বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়েটি স্পর্শ করে ভালোবাসতে শেখালো

স্বপ্‌না রেজা
  ১২ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

শহরজুড়ে পাঠাও বাইক। সঞ্চয়ের সবটুকু দিয়ে রনোর একটা পাঠাও বাইক হয়েছে। হরেক রকম ডিজাইনের বাইকের সঙ্গে পালস্না দিয়ে রনোর এই পাঠাও বাইক চলে। অল্প সময়ে, সহজে এবং স্বাধীনভাবে উপার্জনের এই পথচলা বেশ লাগে রনোর। রাস্তায় বাইক নিয়ে ছুটে চলার ভেতর এক ধরনের মাদকতা খুঁজে পেয়েছে সে। যে চালায় সে সেই উত্তেজনা অনুভব করতে পারে। ব্যস্ততম সড়কে যাত্রী নিয়ে বাইক ছুটে চলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। রনো সেই দুরন্ত উত্তেজনাময় দলের সক্রিয় একজন। বেঁচে থাকার আপ্রাণ ছুটোছুটি প্রতিদিন। টি-শার্ট, জিন্সের প্যান্ট আর কেডস পরে বেশ সকালে বের হয়। সকাল তার শুরু হয় আকাশটা অন্ধকার থাকতেই। অন্ধকারের রেশ কাটিয়ে আলোর শুরুটা যেন রনোই করে দেয়। কিছু মানুষ যেন প্রকৃতির নিস্তদ্ধতা ভেঙে দিতে, আলোকিত করতে জগতে আসে। রনো অন্ধকারকে মেনে নেয় শুধু আলোর তৃষ্ণা মেটাতে।

ছোট বোন নদী। ছিপছিপে গড়নের। ভোর হতেই বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরে ঢোকে। ভোরের স্নিগদ্ধতার সঙ্গে তার দিন শুরু। রনোর জন্য গরম ভাত রেঁধে দেয়। পেস্নটে খাবার দিয়ে চেয়ে থাকে আরও কিছু দরকার কিনা ভাইয়ের। নদীর ব্যস্ততায় মমতার ছোঁয়া মাখা। কিছু ব্যস্ততা বোধহয় এমনই নির্মোহ আর নিঃস্বার্থপরতায় মোড়ানো। রনোর মনে হয়, মা যেন নদীর ভেতর জায়গা করে নিয়ে আছেন কেবল রনোর দেখভাল করার জন্য। সম্পর্কগুলো এমনই, একজন আরেকজনের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করে যান। অল্পবয়সে মা-বাবাকে হারিয়ে নদী যেন রনোর ভেতর তার পৃথিবী এঁকে চলে।

আকাশ ফর্সা না হওয়া ভোরেই পাঠাও বাইকের অ্যাপস ওপেন করে রনো। ওপেন হতেই কল। মিষ্টি নারী কণ্ঠ। ঠিকানা অভিমুখে স্টার্ট নেয় বাইক। সুমিষ্ট স্বরের পানে ছুটে চলা। এই প্রথম অন্যরকম অনুভূতি রনোর। টান বললে ভুল বলা হয় না।

স্বভাবের দিক থেকে রনো অমায়িক। চালায় ভালো। তার ওপর সুদর্শন। মেয়ে যাত্রী চড়ে বসেছে। মোহাম্মদপুর থেকে ভার্সিটি তার গন্তব্য। ঘড়ির কাঁটা পৌনে ছটায় দাঁড়িয়েছে কেবল। এত সকালে ক্লাস হয় কিনা, রনোর ভার্সিটির জীবনে কোথাও তার হদিস মেলে না। নিজের ভেতর এমন প্রশ্ন জেগে ওঠা এক ধরনের অনাধিকার। হয়তো এখন নিয়ম বদলেছে। নিয়ম তো বদলানোর বিষয়। মানুষ তার প্রয়োজনে নিয়ম বদলায়, নতুন নিয়ম বানায়। নিয়মের সঙ্গে মানুষও বদলায়।

এক্সকিউজ মি! আমি কি আপনার কাঁধে একটা হাত রাখতে পারি?

