বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রন্থালোচনা

নতুনধারা
  ১৫ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

বুকের বামে সোনার গাঁ

'রহমান মুজিব'-এর নতুন কাব্যগ্রন্থ 'বুকের বামে সোনারগাঁ'-এর কবিতাগুলো সম্পর্কে অনেক কিছু বলার আছে বলে প্রযোজন মনে করি না। সব সময়ের মতো তথ্য-উপাত্তের সমন্বয় করিয়ে নতুন কাব্যপ্রন্থের সব কবিতা রচিত হয়েছে। প্রতিটি কবিতার ভেতরে একটি করে ইতিহাস দানা সূক্ষ্ণভাবে গাঁথা, যেন কবি নিজে একজন সূক্ষ্ণদর্শী। সোনারগাঁ মোগল ইতিহাস বহনকারী বাংলাদেশের এক ঐতিহাসিক স্থান। ইতিহাসের এই সোনারগাঁ সম্পর্কে অল্পবিস্তর সবারই জানা। সে জানাটুকু অনেক ইতিহাসবিদের হাতেই উঠে এসেছে অনেকভাবে। কিন্তু কবিতার আঙ্গিকে এত বছরের সোনারগাঁকে পাওয়া যায়নি কোথাও। কবি রহমান মুজিব তা তুলে এনেছেন পয়ারে, ছন্দে, ছোট ছোট পর্বের কারুকার্যে। সোনারগাঁ, পানামনগরসহ অত্র অঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থান, গল্প, কাহিনী, মিথ তিনি তুলে ধরেছেন এক-একটি কবিতায় ভিন্ন ভিন্ন আবহে। কবিতাগুলোও ফুটে উঠেছে নানান ব্যঞ্জনায়। কবিতাগ্রন্থটির নাম 'বুকের বামে সোনারগাঁ' কেন রাখা হলো তা আগে বুঝতে না পারলেও বইটি পড়ার পর আর কোনো অজানা থাকে না, কেন গ্রন্থটির নাম এমন রাখা হলো। প্রথম থেকে কবিতাগুলো পড়তে থাকলে কবিতার মধ্যস্থ তথ্য ও কাহিনীর পাঠে মনে হবে এই কথাগুলো নানান পাঠে, নানান মুখে, গল্পে, প্রবন্ধে জানা হয়েছে অনেকবার কিন্তু কবিতার উদ্ধৃতিতে এমন করে শোনা বা জানা হয়নি কখনো। আর বইটি পাঠের শেষে এসে মনে হবে, এই বইটি কোনো কাব্যগ্রন্থ নয়, ঐতিহাসিক তথ্যনির্ভর ইতিহাসগ্রন্থ, যদিও তথ্যগুলো একেবারে নতুন নয়। তবে এক-একটি বিষয়ই এক একটি কবিতা। কবি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রতিটি কবিতার সঙ্গে টুকে দিয়েছেন পাঠসূত্র টিকা। টিকাগুলো আগে পাঠ করলে কবিতাগুলোর শরীর বুঝতে জলের মতো সহজ হয়ে যায়। একজন সাধারণ পাঠকও কবিতাগুলো পড়তে বেগ পেতে হয় না। অস্বীকার করার জো নেই যে, এই সময়ের অনেক কবির অনেক কবিতাই অনেক সময় বুঝে উঠতে কষ্ট হয়' রহমান মুজিবের কবিতাগুলোও ধরতে একটু কষ্ট হতো তাদের জন্য- সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক তথ্যে যারা ঋদ্ধ নন। কিন্তু টিকাগুলো বিষয়টিকে এতটাই পরিষ্কার করে দেয়, অতিসাধরণ কারও জন্যও কাব্যস্থ ছবিটি ধরতে অসুবিধা হয় না। 'বুকের বামে সোনারগাঁ' যদিও একটি পরিপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ কিন্তু আমি বলবো এটি কবিতায় সোনারগাঁয়ের একটি তথ্যসিন্ধুক। যেমন- একটি কবিতা পড়াই যেতে পারে এখানে- 'আমার জন্মঋণের নাম সোনারগাঁ/ জন্মের পর যে পথ হেঁটেছি তার নাম সোনারগাঁ/ কিংবা যে পথ হাঁটিনি তার নামও সোনারগাঁ/ সহস্র বছরের রক্তের দাগ, প্রত্নভাঙ্গন আর সমৃদ্ধির সুধামিশ্রন/ অতিক্রম করার পর ধানগোলা দিনের ধূলিউড়া মেয়ে আমায় বলেছে-/ আমিই সোনারগাঁ কিংবা সোনারগাঁই আমি।