাকা তেল, চবির্ পরিষ্কার করে নেয়। জিঞ্জিরা হোটেলের মালিক প্রতিদিন মাংসের সঙ্গে লেজটা নিয়ে যায়। লেজের সে বান্ধা কাস্টমার। হাফ কেজির মতো হবে লেজটা সে একশত টাকা দিয়ে নিয়ে নেয়। নাড়িভুঁড়ি প্রতিদিন কাছেই এক হালিম বিক্রেতা আছে সে নিয়ে যায়। চাপা আর মাথার মাংসেরও বান্ধা কাস্টমার আছে। আপ্যায়ন হোটেলের মালিক মজনু মিয়া এসে হররোজ চাপা আর মাথার মাংস নিয়ে যায়। সকালের নাশতায় চনাবুটের সঙ্গে কম দামি চাপার মাংস দিলে বুটের ডালের মজাটা অন্যরকম হয়। বেচাবিক্রি শেষে মাঝেমধ্যেই রাত নটা-দশটা বাজে। তবে বেশির ভাগ দিনই সন্ধ্যার পর পরই বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায়।

মতির বেতন মাসে ছয় হাজার। প্রতিদিন চা-নাশতা মালিকই খাওয়ায়। হাত খরচ একশ দেয় কাজ শেষে। গোরান বাজারে সন্ধ্যার পর পঁুটি অথবা চাপিলা মাছের ভাগা বিশ টাকা করে বিক্রি হয়। নিম্ন আয়ের মানুষ, হকার, গামের্ন্টস শ্রমিক মতির মতো আয়ের মানুষ এসব ভাগার ক্রেতা। আরও কয়েকটি পঁুটি দাও বলে মতি একভাগা পুঁটি কেনে। পুঁটি মাছের বিরান তার খুবই প্রিয়। বিরানের সঙ্গে ধনেপাতা না দিলে মজা হবে না। পঁাচ টাকার ধনে পাতার জন্য সে আব্দার করে। বিক্রেতা বলে, দশ টাকার নিচে ধনে পাতা দেয়া সম্ভব নয়। অগত্যা সে দশ টাকার ধনেপাতা, পঁাচ টাকার কঁাচা মরিচ, তেল, পেঁয়াজ, চাল কেনার পর সব টাকা শেষ। গতকালের পঞ্চাশ টাকাও এর মইধ্যে ছিল। এক কেজি চাল হলে দিন চলে যায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনের সংসার। বিয়ে হলো চার বছর হয়েছে। ছেলে-পুলে হয়নি। বউ খালি বলে, কসাইগিরি ছেড়ে দাও তাহলে বাচ্চা-কাচ্চা হবে।’ প্রতিদিন গরু কাটো এক টুকরা মাংসও আনতে পার না, তুমি কিসের কসাই, আরও নানান কথা সুযোগ পেলেই শুনিয়ে দেয় বউ। মতি কাচুমাচু করে বলে, ‘আনবো একদিন যেদিন আমি আসল কসাই হবো। ওস্তাদ হবো। ‘তোমার আর ওস্তাদ হবার দরকার নাই, চার বছর হলো চার টুকরা গোস্ত খাওয়াতে পার নাই তুমি হবা আবার কসাই- গজর গজর করতে করতে বউ রান্না ঘরের দিকে চলে যায়।

শহরের নিম্ন এলাকার একটা বাড়ির ভেতর ছোট্ট একটি টিনের ঘরে ওরা স্বামী-স্ত্রী থাকে। বাড়ির মালিকের স্ত্রীর কিছু টুকটাক কাজ ওর স্ত্রী করে দেয়। ওদের বাথরুম এবং রান্নাঘর আলাদাই। দালান না হলেও ওদের ভালোই দিন কেটে যায়। মতি তার স্ত্রীকে রাতে ঘুমানোর আগে বলে, ‘বুঝছ বউ ঘরে থাকলে মানুষের মায়ামমতা কমে যায়-কথাটা বলে মতি ঘরের লাইট নিভিয়ে দেয়। রাত বেশি হয়নি। বাড়ির মালিকের ঘরে টিভিতে গান বাজছে- পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই...।

‘কোরবানির ঈদের আর বেশিদিন বাকি নাই। মতি নিজে নিজেই কথাটা উচ্চারণ করে। বউ কথা শুনে কেবল বলে, ‘হুঁ’।

এবার দুটি গরু বানানোর অডার্র নেব কি বল বউ,- ‘হুঁ।’ কেবল হুঁ... হুঁ... করছ তোমার কি হয়েছেÑ ঘুম আসছে, হুঁ আধা শহর আধা গ্রাম খিলগঁাও গোরানের এই এলাকায় এখনো কিছু পাখি আছে, রাতের স্তব্ধতা ভেঙে পাখিটা ডেকে ওঠেÑ তোট্ ট্যাং... তোট্ ট্যাং...।

আজ বকরী ঈদ। সারা শহর আজ কসাইখানা। ঘরে ঘরে আজ কসাই উৎসব। জবাইকৃত গরুর রক্তে শহরের সব রাস্তা লালে লাল। বাসা বাড়ির বারান্দা, আঙ্গিনা সব জায়গায় গরুর রক্ত। খলিল মতি আরও দুজন মিলে দুটি গরু বানানোর কাজ নেয়। প্রথম গরুটা বেশ বড়। সাত মণ মাংস হয়েছে। মেপে মেপে সব মাংস ওরা নিয়ে গেছে। এক টুকরা মাংসও মতিদের দেয়নি। নাড়িভুঁড়ি মতিই পরিষ্কার করেছিল। ওদের বউরা নাকি ভট খুউব পছন্দ করে। নাড়িভুঁড়ি ওরফে ভট তাও ভাগ্যে নেই মতির। দ্বিতীয় গরুটা মাঝারি আকৃতির। গরু বানাতে বানাতে বিকেল প্রায়। এরাও ভট নিয়ে যায়। তবে সবাইকে এক-দেড় কেজি পরিমাণ মাংস দেয়। মতিও পায়। মাংসের ছোট্ট পোল্টা নিয়ে বাসায় যেতে যেতে বিকেল তখন শেষ প্রায়। বউগো বউ বলে ডাকে। অনেক আনন্দ নিয়ে সে বউয়ের হাতে গোশত এনেছি গোশত... বলে ছোট্ট পোল্টাটা দেয়। বউ নেয়। দ্রæত সে গোশত চুলোতে বসিয়ে দেয়। সারাদিন কিছু খেয়েছো, বউয়ের প্রশ্নের উত্তরে মতি বলে- কসাইয়ের বাচ্চারা আমাদের চেয়ে ছোট লোক; সারাদিনে এক কাপ চা খাইয়েছে মাত্র কথাটা বলেই মতি অজ্ঞান হয়ে যায়। বউ তার মাথায় পানি ঢালে। হাত-পা টিপে দেয়। ঘণ্টাখানেক পরে মতির জ্ঞান ফেরে। মতি বলে বউগো- গরুর মাংস আমি খাব নাÑ আমার জন্য পুঁটি মাছের বিরান কর... কথাটা বলে দুবর্ল চোখে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে তখন শহরজুড়ে নেমে আসে রাত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<33699 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1