শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বহুমাত্রিক হুমায়ুন আজাদ

সাহিত্যক্ষেত্রের সর্বত্র হুমায়ুন আজাদের পদচারণা ছিল। প্রবন্ধ এবং গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে যা দিয়েছেন অনেকে তা পারেননি। শুদ্ধ ভাষার দখল ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ দেখানোর মতো লোক ছিলেন তিনি। তার মতো ক্ষণজন্মা ভাষাবিজ্ঞানী বাংলা ভাষা কবে পাবে কিংবা আদৌ পাবে কি-না সন্দেহ আছে!
আবু আফজাল সালেহ
  ০৩ মে ২০১৯, ০০:০০

বহুমাত্রিক ও প্রথাবিরোধী মননশীল-লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি ও গবেষক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ (২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ - ১১ আগস্ট ২০০৪) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার। গতানুগতিক চিন্তাধারা তিনি সচেতনভাবে পরিহার করতেন। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬০টির বেশি। ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোরসাহিত্য, ৭টি ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ তার জীবদ্দশায় এবং মৃতু্যর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ নারী প্রকাশ করে গোটা দেশে সাড়া তোলেন। বইটি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল। এ গ্রন্থ তার বহুল আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসেবেও স্বীকৃত। সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম ও ভাষাবিজ্ঞানে অবদানের জন্য তাকে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। তার রচিত কিশোরসাহিত্য ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আব্বুকে মনে পড়ে জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ২০০৩ সালে।

১৯৬০-এর দশকে হুমায়ুন আজাদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র তখন পশ্চিমের ভাষাবিজ্ঞানী চম্‌িস্ক-উদ্ভাবিত 'সৃষ্টিশীল রূপাস্তরমূলক ব্যাকরণ' (ঃৎধহংভড়ৎসধঃরড়হধষ-মবহবৎধঃরাব মৎধসসধৎ -ঞএএ) তত্ত্বটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য হুমায়ুন আজাদ এই তত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ব তথা বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলার ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত করেন। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের নাম ছিল 'চৎড়হড়সরহধষরুধঃরড়হ রহ ইবহমধষর' (অর্থাৎ বাংলা সর্বনামীয়করণ)। পরবর্তীতে এটি একই শিরোনামের ইংরেজি বই আকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এর পর ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্বের ওপর বাক্যতত্ত্ব নামে একটি বাংলা বই প্রকাশ করেন। একই সালে তিনি বাংলা ভাষা শিরোনামে দুই খন্ডের একটি দালীলিক সঙ্কলন প্রকাশ করেন, যাতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের ওপর বিগত শতাধিক বছরের বিভিন্ন ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকের লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক রচনা সংকলিত হয়। এই তিনটি গ্রন্থ বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি পরবর্তীকালে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান ও অর্থবিজ্ঞানের ওপর দুটি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক লেখেন। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি বাংলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত অকাল মৃতু্যর কারণে তার এই আগ্রহ বাস্তবায়িত হতে পারেনি। (সূত্র- উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে)

হুমায়ুন আজাদ ভাষাবিজ্ঞানী ও গদ্যের জন্য বেশি জনপ্রিয় হলেও তিনি আমৃতু্য কাব্যচর্চা করে গেছেন। তিনি ষাটের দশকের কবিদের সমপর্যায়ী আধুনিক কবি। সমসাময়িক কালের পরিব্যাপ্ত হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, প্রেম ইত্যাদি তার কবিতার মূল উপাদান। নবম শ্রেণিতে পড়াকালেই কবিতাচর্চা শুরু করেন। তার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকের শিশুপাতা কচিকাঁচার আসরে। হুমায়ুন আজদের দশটি কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে: অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩), জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০), সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫),যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল (১৯৮৭), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩), আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৯৪),কাফনে মোড়া অশ্রম্ন বিন্দু (১৯৯৮), কাব্য সংগ্রহ (১৯৯৮), পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪)।

মূলত গবেষক ও প্রাবন্ধিক হলেও হুমায়ুন আজাদ ১৯৯০-এর দশকে একজন প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক হিসাবে আ্‌ত্মপ্রকাশ করেন। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে মৃতু্য পর্যন্ত তার প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৩টি। তার ভাষা দৃঢ়, কাহিনীর গঠন সংহতিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক দর্শন স্বতঃস্ফূর্ত। তার উপন্যাস- ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল (১৯৯৪), সব কিছু ভেঙে পড়ে (১৯৯৫), মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ (১৯৯৬), যাদুকরের মৃতু্য (১৯৯৬), শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার (১৯৯৭), রাজনীতিবিদগণ (১৯৯৮), কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ (১৯৯৯), নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু (২০০০), ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ (২০০১), শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা (২০০২), ১০,০০০, এবং আরো একটি ধর্ষণ (২০০৩), একটি খুনের স্বপ্ন (২০০৪), পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪)।

আশির দশকের শেষভাগ থেকে হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের সমসাময়িক ও রাজনীতি নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য ও লিখতে শুরু করেন। এ সময় তিনি সাপ্তাহিক 'খবরের কাগজ' পত্রিকায় নিবন্ধ লিখতে শুরু করেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা দিয়ে তার রাজনৈতিক লেখালেখির সূত্রপাত। তার প্রকাশিত আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম গ্রন্থটি মূলত রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক সমালোচনা। তার প্রবন্ধগ্রন্থসমূহ হচ্ছে- শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্যপ্রবন্ধ (১৯৮৮), ভাষা-আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি (১৯৯০), নারী (১৯৯২), প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে (১৯৯২), নিবিড় নীলিমা (১৯৯২), মাতাল তরণী (১৯৯২), নরকে অনন্ত ঋতু (১৯৯২), জলপাই রঙের অন্ধকার (১৯৯২), রবীন্দ্র প্রবন্ধ/রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা (১৯৯৩), শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা (১৯৯৩), সীমাবদ্ধতার সূত্র (১৯৯৩), আধার ও আধেয় (১৯৯৩), আমার অবিশ্বাস (১৯৯৭), পার্বত্য চট্টগ্রাম : সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা (১৯৯৭), মহাবিশ্ব (২০০০), দ্বিতীয় লিঙ্গ (মূল : সিমোন দ্য বোভোয়ার, ২০০১), আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম (২০০৩), ধর্মানভূতির উপকথা ও অন্যান্য (২০০৪)।

\হতার নারী (১৯৯২), দ্বিতীয় লিঙ্গ (২০০১) এবং পাকসার জমিন সাদবাদ (২০০৪) গ্রন্থ তিনটি বিতর্কের ঝড় তোলে এবং নারী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়। ২০০৪ সালের ৭ আগস্ট জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে হুমায়ুন আজাদ জার্মানি যান। ১১ আগস্ট আকস্মিকভাবে মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। পরদিন ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

আলোচনা থেকেই এটাই প্রমাণিত হয় যে,সাহিত্যক্ষেত্রের সর্বত্র হুমায়ুন আজাদের পদচারণা ছিল। প্রবন্ধ এবং গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে যা দিয়েছেন অনেকে তা পারেননি। শুদ্ধ ভাষার দখল ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ দেখানোর মতো লোক ছিলেন তিনি। তার মতো ক্ষণজন্মা ভাষাবিজ্ঞানী বাংলা ভাষা কবে পাবে কিংবা আদৌ পাবে কিনা সন্দেহ আছে!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<47632 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1