যেন হাত রাখতে পারলে তার উপকার হয়। পরোপকারী রনোর কানে এসে লাগে কোমল, মিষ্টি চাওয়া। এর আগে কখনো এমন করে কেউ চায়নি। ছুঁয়ে যাওয়ার মিনতি করেনি। মাথার ওপর চুলের ভাঁজে চশমা তুলে রেখেছে। ঘুমঘুম চোখ। ভালো করে খেয়াল করলে ঘুম কাতুরে অথচ স্পষ্ট আঁকা চোখজোড়া ভেসে ওঠে। কাঁধে ঝুলছে লেদারের ব্যাগ। খাড়া, চিকনসরু নাক। কাঁধে হাত না রাখতে দেয়ার কোনো কারণ নেই। বরং এমন একজন মেয়ের স্পর্শের প্রতি রনোর সুপ্ত বাসনা থাকার কথা ছিল বোধহয়। নতুবা হালকা-পাতলা অথচ কোমল স্পর্শ রনোর শরীর ছুঁয়ে যেতেই উতলে ওঠে আবেগ। জোয়ারের তীব্রতা যেন আছড়ে পড়ল মনের ওপর।

একটু আস্তে চালাবেন, পিস্নজ! অনুরোধটা আরও শক্ত করে রনোর কাঁধ ধরতে সহায়তা করল মেয়েটিকে। বাইকের গতি কমে আসে। সময় লম্বা হতে লাগে। রনোও চাইছিল সময় লম্বা হোক আরও।

আরেকটু আস্তে চালান। আবার অনুরোধ মেয়েটির।

ভয় পাওয়ার মতন গতি নয়। রাস্তার পাশে গতি রোধ করে রনো পেছন ফিরে তাকায়। রনোর কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে মেয়েটি। ভ্রম্নক্ষেপ নেই। আড়ষ্টতা, তাও নয়।

কোনো সমস্যা আপনার? নড়াচড়া হলে তরুণী সোজা হয়ে বসতে পারে। রনো চাইছে না স্পর্শের ভেতর যতিচিহ্ন লেপ্টে যাক। নিজেকে যতটা পারা যায় সোজা রেখেই জানতে চাওয়া রনোর। যাত্রী একইভাবে বসে।

কই, না তো! তবে আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আপনি জোরে চালালে আমি পড়ে যাব! পিস্নজ!

পাঠাও বাইকের গতি আরও কমে গেল। অনেকটা দাঁড়িয়ে চলার মতো। খুব সকালে শহরের রাস্তায় বড় বড় যানবাহনগুলো পাগলের মতো ছুটোছুটি করে। ছোট গাড়ি ধীরে চললে সমস্যা। তবুও রনো সতর্কতার সঙ্গে মেয়ে যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে মনস্থির করে। মনে হচ্ছে মেয়েটি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে ক্রমেই। রনোর শরীরের ওপর মেয়েটির ভার যতটা গভীর হতে থাকে, মেয়েটির ভারসাম্যহীন বোধটা ততবেশি অনুভব করে রনো।

এমএ পাস করার একটা সার্টিফিকেট আছে ঘরে। আলমারির ভেতর ঘুমিয়ে। ওটা জাগিয়ে লাভ হয় না। তাই ঘুম ভাঙানোর চেষ্টাও নেই। সার্টিফিকেট অনুযায়ী একটা চাকরি কপালে জোটেনি। সার্টিফিকেটের সঙ্গে একটা শক্ত ধরনের লিংক থাকতে হয়। রনোর ওসব নেই। ড্রাইভিং শেখা ছিল বিধায় একটা করপোরেট অফিসে ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। ইন্টারভিউ বোর্ডে সপ্তম আশ্চর্যের বাজ পড়েছিল। কিন্তু সেই আশ্চর্যবোধ কোনো সমাধান দেয়নি। ড্রাইভারের বেতন বিশ হাজারের কাছাকাছি। ওভারটাইম ডিউটি দিয়ে পঁচিশ হাজার হতো কোনো কোনো মাসে। ভেরিকল ডিপার্টমেন্টের সুপারভাইজারের সন্দেহভাজন দৃষ্টি ভালো লাগেনি। ড্রাইভার মানেই হলো গ্যাস, তেল, পার্টস চুরি করার মানসিকতা। এমন ধারণারোগে আক্রান্ত সুপারভাইজার। সঙ্গে আছে অডিট ডিপার্টমেন্টের লোক। সাধারণত অডিট বিভাগ বাদবাকিদের চোর-ডাকাত ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কৃতিত্ব দেখায়। রনোর ভালো না লাগাটা অবশেষে গাড়ির চাবি বিনয়ের সঙ্গে সুপারভাইজারের হাতে তুলে দিতে সম্ভব করেছিল।

