শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খালপাড়ের মৃতদেহ

অলোক আচার্য
  ০৮ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

নন্দনপুর গ্রামে ঢোকার মুখের খালপাড়ে আজ অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সবার দৃষ্টি খালের দিকে। এমনিতে এখানে এত মানুষ দেখা যায় না। সবাই গ্রাম্য কুসংস্কারে এই খালপাড়কে এড়িয়ে চলে। হাট থেকে ফেরার পথে এ খালপাড় হয়েই ফিরতে হয়। খালের ওপর ছোট একটা ব্রিজ। বহু পুরাতন। একপাশে ভেঙে গেছে। তাতে গ্রামের মানুষের কোনো সমস্যা হয় না। কারণ মানুষ আর সাইকেল ছাড়া কিছু চলার দরকার হয় না। তবে আজকের কথা ভিন্ন। আজকের সকালটাও ভিন্ন। কারণ আজ সকালে একটি তরুণীর মৃতদেহ এই খালপাড়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তাই গ্রামের মানুষের কাছে আজকের দিনটা একটু কৌতূহল, উদ্দীপক ও একটু আতঙ্কের। ভিড়টা ক্রমেই বাড়ছে। প্রথমদিকে খালি পুরুষ মানুষ ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বয়সী নারী আর শিশুকে আসতে দেখা গেল। তাদের চোখে মুখে অজানা আতঙ্কের ছাপ। নন্দনপুরের এই খালটির সঙ্গে পাশের বড়াল নদীর যোগাযোগ আছে। ভেসে আসা মৃতদেহটির পরনে কোনো কাপড় নেই। সবার ধারণা নদীর স্রোতে মৃতদেহটি ভেসে এসেছে। মৃতদেহটি প্রথম দেখেছে ভানু মিয়া। ভানু মিয়ার বয়স ত্রিশ বছরের মতো। ঘুরে ফিরে বেড়ানোই তার কাজ। তার বিরুদ্ধে নেশাটেশা করার অভিযোগ গ্রামের মানুষ তোলে। তবে মেয়েলি নেশা নেই। সেই ভানু মিয়ার বন্ধুরা একদিন জানালো পাশের গ্রামে যাত্রা এসেছে। যাত্রার নায়িকা নাকি যুবকদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। ব্যাপক সুন্দরী। ভানু মিয়ার এখন টগবগে যৌবন। মেয়ে সঙ্গও পায়নি কোনদিন। নায়িকার কাল্পনিক ছবি নিয়ে সে কত স্বপ্ন দ্যাখে। তাই গতরাতে চাঁদর জড়িয়ে যাত্রা দেখতে গিয়েছিল। সারারাত যাত্রা দেখে শেষ রাতে ভানু যখন খালপাড় দিয়ে ফিরছিল তখন তার ভয় ভয় করতে থাকে। এই খাল নিয়ে নানা গল্প ছড়িয়ে আছে গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। আজ এই আবছা অন্ধকারে সেই গল্প ভয়ে তার পা থামিয়ে দিতে লাগল। সে বারবার চেষ্টা করতে লাগল আশপাশে তাকাবে না। কিন্তু প্রচন্ড ভয়ের সময় মানুষ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ভানু খালের নিচের দিকে তাকালো। তাকিয়ে সে অষ্পষ্টভাবে খালের পাড়ে পড়ে থাকা মেয়েটির মৃতদেহ দেখতে পেল। আবছা অন্ধকারে মৃতদেহটিকে সে ভালোভাবে দেখতে পেল না। কিন্তু তীব্র ভয়ে সে দৌড়াতে আরম্ভ করল। এক দৌড়ে সে আলফাজ সরদারের বাড়ির বড় গেটের সামনে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আলফাজ সরদার তখন ফজরের নামাজ শেষ করে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভানু একেবারে তার সামনে এসে পড়ায় সে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। শেষমেশ যখন ভানুকে চিন্তে পারল তখন চিৎকার চঁ্যাচামেচি করে আশপাশের বাড়ি থেকে কিছু মানুষ জড় করল। তারপর চোখেমুখে জল ছিটিয়ে ভানুকে কিছুটা ধাতস্থ করে ভয় পাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে খালপাড়ের অভিজ্ঞতার কথা খুলে বলল। আলফাজ সরদার তখন ভানু ও অন্যান্যের সঙ্গে নিয়ে ঘটনা কি দেখার জন্য খালপাড়ে এসে পৌঁছাল। তখন সূর্য উঠে গেছে। খালের ওপর থেকেই তখন সবাই স্পষ্ট মেয়েটির মৃতদেহ দেখতে পেল। পা দুটো জলের মধ্যে আর শরীরটা কাঁদার ওপরে পড়ে ছিল। উলঙ্গ একটি মেয়ের মৃতদেহ দেখে একেকজন একেক মন্তব্য করতে লাগল। মনে হয় ধর্ষণ কেস। কি বলিস? এভাবেই প্রথম মেয়েটি সম্পর্কে প্রশ্ন করে গ্রামের বখাটে রবিন। প্রশ্নটাও করে তার মতোই বন্ধু স্বপনকে। স্বপন এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে দাঁত বের করে হাসতে থাকে। 'খারাপ মাইয়া আছিল মনে অয়' বলে গ্রামের মাঝ বয়সী এক লোক বলে ওঠে। এভাবে একের পর এক মন্তব্যে, হাস্য পরিহাসে মেয়েটি ধর্ষিত হতে থাকে।