/ সোনারগাঁ আমার আদর্শলিপি, আমার মা-/ 'জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো...' (সোনারগাঁ বন্দনা)। এই কবিতাটির পাঠসূত্র টিকায় বলা হয়েছে- '১৩০০ শতকে রাজা দশরথদেব তার রাজধানী বিক্রমপুর থেকে সোনারগাঁয়ে স্থানান্তর করেন। ১৪০০ শতকের মাঝামাঝি সময় সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ্‌ সোনারগাঁ অধিকার করেন।' আরেকটি কবিতা পাঠ করি- 'আদম আর ইভের ৩০০ বছরের ক্রন্দন সীমায় তোমাকে খুঁজে পাবার প্রত্যয় বন্ধক রাখি/ তুমি আমার বেদখল হওয়া সোনার বান্ধব ঝিলিক, ট্রয়পূর্ণ অ্যালবামের প্রিয় হেলেন।/ তুমিই অনুরূপ চোখপোড়া ছাইয়ের বিনয়, শূন্যতার নীল পাহাড়/ বুক মাড়াই করা এলিয়েন, দূরত্বের নীলভূজি নীবরতা।/ অথচ এখনো নীলকরদের আঘাত- বুকে নীল হওয়ার অপেক্ষায় থাকে/ কখনো আগুনের ঢেউ ঠেলে সর্বাঙ্গে এঁকে যায় নীলকেলির কৃষিত চাতক/ কোথায় তুমি, কোন নীলকুঠির নামাঙ্কিত তোমার একরোখা সুন্দর।/ আটকে রাখে আমার প্রণয় প্রয়াস, হৃদয় মৈথুনের নীলকান্দা-/ তুমি নেই, অথচ আমার এ বিরহ ঝুঁটি যেন বুকে সোনারগাঁয়ের নীলকুঠি।' (নীলকুঠি)। এর পাঠসূত্র টিকায় লেখা আছে- 'ব্রিটিশ আমলে সোনারগাঁয়ের পানামনগরের দুলালপুর গ্রামে নীলকুঠি ছিল। কথিত আছে, নীলচাষীদের ওপর ইংরেজরা সীমাহীন অত্যাচার চালিয়ে তাদের নীলচাষে বাধ্য করত।' এভাবে পানামপর্ব, ব্রহ্মপুত্রপর্ব, খাসনগরপর্ব, কারুপলস্নীপর্ব মোট চারটি পর্বে ৪৮০০টি কবিতায় কবি রহমান মুজিব সোনারগাঁয়ের শুধু ইতিহাসই নয় ঐহিত্য, সংস্কৃতি, প্রচলিত গাথা, উৎসব তুলে এনেছেন বিচক্ষণতা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি সূত্রগুলো ব্যবহার করেছেন যত্ন নিয়ে। উপাত্তগুলো নিয়ে বেশ গবেষণাও করেছেন সময় খাটিয়ে, তার প্রমাণ মেলে কবিতায় তথ্যের উপস্থিতিতে। কয়েকটি কবিতার শিরোনাম উলেস্নখ করলে আরও অনুমান করা যেতে পারে কবির নিরলস প্রয়াসের- পানামের সূর্যোদয়, সোনাবিবি, টাকশাল ভবন, মানসিংহের ব্রিজ, পাঁচপীরের মসজিদ, বাংলার তাজমহল, মসলিন তাঁতি, খাসনগর দীঘি, ইবনে-বতুতা, আমিই ইতিহাস...এরকম আরও নাম। কবিতায় কাব্যিকশৈলী কিছুটা ম্স্নানমুখর আর উপমা, উৎপ্রেক্ষার অভাব পরিলক্ষিত হলেও ঐতিহাসিক স্থান, কাল, পাত্রের উলেস্নখপূর্বক গাঁথুনিতে কবিতাগুলো বেশ মজবুত। হয়তো তথ্যকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই রসে খানিটা ঘাটতি পড়েছে কবির অলক্ষ্যে। তবে এ কথা সত্য, কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে মোগলবীর ঈশাখাঁর সোনারগাঁ ও তৎঅঞ্চলের অজানা ভান্ডার নতুন করে জানার সম্মোহনে মনেই হয় না কোনো কবিতা পড়ছি, ঘোরের মধ্যে মনে হয় প্রতিটি কবিতা একটি অণুপ্রবদ্ধ। একটি কবিতা পড়ার পর পরের কবিতাটি পড়ার আগ্রহ রোধ করে রাখা মুশকিল। জানার কৌতূহলই ইচ্ছাকে টেনে নেয় পরের কবিতায়। এখানেই মনে হয়েছে কবির দূরদর্শিতা বা উপস্থিতির নিঃস্বার্থ সততা। আরও মনে হয়েছে, কবির সুপরিকল্পিত চিন্তার ও দীর্ঘ পরিকল্পনার একটি সুবিন্যস্ত প্রয়াস এই 'বুকের বামে সোনারগাঁ'। আমার কাছে তথ্যভান্ডার আর মোগল ঐহিত্য, সোনারগাঁয়ের একটুকরো সারাংশ হয়েই রক্ষিত রইল এই 'বুকের বামে সোনারগাঁ' কাব্যগ্রন্থটি।