সেই থেকে শুরু পাঠাও বাইক চালানো। বেতনের দ্বিগুণ আয় হয়। চলে যায় সুন্দরমতো দুজন মানুষ, রনো আর নদীর সংসার। নদী পড়ছে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে। রনো কখনো-সখনো ওকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে এলেও সব সময় পেরে ওঠে না। যেদিন পারে সেদিন নদীর চেহারার রং বদলে যায়। উজ্জ্বল দেখায়। যেন সূর্যটা নদীর দিকে তাকিয়ে জেগেছে।

ভার্সিটির কোথায় নামবে বলেনি মেয়েটি। টিএসসির সামনে এসে ব্রেক কষে রনো। কাঁধ থেকে মাথা না তুলেই ক্ষীণ স্বরে বলে, আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকলে কী আপনার খুব অসুবিধে হবে?

অপ্রত্যাশিত আব্দার। আব্দার নাকি অনুরোধ। পেছন ফিরে তাকাতেই হলো রনোর। সোজা হয়ে বসে মেয়েটি। সরাসরি দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি মেখে বলে, বুঝলাম আপনার অসুবিধে হবে। সমস্যা নেই। কত দিতে হবে? নির্ঘুম রাতের আভা চোখজুড়ে।

বাইক থেকে নেমে ব্যাগের ভেতর হাত চালায়। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি। খুঁজে না পেয়ে আইল্যান্ডের ওপর বসে পড়ে। হতাশায় আচ্ছন্ন অবয়ব। ব্যাগের ভেতর রাখা সব জিনিসপত্র এক এক করে আইল্যান্ডের ওপর রাখে। কপালে কয়েক সারির ভাঁজ জেগে গেছে নিমিষে।

ততক্ষণে টিএসসির সামনে শিক্ষার্থীদের পদচারণা হালকা থেকে গাঢ় হতে শুরু করেছে। সাতসকালে আইল্যান্ডের ওপর বসা মেয়েটির ওপর কৌতূহল দৃষ্টি না ফেলে কেউ আর হাঁটে না। বাইক থেকে নেমে মেয়েটির পাশে বসে রনো। খুব কাছাকাছি বসা। কিছু বুঝতে চেষ্টা করার কৌশল যেন। মেয়েটির ভ্রম্নক্ষেপ নেই। হন্যে হয়ে টাকা খুঁজেই চলছে। বাধা দেয় না রনো।

অবশেষে হার মানে মেয়েটি। না চাইলেও কিছু হার মেনে নিতে হয়। লজ্জিত বেশ সে।

সরি! ঘনকালো মেঘ সরি শব্দজুড়ে। কান্না বৃষ্টি হয়ে ঝরবে সেই মেঘ থেকে সহসায়। রনোর নিরুত্তর ভাব কাঁদিয়েই ছাড়ল অবশেষে। বৃষ্টিতে স্নাত হয়ে যেন ধুলোমুক্ত হয়ে উঠল।

বিশ্বাস করুন, এই ব্যাগে টাকা ছিল! একটুও মিথ্যে নয়, সত্যি বলছি। আপনি বিশ্বাস করছেন না? প্রশ্নটা ছিল বেশ জোরে এবং বিস্ময়মাখা। আদালত যেন। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের আকুতি অপরূপার। বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ার মতো। মেয়েটি দু'হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। রীতিমতো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শরীরের কাঁপুনি রনোর শরীর পর্যন্ত পৌঁছায়। কথা বলতেই হলো রনোর।