বেলা এখন অনেক হয়েছে। সূর্যের তাপ বাড়ছে। মহিলারা বেশিক্ষণ দাঁড়াচ্ছে না। কারণ গ্রামের মুরুব্বীরা প্রায় সবাই উপস্থিত। তবে যুবকদের মধ্যে কৌতুহলটা একটু বেশি। তারা কাছ থেকে দেখতে চায়। তবে তারাও মুরুব্বীদের জন্য কাছে যেতে পারছে না। গ্রামের চেয়ারম্যান হাসমত আলীর কাছে লোক পাঠানো হয়েছে। তিনি বলে পাঠিয়েছেন নাস্তা সেরে আসবেন। ইতোমধ্যে নন্দনপুর গ্রামের ক্লাব সেক্রেটারি নেয়ামত উলস্নাহ আসলেন। তিনি বয়স্ক লোক। সবাই তাকে সম্মান করে। তিনি আসাতে ভিড়ের মধ্যে একটু চাঞ্চল্য উঠল বলে মনে হলো। নেয়ামত উলস্নাহ সাহেব সরাসরি মৃতদেহটার কাছে গেলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মাঝ বয়সী আরো জনা দশেক লোক কাছে গেল। তারা নানাভাবে মৃতদেহটিকে দেখতে লাগল। যেন মেয়েটির মৃতদেহ দেখেই তারা দেহটি খালপাড়ে আসার কারণ বের করে ফেলবে। এর মধ্যেই নেয়ামত উলস্নাহ সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল। মানে এখন তিনি কিছু বলবেন।

'এই মেয়ের লাশ প্রথমে কে দেখেছে?'

পাশ থেকে একজন ভানুর কথা বলল। ভানুকে ডেকে পাঠানো হলো।

ভানু নেয়ামত উলস্নাহ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়াল।

\হনেয়ামত উলস্নাহ সাহেব ভানুর কাছে মৃতদেহটি দেখার ঘটনা জানতে চাইলে ভানু গড়গড় করে সব বলে দিল। তবে সে যাত্রা দেখার কথাটা কৌশলে চেপে গেল। এ ঘটনা সবাইকে জানতে দেয়া যাবে না। লজ্জার ব্যাপার।

'চেয়ারম্যান সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছে?'

একজন বলল হয়েছে। বলতে না বলতেই ভিড়ের মধ্যে আবার শোরগোল উঠল। চেয়ারম্যান সাব আসছে, চেয়ারম্যান সাব আসছে- কেউ একজন জোরে বলতে থাকল।

এতক্ষণ মৃতদেহটির কাছে যে কয়েকজন দাঁড়ানো ছিল তারাও একটু সরে দাঁড়ালো। ক্লাব সেক্রেটারি নেয়ামত উলস্নাহ হাত কচলে বলল 'স্যার ঘটনা মনে হয় খারাপ। কেউ একজন মনে হয় খারাপি করছে মেয়েটার সঙ্গে'।

'তুমি কিভাবে বললে যে কেউ একজন? একাধিকও তো হতে পারে।'

'জ্বী, তা পারে, তা পারে'।

\হ'মেয়েটার চরিত্র মনে হয় ভালো ছিল না'- আরেক মুরুব্বী বলে।

'হতে পারে'। সায় দেয় কেউ একজন।

'তোমরা কেউ মেয়েটারে চেন'? জানতে চায় চেয়ারম্যান।

\হকেউ মুখে না বলে না, তবে মাথা দুইপাশে নাড়তে থাকে।

পুলিশকে জানানো দরকার। বিড়বিড় করে কথাটা বলেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কানে নেয়। ফোন করেন নন্দনপুর থানার ওসিকে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সকালে 'পুব' দিক থেকে ওঠা সূর্যটা পশ্চিম দিকে কিছুটা হেলে পড়তে শুরু করেছে। যে খালপাড়ের পাশে আজ সকাল থেকেই ভিড় ছিল সেখানে এখন কেউ নেই। বরং খালপাড় ঘিরে যেসব অতিরঞ্জিত গল্প প্রচলিত ছিল তার সঙ্গে আরও একটা যোগ হলো। তবে এটি কোনো বানানো গল্প না, সত্যিকারের গল্প। মেয়েটির মৃতদেহ পুলিশ দুপুরের অনেক আগেই নিয়ে গেছে। বিকেলের নিস্তেজ হয়ে আসা সূর্যের আলোটা খালের জলের ওপর পরে চিকচিক করতে থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<39893 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1