বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গীতিকবিতায় স্বদেশ প্রেম

রকি মাহমুদ
  ০৫ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

গীতিকবিতা শব্দটি কানে গেলেই শরীরের প্রতিটি সেল টিসু্যতে অজ্ঞাত শিহরণ জাগে। এক অপূর্ব তাল পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগায়। অসম্ভব এক সুরলহরি হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ক্ষণিকের জন্য হলেও। গীতিকবিতায় সর্বদা একটা গীতিময়তা কাজ করে; যে জন্য গীতিকবিতায় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ প্রয়োগ তেমন লক্ষ্য করা যায় না। সঠিক স্থানে সঠিক শব্দ ছাড়া গীতিকবিতা কল্পনা করা যায় না। 'বাংলা গানের পরিমন্ডলে দেশাত্মবোধক গানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই ইংরেজ শাসনামলে পরাধীনতার গস্নানি ও অত্যাচার নিপীড়নের মধ্যদিয়ে দেশপ্রেমমূলক তথা দেশাত্মবোধক গানের উৎপত্তি। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে দেশাত্মবোধক গানকে বলা হতো স্বদেশী সংগীত এবং বিভিন্ন সময়ে স্বদেশ সংগীত, স্বদেশী গান, মুক্তির গান, দেশ-গান, বা দেশ-বন্দনা প্রভৃতি নামেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।১'

হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে কেন গীতিকবিরা গীতিকবিতা রচনা করেন? তার এক কথায় উত্তর হলো আত্মপ্রকাশের জন্য। আরও ভালো করে বলতে গেলে একজন গীতিকার যত দ্রম্নত ও পরিপূর্ণভাবে এবং প্রায় অনায়াসে তার সৃষ্টিকে যেভাবে একযোগে অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে, তার এক শতাংশও অন্য কোনো ধরনের লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়। গীতিকারের তুলনায় একজন কবি কিংবা ঔপন্যাসিক এমনকি একজন নাট্যকারের প্রচার ক্ষমতা খুবই অপ্রতুল। তদুপরি গানের বাণী গ্রহণ করার জন্য নিরক্ষরতাও কোনো বাধা নয়। স্বাক্ষর-নিরক্ষরের সব ভেদাভেদ উপেক্ষা করে গীতিকবিতার কথামালা বালক-বৃদ্ধ, কিশোর-যুবা, নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছে যত সহজে পৌঁছে যেতে পারে; এমন অনায়াস সর্বগামিতা অন্য কোনো শিল্পের নেই; এবং যা অন্য যে কোনো সাহিত্যজীবীর পক্ষে কল্পনারও অতীত। অতএব, একজন গীতিকবি প্রকৃতপক্ষেই সৌভাগ্যবান, কারণ সব সৃষ্টিধর্মী লেখক ও শিল্পীর যে মুখ্যতম আকাঙ্ক্ষা নিজের হৃদয় নিঃসৃত আশা-নিরাশা, বেদনা ও বিশ্বাসকে সম্প্রচারিত করে দেয়া, সেই ইচ্ছাকে তিনি পূর্ণ করতে পারেন অবাধ গতিতে এবং স্বল্পতম সময়ে।

কিন্তু এই সৌভাগ্যই সব নয়। একদিক দিয়ে গীতিকারের মতো দুঃখীও আর কেউ নেই। একজন শিল্পীর নামেই গান পরিচিতি লাভ করে। আর গীতিকবি যিনি দুর্ভাগ্যবিদ্ধ বাণী স্রষ্টা তিনি গমন করেন অপ্রত্যাশিত, অসহনীয় অজ্ঞাতবাস। এর পরেও গীতিকবিরা তাদের হৃদয়ের সবটুকু দরদ দিয়ে গান রচনা করতে কুণ্ঠিত হন না। অন্তরের শেষবিন্দু মাধুর্য দিয়ে গীতিকবিতা রচনা করেন প্রত্যেক গীতিকবি, দেশগান রচনার ক্ষেত্রে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশেই নয় সমগ্রবিশ্বে কোথাও এমন একজন গীতিকবি আছেন বলে জানা নেই যিনি একটিও দেশগান রচনা করেননি। রবীন্দ্রনাথের কথায় ধরা যাক সমগ্রবিশ্বকে তিনি জয় করেছেন গীতিকবিতা দিয়ে। তার গীতিকবিতার একটা বিশাল অংশ দেশগান। তিনি লিখেছেন: 'ও আমার দেশর মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা/তোমাতে বিশ্বময়ী, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।/তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে/তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে/ তোমার ওই শ্যামল বরণ/ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা ... ...আমার জনম গেল মিছে কাজে / আমার কাটিনু দিন ঘরের মাঝে/ওমা বৃথায় আমার শক্তি দিলে শক্তিদাতা' এখানে রবীন্দ্রনাথ মাটি মানুষকে এমনভাবে ভালোবেসেছেন যে, উদ্ধত মাথা শ্রদ্ধাবনত করতে কণ্ঠাবোধ করেননি। দেশকে ভালোবেসেছেন বলেই অধ্যাপক আবু জাফরের গীতিকবিতায় প্রাণের ছোঁয়া। একটি দেশাত্মবোধক গীতিকবিতায় স্থায়ী অংশে তিনি লিখেছেন: 'এই পদ্মা এই মেঘনা / এই যমুনা সুরমা নদী তটে/ আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়।/এ আমার দেশ এ আমার প্রেম/আনন্দ বেদনায় মিলন বিরহ সংকটে' কবির এই রচনা যেন সাহস এবং ভালোবাসার প্রতিশব্দ। এই গীতিকবিতার অন্তরা অংশে নদী অববাহিকার সৌন্দর্য এভাবে তুলে ধরেছেন- 'এই মধুমতি ধানসিঁড়ি নদী তীরে/ নিজেকে হারিয়ে যেন পাই ফিরে ফিরে।/ এক নীল ঢেউ কবিতার প্রচ্ছদ পটে' এখানে তিনি যেন তার স্বপ্নের দেশের অনুলিপিকার। একই গীতিকবিতার সঞ্চারী অংশে বাংলার নারীকে নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন এভাবে- 'এই পদ্মা এই মেঘনা/ এই হাজার নদীর অববাহিকায়/ এখানে রমণীগুলো নদীর মত/ নদী ও নারীর মত কথা কয়।' এ যেন বঙ্গ রমণীর শ্যামল কোমল প্রকৃত রূপের নিঃস্বার্থ বর্ণনা। একই গীতিকবিতার আভোগ অংশে কবি বাংলার সবুজাভ প্রান্তবৃত্তকে এভাবে রূপদান করেছেন- 'এই অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুঁয়ে নির্ভয়ে নীলাকাশ রয়েছে নুয়ে/ যেন হৃদয়ের ভালোবাসা হৃদয় ফোটে'

গীতিকবিতার অঙ্গ সৌষম্য অবশ্যই সুন্দর ও সাবলীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। স্থায়ীর সাথে অন্তরা, অন্তরার সাথে সঞ্চারী এবং সঞ্চারীর সাথে আভোগের যৌক্তিক ভাব, অনুভব-অনুভূতিগুলোর যোগসূত্রতা বজায় থাকা বাঞ্ছনীয়। গীতিকার সুরকার কণ্ঠশিল্পী অধ্যাপক আবু জাফরের এই গীতিকবিতাটিতে আমরা অবশ্যই দেশপ্রেম এবং সমগ্র গীতিকবিতায় একটা যোগসূত্রতা খুঁজে পাই। সে জন্য অনেক পেশাজীবী সংগঠন এবং শৌখিন যাত্রা ইউনিটগুলোয় এই গীতিকবিতাটিকে প্রতিষ্ঠানের মুখবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

একটি দেশের সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার জন্য গীতিকবিতা অগ্রণীভূমিকা রাখতে পারে। কারণ গীতিকবিতার ভাষা এখানে শান্তিপূর্ণ অথচ প্রতিবাদমুখর। ড. হাবিব রহমান লিখেছেন- 'একটি দেশের সংগ্রামী ইতিহাস/ শত সূর্য হয়ে পথ দেখাতে পারে/ একটি দেশের কোমল মাটির মায়া/ কোটি মানুষের ব্যথা মুছে দিতে পারে... ...একটি দেশের জনতার চোখ/ শত্রম্ন চিনিতে পারে/ একটি দেশের মনের কামনা/ স্বাধীনতা দিতে পারে। মুক্তি-পাগল জনতাকে সে যে/ হাত ধরে বারে বারে/ পথ দেখাতে পারে' ওই গীতিকবিতার অবয়ব সংক্ষিপ্ত কিন্তু তার অর্থ ও সময়োপযোগিতা মোটে ও ধৃষ্টতাপূর্ণ নয়, বরং মানবতার পক্ষে সত্যের অগ্রযাত্রা।' একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বায়ান্নর একুশকে মহিমান্বিত করেছে, কারণ একাত্তর একুশেরই প্রতিশ্রম্নতিকে বাস্তবরূপ দিয়েছে। বাংলাদেশ নামে একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, যার রূপাভাস জাতির চেতনায় ধরা দিয়েছিল ভাষা-আন্দোলনে।