পিস্নজ! কাঁদবেন না! অস্থির হবেন না! ভাড়া লাগবে না! মোটেও পছন্দ হলো না কথাটা মেয়েটির। মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল। চোখের সবটুকু জল যেন নিমিষে সদ্য জেগে ওঠা সূর্য শুষে নিল খরতাপে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আগুনের ফুলকি রীতিমতো।

করুণা করছেন! রাজ্যহারার বেদনা যেন মেয়েটির।

সেকি! কেন করুণা করব? আমি তেমন মানুষ নই। মেয়েটি দুই গাল বেয়ে অশ্রম্ন হাতের তালু দিয়ে মুছে বলে, ভাড়া আপনি পাবেনই। নিতেই হবে আপনাকে ভাড়া। আমি আপনাকে ভাড়া পাঠিয়ে দেব। আপনার বিকাশ নম্বর থাকলে দেবেন।

আমার কোনো বিকাশ নম্বর নেই।

তাহলে ঠিকানা দিন, পৌঁছে দেব।

ঠিক আছে দেব। কিন্তু বলুন তো কেন আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকতে বলেছিলেন?

মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল মেয়েটি। অসহায়ত্বের ছিটেফোটা নেই কোথাও। উঠে দাঁড়ায়। এলোমেলো পা ফেলে হাঁটা শুরু। জবাব দেয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজনবোধ নেই। কী ভেবে রনো তার সঙ্গে হাঁটে। বেশ কাছাকাছি হাঁটা। সটান করে ঘুরে দাঁড়ায় মেয়েটি। রনোর বুক বরাবর তার অবস্থান।

কী সমস্যা, আপনার! কেন আসছেন আমার সঙ্গে? আগুনের আভা এসে লেগে গেছে চেহারায়।

আমি ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাস করেছি। এত সকালে বোধহয় ক্লাস হয় না। মানে আমাদের সময় হয়নি। এখন হয় কিনা-

রনোর কথা শেষ না হতেই মেয়েটি তীর ছোড়ে। সরাসরি বুকে বিঁধে যাওয়ার মতো।

আমাকে সন্দেহ করার আপনি কে?

বিব্রত রনো। এলোমেলো মেয়েটির আচরণ। সময় যত যাচ্ছে, মেয়েটিকে একা ফেলে না যাওয়ার ইচ্ছে ততই গাঢ় হচ্ছে রনোর। মনের ভেতর যে মন, তার অজানা আশঙ্কা। মেয়েটি কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছে না তো।

আমাকে কিছুক্ষণ থাকতে বলা হয়েছিল, তাই থাকতে চাইছি। বলবেন, কারণ কী।

কী ভেবে মেয়েটি বলল, চলুন।

বাইক ছুটতে শুরু করেছে আবার। গন্তব্য বলেনি। জানতেও ইচ্ছে হলো না রনোর। জীবনের আজব গল্পগুলো বোধহয় এমনই। কখন যে কোন গল্পের মোড় কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, বেঁকে যায় কিংবা শেষ হয়, বলা মুশকিল। তবে রনোর ভেতর অন্যরকম এক অনুভূতি বইছে এবং তা জোরেসোরে। নীলক্ষেত সিগন্যাল মোড়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট ইশারা দিল বাঁশি বাজিয়ে। বাইকের কাছে আসে।

পাঠাও?

জি।

কাগজপত্র দেখি।

পকেট থেকে বের করতে গিয়ে মনে হলো কাঁধের ওপর মেয়েটির মাথা। নড়াচড়া করলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। সার্জেন্ট সেদিকটায় তার চোখ নিবিষ্ট করে রেখেছেন। সার্জেন্টকে তো আর দাঁড়িয়ে রাখা যাবে না। এক হাত দিয়ে মেয়েটির মাথা ধরে পকেট থেকে কাগজপত্র বের করা হলো। অবাক নয়ন সার্জেন্টের।

তিনি যাত্রী!