বই ধরন : কাব্যগ্রন্থ। গ্র্রন্থ: বুকের বামে সোনারগাঁ। কবি: রহমান মুজিব। প্রচ্ছদ: আইয়ুব আল আমিন। মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা।

\হ জোবায়ের মিলন

চোখজোড়া প্রজাপতি

সাইফুজ্জামান আশির দশকের কবি, গদ্য লেখক হিসেবে সমধিক পরিচিত। কবিতার হাত ধরে তিনি লেখালেখির অনাবিল জগতে আবির্ভূত হলেও তিনি গদ্য চর্চায় নিজেকে বেশি ব্যাপৃত রেখেছেন। পাশাপাশি কাব্য সাধনায় নিমগ্ন থেকেছেন। তার কাব্যগ্রন্থ 'চোখজোড়া প্রজাপতি' পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে। তার 'চোখজোড়া প্রজাপতি' কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত সব ক'টি কবিতা শিল্প সুষমায় উজ্জ্বল। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বিভাস প্রকাশনী। প্রথম প্রকাশ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৯। প্রচ্ছদ এঁকেছেন অনিরুদ্ধ পলল। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবি শ্রেষ্ঠ মহাদেব সাহাকে। গদ্য রচনার সঙ্গে কবিতার স্নিগ্ধতা সাইফুজ্জামানকে আপস্নুত করে। তার প্রজাপতির মতো হৃদয় কবিতার ফুলেল বাগানপাটে অবাধ ঘুরে বেড়ায়। রঙ-বেরঙের পাখায় ভর দিয়ে তার দৃষ্টি ভ্রমণ করে। সহপাঠিনীর কেঁঁপে ওঠা চোখে প্রথম তার কবিতার বীজ রোপিত হয়। সে বীজ থেকে জেগে ওঠের বৃক্ষের শেকড় প্রসারিত হয়। তিনি তার কবিতা রচনার মাধ্যমে কবি কল্পিত জগৎ উন্মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন পুরোপুরিভাবে। তার 'চোখজোড়া প্রজাপতি'।। এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় সাইফুজ্জামান নিপুণভাবে কবি কল্পিত ভাব মধুরতা চিত্রিত করেছেন। পরম মমতায় তিনি হৃদয়ের গভীর গোপন অনুভবকে কবিতায় রূপায়িত করতে পেরেছেন তার 'চোখজোড়া প্রজাপতি'র কাব্যগ্রন্থে স্থান পাওয়া প্রত্যেকটি কবিতায় শিল্পমুগ্ধ স্বপ্নময় এক জগতের সন্ধান পাওয়া যায়। যাপিত জীবনের যান্ত্রিকতা বিপর্যস্ত করে তোলে, অনেক সময় আপন ভুবন থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন রাখে- তবু যন্ত্রণার ঘেরাটোপে বন্দি অবস্থায়ও মানুষ সবার অলক্ষ্যে বিচরণ করে নিজস্ব ভুবনে। কিন্তু কেউ তা দেখে না। এমন সত্যবদ্ধ উপলব্ধি ব্যক্ত হয়েছে তার কবিতায়। তিনি জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে অনেক সময় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি আকাঙ্ক্ষায় স্বপ্ন মগ্ন হয়েছেন। কখনো কখনো স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবু স্বপ্ন সন্ধানে উদ্যোগী থেকেছেন তিনি। সাইফুজ্জামানের সবুজ প্রজাপতি শীর্ষক কবিতায় এ ধরনের বিষয় উঠে এসেছে। তিনি এ কবিতায় উচ্চারণ করেন : একটি সবুজ প্রজাপতি মাঝেমধ্যে সবুজ ঘাসে উড়ে বেড়ায়/ আমি জানালা দিয়ে তাকে দেখি ধীরস্থির/ সে সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটে ফুলে ফুলে ঘুরে উড়ে/ ঘাসে শিশির জমে পায়ে পায়ে পাথর পরশ বোলায়/ সবুজ প্রজাপতি লাল, হলুদ, সাদা ফুলের রেণু গায়ে মাখে/ সব সময় প্রজাপতিটাকে দেখতে পাওয়া যায় না।