২' এদিক আবুল হায়াত মো. কামাল দেশকে সৌভাগ্যের সৌধ হিসেবে গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করার প্রয়াসে গীতিকবিতার পঙ্‌ক্তিমালা সাজিয়েছেন এভাবে- 'যে দেশের মাটির বুকে উর্বরতার প্রতিশ্রম্নতি/যে দেশের সূর্য আসে দুঃখ জয়ের আলোর দু্যতি/এসোনা সেই দেশেতে/ সৌভাগ্যের সৌধ গড়ি... এ দেশের পাহাড় নদী সাগর জলে/ লুকানো মুক্তো আছে/ এ কথা সকলেরই জানা আছে/ এসোনা সেই দেশেতে/ ঐশ্বর্যের গোলা ভরি' ড. মো. মনিরুজ্জামান অসংখ্য দেশগান রচনা করেছেন। দেশের মাটির গন্ধে বিভোর হয়েছেন তিনি। বিমুগ্ধ বিভোর হয়েছেন দিগন্তে সোনা রং ছবি দেখে। তিনি লিখেছেন: 'আমার দেশের মাটির মাটির গন্ধে/ ভরে আছে সারা মন/শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যে/ নেই কিছু প্রয়োজন/ প্রাণে প্রাণে যে তাই/তারই সুর শুধু পাই/দিগন্ত জুড়ে সোনা রং ছবি/ খেলে যায় সারাক্ষণ' মনিরুজ্জামান মনির তার দেশকে সূর্যর আগে, নদীর ধারায়, পাখির গানে, ফসল শোভিত মাঠ আর প্রেরণার উৎস হিসেবেও দেখেছেন। তার হৃদয় উৎসারিত চিত্রকল্প রচনায় এর প্রমাণ পাবো। তিনি লিখেছেন: 'প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যের আগে।/প্রতিদিন তোমার কথা হৃদয়ে জাগে/ ও আমার দেশ ও আমার বাংলাদেশ/নদীর ধারায় পাখির গানে /নতুন স্বপ্নের ছবি আঁকে/প্রতিপ্রাণে প্রেরণার শিহর লাগে/ফসল শোভায় আলোর তৃষা/নতুন ছন্দের দিল দিশা/প্রতিমনে চেতনার জোয়ার জাগে' ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল দেশের ধান ক্ষেত আর ঐতিহ্য রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তার কবিতার শাণিত ভাষা এরকম : 'যায় যদি যাক প্রাণ /তবু দেবনা দেবনা/ দেবনা গোলার ধান/ দেবনা আমার মাঠের সবুজ আর/খামারে সাজানো ফসলের সম্ভার/আমি দেবনা আমার সবুজ, সোনালী, রুপালি ফুলবাগান/রক্তের দামে কিনেছি আমার/প্রিয়তম স্বাধীনতা/রক্তেই আমি রাখব যে তার মান/তবু দেবনা গোলার ধান' নজরুল প্রাণচাঞ্চল্যের কবি, তার কবিতা শিল্পসর্বস্ব নয়, বরং বাস্তবতার স্পষ্টতত্ত্ব নান্দনিক প্রকাশ। তার কবিতায় দেশমাতা এরকম: 'ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি/ আমার দেশের মাটি/ এই দেশেরই কাদা জলে/এই দেশেরই ফুলে ফলে/ তৃষ্ণা মিটাই মিটাই ক্ষুধা/ পিয়ে এরই দুধের বাটি... ..এই দেশেরই ধুলাই পড়ি/মানিক যায় রে গড়াগড়ি/ বিশ্বে সবার ঘুম ভাঙালো /এই দেশেরই জিয়ন কাঠি' প্রবীণ গীতিকার ও সুরকার আব্দুল লতিফ স্বস্তি ও শান্তির আরাধনা, আর ব্যক্তিচৈতন্যে রচনা করেছেন ধ্রম্নপদী পঙ্‌ক্তিমালা: 'সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা/ সোনা নয় তত খাঁটি/বল যত খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি/বাংলাদেশের মাটি আমার বাংলাদেশের মাটি/আমার জন্মভূমির মাটি/ ধন ধন ধন যত ধন দুনিয়াতে/ হয় কি তুলনা বাংলার কারও সাথে/ কত মার ধন মানিক রতন/কত জ্ঞানীগুণী কত মহাজন/এনেছি আলোর সূর্য এখানে/ আঁধারের পথ খাঁটি আমার' দেশকে কতটুকু ভালোবাসলে এমন গীতিকবিতার অবয়ব নির্মাণ করা যায় তা সহজেই অনুমেয়। দেশপ্রেমের এক অনিন্দ্য নিদর্শন পাওয়া যায় ডি এল রায়ের গীতিকবিতায়। তার কবিতায় শিল্পের রূপাবয়ব দেশকালকে ছাড়িয়ে গেছে। সে জন্য তার কবিতায় দেশমাতার রূপ বিশ্বসেরা। গীতিকবিতাটি তিনি তার 'শাহাজান' নাটকের জন্য রচনা করেন। গীতিকবিতার ভাষা এরকম : 'ধনধান্যে পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা।/তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।/ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।/এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।/সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।'

এর পর এলো ৭১ শুরু হলো স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার ডাক। 'সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতা সাবজেকটিভ, তাই এতে দেশ-কাল ও সমসাময়িক জীবনের চিত্র গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। কোনো জাতির মুক্তিসংগ্রামের পটভূমি বিশ্লেষণ করলে তাতে কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের অগ্রণী ভূমিকার পরিচয় পাওয়া যায়।৩ মার্চের শুরুতে দেশবাসী এক মহানায়কের স্বরচিত কবিতা আবৃতি শুনলো' এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।' সমগ্র বিশ্ব সেদিন শুনলো সর্বাত্মক স্বাধীনতার ডাক। সেদিন থেকে গীতিকবিতার ভাষাতেও এলো আমূল পরিবর্তন। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার তার প্রমাণ মিলবে। তিনি লিখেছেন- রক্তেই যদি ফোটে জীবনের ফুল/ফুটুক না .....ফুটুক না। আঘাতেই যদি বাজে প্রভাতের সুর? বাজুক না বাজুক না বাজুক নাগান বেজেছে অগ্নিগান/দূর সব ব্যবধান। সাত কোটি প্রাণ বিসর্জন। বাংলার গস্নানি ঘুচুক নাএক এক হয়েছে সবাই এক/আসুক দুর্বিপাক/ক্ষুব্ধ মিছিল চলবেই চলবে। প্রণয় ঝঞ্ঝা উঠুক নাহৃদয়ের মূঢ় ক্ষত মোছার এ এক আত্মিক আহ্বান। দেশের দুর্দিনে মুক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার এ যেন এক শ্রেষ্ঠ সংলাপ। সংগ্রাম এগিয়ে নেয়ার মতো অন্য একটি গীতিকবিতার স্রষ্টা সিকান্দার আবু জাফর। তার গীতিকবিতার বাণী প্রচন্ড রকমের বেগমান। গীতিকবিতাটি হলো 'জনতার সংগ্রাম চলবেই। আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবেই। জনতার সংগ্রাম চলবেহতমানে অপমানে নয় সুখ সম্মানে। বাঁচার অধিকার কাড়তেই অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ চলবেই চলবেআমাদের পথরেখা দুন্তর দুর্গম। সঙ্গে তবু অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ চলবেই চলবেইআমাদের চোখে লেলিহান অগ্নি। সকল বিরোধী বিধ্বংসী। এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল। আমরা যে কোনো দিন ভাঙবোই। মুক্তপ্রাণের সাড়া আনবেই। আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে। নতুন সূর্য শিখা জ্বলবেই। জনতার সংগ্রাম চলবেই।' সংগ্রামমুখর দিনগুলোতে সংগ্রামী জনতার মনে বোধের সাঁকো শক্ত মজবুত করার জন্য যে কয়জন গীতিকবি কলম ধরে ছিলেন তাদের মধ্যে বর্তমানে খুলনা বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক (প্রাক্তন) টিএইচ শিকদার অন্যতম। তার হৃদয়ের সঞ্চিত বিশ্বাস, উষ্ণ পঙ্‌ক্তিমালাকে নিয়ে করেছেন আবেগের চাষ। পঙ্‌ক্তিমালার সুনিপুণ চালে যে সোনইল দিনের গীতিকবিতা রচিত হয়েছে তা এরকম- অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা/ দেবো যে আরো এ জীবনপণ। আকাশ বাতাসে জেগেছে কাঁপন। আয়রে বাঙালি ডাকিছে রণ। ঘরে ঘরে ঐ জ্বলছে অগ্নিশিখা/শহীদের খুনে লিখতে রক্ত লেখা/আঘাতে আঘাতে ভেঙ্গেছে পাহাড়/ ভেঙ্গেছে ওরে বন্ধুগণদিকে দিকে তোরা আয়রে সর্বহারা যুক্তি শপথে ভেঙ্গে বন্দি কারা/ ভেঙ্গে পথের বাঁধন/ওরে ও বাঙালি শোনরে শোন' বাংলার নিরাবেগ জনগণ যখন হাপিত্যেশে ভুগছেন; হৃদয়ের সঞ্চিত বহ্নিতাপ ম্রিয়মাণ প্রায়। স্বৈরশাসক বাঁচার আন্দোলনকে প্রাচীন পদাবলি বলে উঠিয়ে দিচ্ছিল তখন গীতিকবি গোবিন্দ হালদারের গীতিকবিতার উরুসন্ধি ভেদ করে বেরিয়ে আসে শ্বেতশুভ্র শাশ্বত শপথ 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি। মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরিযে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা/যার নদী জল ফুলে ফুলে মোর স্বপ্ন আঁকা/ যে দেশের নীল অম্বরে মোর মেলেছে পাখা। সারাটি জন্ম সে মাটির টানে অস্ত্র ধরি। মোরা নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি/ মোরা নতুন একটি গানের জন্য যুদ্ধ করি। মোরা একখানা ভালো ছবির জন্য যুদ্ধ করি। মোরা সারা বিশ্বের শান্তি বাঁচাতে আজকে লড়ি। যে নারীর মধু প্রেমেতে আমার রক্ত দোলে। যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে। যে গৃহ কপোতও সুখ স্বর্গের দুয়ার খোলে, সেই শান্তির শিবির বাঁচাতে, শপথ করি

গীতিকবিরা লাঞ্ছিত, অবাঞ্চিত, অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষের মনে জাগিয়েছেন আশার আলো। যারা ভেবেছিল তাদের সামনে বিষণ্ন বিদায়। মৃতু্যকে যারা বাঁচার একমাত্র আশ্রয়স্থল ভেবেছিল তাদের মনে বিজয়ের কিশলকলি ফুটিয়েছেন গীতিকবি ফজল এ খোদা। তার গীতিকবিতার ভাষা এরকম : 'বন্ধু ও রাজপ্রাসাদের লালগালিচায়/আমার ঠিকানা নয়/ সংগ্রামী ওই লাখো জনতার ঝাঁজরা বুকের নীড়ে/ খুঁজো মোর পরিচয়।' নজরুলের গানে হৃদয় অবলম্বন খুঁজে পায়। জীবন চলার গতি পায়। বাংলাদেশের রণসংগীতই তার প্রমাণ : 'চল চল চল/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল/ নিম্নে উতলা ধরণি তল/অরুণ প্রাতের তরুণ দল/ চলরে চলরে চল... ... নব জীবনের গাহিয়া গান/সজীব করিব মহাশ্মশান/আমরা দানিব নতুন প্রাণ/বাহুতে নবীন বল' এর পর 'কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট/রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী/ওরে ও তরুণ ঈশান বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/ধ্বংস নিশান উডুক প্রাচীন প্রাচীর ভেদী।' আরও যে সব গীতিকবিতার বাণী স্বাধীনতা যুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল সেগুলো হলো- 'ছোটদের বড়দের সকলের/ গরীবের নিঃস্বের ফকিরের/আমার এ দেশ সব মানুষের/সব মানুষের সব মানুষের/ নেই ভেদাভেদ সেথা/চাষী আর চামারের/ নেই ভেদাভেদ সেথা/কুলি আর কামারের/ হিন্দু-মুসলিম বৌদ্ধ-খৃষ্টান/ দেশ মাতা এক সকলের' নজরুলের কথা ও সুরে- 'জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত/জাগরে লাঞ্ছিত ভাগ্যাহত/যত অত্যাচার আজি হনি/হাঁকে নিপীড়িত জন যত মথিত বাণী/ না জনম লাভ অভিনা ধরণী ওরে ঐ আগত' অথবা 'দুর্গম গীতি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে/ লঙ্গিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ারকিম্বা 