মেয়েটি এত অল্প সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হলো। কোনো সাড়াশব্দ নেই। অযথায় ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কায় মিথ্যে বলতে হলো।

আমার আত্মীয়া।

পাশে আসুন। হাতের মুঠোয় কাগজপত্র নিয়ে রনোকে রাস্তার একপাশে আসার নির্দেশ দিলেন সার্জেন্ট। সমস্যা হলো এত অল্প সময়ে মেয়েটির ঘুমে অসচেতন হওয়া। ধীরে ধীরে এগুতে হলো।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সার্জেন্টের। রনো অস্বস্তির ভেতর ডুবতে শুরু করেছে।

কোত্থেকে আসলেন? যাত্রীর হেলমেট কোথায়?

রনোর একবারও ইচ্ছে হয়নি মেয়েটিকে বলতে মাথায় হেলমেট দেযার কথা। উত্তর দেয়ার মতো কিছু নেই। চোখ সরাতে পারছে না সার্জেন্ট মেয়েটির চেহারা থেকে। যেন বিঁধে গেছে খুব গভীরভাবে।

শুনছেন, উঠুন। রনো কথা দিয়ে টেনে তুলল একরকম।

কী সমস্যা!

কিছুই টের পায়নি যেন মেয়েটি। চোখ খুলতে যেন আলোর ছটা বের হলো।

এভাবে হোন্ডায় কেউ ঘুমিয়ে পড়ে! মুষ্ঠিবদ্ধ শক্ত প্রশ্ন সার্জেন্টের। কোনো পুরুষ হলে নির্ঘাত গালে এসে পড়ত থাপ্পড়-ভাবটা এমনই। ভ্রম্নজোড়া এক বিন্দুতে এসে মিশেছে মেয়েটির।

আমি ঘুমিয়ে থাকব, নাকি জেগে থাকব, সেটা দেখভাল করার দায়িত্ব কে দিল আপনাকে শুনি?

এক্সিডেন্ট হতে পারে।

সেও তো আমি ভাববো, তাই না?

মানুষমাত্রই আত্মবিশ্বাসে চলতে পছন্দ করে। আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন বোধ করল না সার্জেন্ট। রনোকে একটু দূরে ডেকে সার্টের বুক পকেট থেকে একটা ছবি বের করে দেখায়। যেন মেয়েটি তার বুকে ছিল, টেনে বের করল। এই লোকটার বুক পকেটে মেয়েটির থাকার রহস্য কী। চোখের ওপর বসে থাকা রোদচশমা কপালে উঠে বসল সার্জেন্টের। মেয়েটি আনমনে অন্যত্র দৃষ্টি মেলে রেখেছে। ভাবনা-চিন্তার বিন্দুমাত্র রেশ নেই। কোনো কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না।

রনো জানতে পারল পরিবার থেকে প্রতিটি থানায় পৌঁছে গেছে মেয়েটির ছবিসহ নিখোঁজ সংবাদ। করা আছে সাধারণ ডায়েরি। নিউরোটিক ডিপ্রেসনে আক্রান্ত সে। তথ্যগুলো বুকের ভেতর আনচান ভাব এনে দেয়। রনোর সঙ্গে তার সম্পর্ক জানা জরুরি- কথার ভেতর শোনালো সার্জেন্ট। নিজেকে রক্ষা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে জাগলো না রনোর। বরং মেয়েটি যেন বিপদে না পড়ে যায় সেই ভাবনায় নিমগ্ন। কিন্তু কতটা বিশ্বাস করবে তার কথা।

পরিবারের অমতে মেয়েটি ভালোবেসে বিয়ে করেছিল মাঝবয়সী এক ব্যবসায়ীকে। ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে সেও। ধনী পুরুষের মেয়ে প্রীতি স্বভাবে খুব সহজেই অল্প বয়সের এই মেয়েটি ধরা পড়ে যায়। ঘুমের ওষুধই যেন শেষ রক্ষা। ইতিহাস পড়াতে শুরু করলেন সার্জেন্ট। রনো ছাত্র তার। ভারী কণ্ঠে বললেন,