সাইফুজ্জামান এমন ভাবেই তার অন্তর্গত ভুবনের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তার প্রজাপতির মতো মন ক্রমাগত উড়ে বেড়ায়। সবার দৃষ্টিগোচর হয় না তার কল্পনার প্রজাপতি। কেউ দেখতে পায় না উজ্জ্বল রঙিন পাখাওয়ালা দিবাচর এই প্রাণীকে। কল্পনা মগ্ন একজন কবি কেবল দেখেন। তাও সবসময় নয়। অবসরে তিনি সঙ্গী করেন এই প্রজাপতিকে। ব্যস্ততার কারণে দেখার জানালা বন্ধ রাখতে হয় অনেক সময় তখন তিনি বঞ্চিত হন। এই প্রজাপতির জন্য তার ব্যাকুলতা থাকে। দেখার জন্য তিনি উচাটন থাকেন। কিন্তু সবসময় তাকে তিনি দেখতে পানও না। সেই প্রজাপতি পালিয়ে বেড়ায়। সাইফুজ্জামানের কবিতায় কাব্য বিন্যাস শব্দ যোজনা আকর্ষণীয়। তার কবিতায় নিয়ত কাব্য সাধনায় নিরত এক কবির পরিচয় পাওয়া যায়। সাইফুজ্জামান চিরন্তন প্রেম বিরহকে কবিতার উপজীব্য করেছেন। তার চোখজোড়া প্রজাপতি গ্রন্থের অনেক কবিতায় প্রেমের আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। ভালোবাসার বিরহ কাতরতা ঘুরে ফিরে এসেছে। সব পাখি নীড়ে ফেরে না শিরোনামের কবিতায় তিনি বলেছেন : কোনো কোনো পাখি আছে অন্যের নীড়ে থাকে/ আকাশ ঘুরে ঘুরে বারবার অন্যের নীড়ে ফেরে / শীতে অতিথি পাখিরা আমাদের দেশে আসে / তারা কোথায় যায় আমাদের জানা নেই / আমার গন্তব্যও জানা নেই তাই, বারবার তোমার কাছে ফিরে আসি / ফিরে আসা মানেই প্রতিদিন যন্ত্রণায় ছটফট করা এতো জানি, চলে যাওয়াও তাই। আসা যাওয়া ভিন্ন কিছু নয়।

সাইফুজ্জামান প্রেমাকাঙ্ক্ষা ও বিরহ যাতনার অভিব্যক্তি তার কবিতায় কখনো বিমূর্ত কখনো সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। তার রচনা শৈলি প্রচলিত ধারাকে অতিক্রম করেছে। প্রথাগত ধ্যান ধারণার বাইরে থেকে তিনি তার শিল্পিত দর্শন কবিতাবদ্ধ করেছেন।

সাইফুজ্জান যেমন গদ্যচর্চায় নিপুণ কবিতা রচনায়ও অনন্য। তার 'চোখজোড়া প্রজাপতি' কাব্য গ্রন্থটি এ কথারই পরিচায়ক বলে মনে করি।

সাগর জামান

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<40934 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1