'তোরা সব জয়ধ্বনি কর-তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখি ঝড়' এর পর 'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল/' স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গীতিকবিতার মধ্যে গোবিন্দ হালদারের সব কয়টি গান মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি লিখেছেন : 'তীরহারা এ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে/আমরা ক'জন নবীন মাঝি/হাল, ধরেছি শক্ত করে রেজীবন খাঁটি যুদ্ধ করি। প্রাণের মায়া সাঙ্গ করি/জীবনের সাধ নাহি পাই/ ঘর বাড়ি ঠিকানা নাই/দিনরাত্রি জানা নাই/ চলার সীমানা সঠিক নাই/ জানি শুধু চলতে হবে/ এ তরী বাইতে হবে/আমি যে সাগর মাঝি রে' এর পর কার্তিক কর্মকার লিখেছেন : 'শোন ঐ শোন বাংলাদেশের/শিকল ভাঙার গান/....পুবের আকাশ হয়ে যাক নীল/লাল হোক অবসান।

বাঙালি গীতিকবিরা শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি, গীতিকবিরা অবিমৃষ্য, অকৃতজ্ঞ, দুর্বিনীত নয় বরং তাদের হৃদয় উৎসারিত শ্রদ্ধা শহীদের প্রতি। ফজল এ খোদা লিখেছেন- 'সালাম সালাম হাজার হাজার সালাম/সকল মহীদ স্মরণে/আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই/তাদের স্মৃতির চরনে/ এর পর 'এক নদী রক্ত পেরিয়ে/বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা/ তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবেনা/ না না না শোধ হবে না' তারপর নজরুল ইসলাম বাবুর 'সব কটা জানালা খুলে দাও না/আমি গাইব গাইব বিজয়ের গান/ওরা আসবে চুপি চুপি/ যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ/ গোবিন্দ হালদারের : 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনল যারা/ আমরা তোমাদের ভুলব না'। আমরা জানি স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা বড় কঠিন। গীতিকবিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। গীতিকবি শামসুর আলী বিশ্বাসের গীতিকবিতায় স্বাধীনতা রক্ষার শপথ এরকম : 'আর কেঁদো না মাগো আর কেঁদো না/ ত্রিশ লক্ষ সন্তান হারানোর বেদনা/বুকে তুলে নিলাম আর কথা দিলাম/তোমার আঁচলের এতটুকু সম্ভ্রম/কাউকে কেড়ে নিতে দেবনা/ যদি আকাশে মেঘ জমে/শকুনীরা দুঃসাহসে পতাকা খামচে ধরে/ভেবনা মা, আমরা তো রয়েছি জেগে/তোমার পতাকার এতটুকু সবুজ/কাউকে ছিঁড়ে নিতে দেবনা/ যদি আঁধার রাত্রি আসে/ঘাতকের চোখে আবার বধ্যভূমির স্বপ্ন জাগে/ভেবো না মা, আমরা তো রয়েছি জেগে/তোমার প্রশান্তিত্মর এতটুকু স্বস্তি/কাউকে লুটে নিতে দেবনা' গীতিকবির এই শপথ অবশ্যই অটুট থাকবে। গীতিকবিদের ত্রিকালজ্ঞ মন সবই বোঝে। 'ভাষার সঙ্গে স্বাধীনতার যোগ সব দেশেই সত্য। ভাষা মানুষকে স্বাধীনতা দেয় এবং ভাষা নিজেও স্বাধীনতা চায়; কেননা নিজে যে স্বাধীন নয়, অপরকে সে স্বাধীন করে কি করে' পরিশেষে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বাংলা গীতিকবিতায় দেশপ্রেম তথা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার মতো শক্তি ও সামর্থ্য নিহিত ছিল। সে জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছে গীতিকবিতা। বাংলার গীতিকবি, গীতিকবিতা আর স্বাধীনতা এখানে একই সূত্রে গাঁথা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<43982 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1