মেয়েটিকে রক্ষার জন্য আপনার সত্য কথা বলা জরুরি। দ্বিধাহীন কণ্ঠে রনো বলে, মেয়েটিকে আমি ভালোবাসি। সে আমার প্রেমিকা।

রনোর কথার শেষ অংশ মেয়েটির কানে পৌঁছালো। পেছন ফিরে দেখে রনোকে। ঠোঁটে মৃদু হাসি।

তাকে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

আমার সব কথা ওকে জানিয়ে আমার উপকার করেছেন। আমি বলতে পারছিলাম না। কারণ, আমিও ওকে ভালোবাসি। সে আমার প্রেমিক।

মেয়েটি শক্ত করে রনোর হাত ধরে। অনেক অভ্যস্তের মতো। মৃদু হাসি মেখে বলে, মানসিক রোগ সবচেয়ে বেশি সংক্রামক। আমি এই সংক্রামকের শিকার মাত্র।

সরি! কোনো কথাই শোনা সম্ভব নয়। সার্জেন্ট অনড়। হাতের ইশারায় পুলিশের টহল ভ্যান ডেকে নেয়। বিরক্ত হয় মেয়েটি।

চলুন কোথাও বসে আমরা তিনজন কফি পান করি। সার্জেন্ট রনোর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, দেখলেন তো মাথার ভেতর বারোটা বেজে আছে। অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। মেয়েটি কিন্তু এখন স্বাভাবিক নন। মানসিক রোগ হুট করে বেড়ে যায়। স্পষ্ট শোনালো সার্জেন্টের কথা।

ল্যাঙ্গয়েজ পিস্নজ! অগ্নিমূর্তির রূপ ধারণ করেছে। রাস্তায় চলাচল বাড়ছে পথিকের। একটা কুচকুচে কালো রঙের প্রাদো এসে দাঁড়ায় গা ঘেঁষে। খুব পরিচিত গাড়ি মেয়েটির। যে লোকটি বের হলো গাড়ি থেকে, তিনিও। সাদাকালো চুল। চোখে সানগস্নাস। পেট সামনে হেলে পড়েছে কিঞ্চিৎ। সার্জেন্ট তাকে সংবাদ দিতে দেরি করেনি।

মানসম্মান এভাবে নষ্ট করার কী দরকার ছিল? প্রেম তো ঘরে বসেও করা যেত, তাই না? ক্ষমতার সুরে কথাগুলো বলে মেয়েটির হাত ধরে টানতে লাগল মাঝবয়সী লোকটি। গাড়িতে মালপত্র টেনে তোলার আচরণ ভালো লাগল না রনোর।

এভাবে কেন!

মানে? আমার স্ত্রী। আমার যা ইচ্ছে তাই করব।

আপনার যা ইচ্ছে করাটা যদি তাকে কষ্ট দেয়, তাহলে আপনার যা ইচ্ছেটা একটা অপরাধ হবে।

ননসেন্স! সার্জেন্ট, এই অপহরণকারীকে কেন এখনো ধরছেন না?

প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুক থেকে গুলি ছুটল যেন। সার্জেন্ট খপ করে শক্ত করে ধরে রনোর হাত। ক্ষমতাধর লোকের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে রনোকে ছিনিয়ে নিল মেয়েটি।

ইনি নন, উনি আমাকে কিডন্যাপ করেছিল টাকা দিয়ে! আমার মতো মেয়েদেরকে রক্ষিতা করে রাখে ওনারা! ওনাকে ধরুন অপহরণকারী হিসেবে!

বিব্রত গোটা পরিবেশ। সার্জেন্ট হতভম্ব। মেয়েটি রনোর বাইকে চড়ে বসে। বাইক ছুটে চলে। মেয়েটির নাম তখনো রনো জানতে পারেনি। নতুন একটা নাম দেয়ার ইচ্ছে বুকে দলা পাকায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<45050 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1