ওসমানী উদ্যানের উত্তর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে সদানন্দের-বাগানটাকে মানষে নষ্ট কইরা ফেললো। নিজের ভালো তো শুয়োরেও বোঝে, খালি তুরা বুঝলি না রে।-তার কণ্ঠে হাহাকার ঝরে পড়ে। তারপর হাতে ধরা সুদৃশ্য খাবারের প্যাকেটটি উঁচিয়ে চোখের সামনে ধরল সদানন্দ। তার চোখ আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পা বাড়ায় সামনে। কয়েক মিনিট হাঁটার পর একটা জারুল গাছের নিচে এসে থামে সে। চারপাশটা একবার দেখে হাত চারেক দূরত্বে সরে এসে চোখ ওপরে তুলে বিড়বিড় করে-কাউয়াগুলানরে বিশ্বাস নাই, কোন সময় পুচ কইরা মাইরা দেয়!
এ জায়গাটা নিরাপদ ভেবে হাঁটু ভাঁজ করে দীর্ঘসবুজ ঘাসের ওপর বসল। তারপর গভীর দৃষ্টি দিয়ে হাতের প্যাকেটটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল। এ সময় পাশের গাছের নিচু ডালে বসা কাকটি কা-কা স্বরে ডেকে ওঠে। তাকাতেই দেখল কাকটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কাকটিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, কোনো লাভ হবে না ভাইপো, ভালোয় ভালোয় কাইট্টা পড়।-যেন কাকটিও তার কথা বুঝতে পেরে আরেকবার কা কা স্বরে ডেকে উঠল। সে কঠিন কয়েকটা কথা বলতে গিয়েও নিজেকে সংযত করে। সে জানে, মাথা ঠান্ডা রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। অযথা কাক সম্প্রদায়কে খেপিয়ে কাজ নেই। কাকদের একেবারে যে পছন্দ করেন না তা নয়। 'কাক কালো হলেও ভালো'-কথাটা সে প্রায়ই বলে।
মনোযোগ ফেরায় প্যাকেটটির দিকে। রঙিন চারকোনা শক্ত কাগজের বক্সটির দিকে চেয়ে তার চোখের তারা যেন নেচে উঠতে চাইছে। মনে মনে বলে, কী সুন্দর প্যাকেট! তার মনে হলো-খালি প্যাকেটটার দামই তো ম্যালা!
বক্সটির শরীরজুড়ে রঙিন ফিতা দিয়ে পেঁচানো। খুব সাবধানে ফিতা খুলে আনে। তারপর বাঁ হাতের চার আঙুলে ফিতাটিকে পেঁচিয়ে প্যান্টের পকেটে রেখে দেয়; যেন মহামূল্যবান জিনিস। তারপর দুই হাতের তালু বার দুয়েক ঘষা দিয়ে ডান হাতের তালু চোখের সামনে মেলে ধরে নিশ্চিত হয়-হাত তার পরিষ্কারই আছে। তারপর বক্সটির ওপরের অংশ খুলে ফেলে। আবিষ্ট হয়ে চেয়ে থাকে, বুঝতে পারছে না- ভেতরে ভাত, মাছ, মাংস নাকি অন্য কিছু। ডান হাত বাড়াতে গিয়েও গুটিয়ে নেয়। তারপর স্বগতোক্তি করে-ধীরে সদানন্দ, ধীরে! এত দামি খাওন এত তাড়াতাড়ি শেষ করবি?
সদানন্দ গালে হাত দিয়ে খাবারের প্যাকেটটির দিকে তাকিয়ে আছে। সে চলে যায় ফ্ল্যাশব্যাকে। চোখের সামনে একটার পর একটা দৃশ্য ভেসে উঠছে-
সদানন্দের চোখের সামনে দিয়ে নাচাতে নাচাতে কত দিন এমন প্যাকেট নিয়ে গেছে অফিসের দাপুটে পিয়ন, মেজাজি ক্লিনার শ্রেণির কর্মচারীগুলো। কতদিন তাকে শুনতে হয়েছে-সদানন্দ, তুমি অফিসে থাকো, আজ আমরা বাইরে খেতে যাব। সদানন্দ মনে মনে বলত, আমি থাকমু নাতো কে থাকবো? দারোয়ানের কামই তো পাহারা দেয়া। সেসময়ও সে জানতো না-বাইরে এরা কী খেতে যায়? ভাত, মাছ নাকি পোলাও-কোরমা? এ ছাড়া পৃথিবীতে মানষের আর কী খাওনের আছে?-ভেবে পায় না সে।
অনেক দিন কানে এসেছে-আজ অফিসের সবাই 'চাইনিজ' খেতে যাবে। কার যেন জন্মদিন। সে হেসে কুটিকুটি-এরা কি বাচ্চা পোলা-পাইন। সে এটাও ভেবে পায় না-চাইনিজ আবার খাবে কেমন কইরা? তার কাছে 'চাইনিজ' মানে 'চীন দেশের মানুষ'। শুনে সে সিদ্ধান্ত নেয়-একদিন আমিও চাইনিজ খামু! কিন্তু মুশকিল হলো, চাইনিজ কোথায় পাওয়া যায়, দাম কত! কিছুই তার জানা নেই। আবার সাহসও হয় না কারোর কাছে জানতে। যদি বলে বসে-ব্যাটা দারোয়ান, দারোয়ানের মতো থাক। তোর শখ তো কম না। তোর বেতন কত?-ভেতরে ভেতরে দমে যায় সদানন্দ। কিন্তু কানের মধ্যে কয়েকদিন পর পর 'চাইনিজ চাইনিজ' শুনতে শুনতে কান পচে যাওয়ার জোগাড়। ঠিক করে-চাইনিজ না ফাইনিজ জীবনে অন্তত একবার হইলেও খাবো।
আজ সদানন্দের সাপ্তহিক ছুটি। সবচেয়ে পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে বাসা থেকে বের হলো। কপালে যাই থাকুক 'চাইনিজ' তাকে খেতে হবে। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে চাইনিজের হদিস পেল। চাইনিজ রেস্টুরেন্টের গেট থেকে ঢোকার সময় দারোয়ান তাকে আড়চোখে দেখলেও 'স্যার' সম্বোধন করে সালাম ঠুকলো। সে দারোয়ানের ঘাড় ছুঁয়ে বলে, ওরে আমিও তুমার মতন দারোয়ান। আমাকে স্যারও বুলতে হবে না, সালামও দেয়া লাগবে না। তারপর অবাক হওয়া দারোয়ানকে রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে নিজেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভেতরে ঢুকেই বুকের মধ্যে ভয় ধরে। কেমন ভুতুড়ে পরিবেশ। একজনকে সামনে পেয়ে বলে, আমাকে এক প্যাকেট চাইনিজ দ্যান। লোকটি মুখের হাসি চাপা দিয়ে বলে, স্যার, আপনি বসুন পিস্নজ। তিনি দ্রম্নত বলেন, না না এখানে বসে খামু না। বাইন্ধা দেন, বাসায় নিয়া খামু। তাকে আরও কয়েকটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো কিন্তু সে একটারও উত্তর দিতে পারেনি। তাকে অপেক্ষা করতে বললে তার আশঙ্কা হলো, এরা বুঝি তাকে নিরাশ করে ফিরিয়ে দেবে। শেষমেশ অপেক্ষার প্রহর ফুরালে সে দাম মিটিয়ে বাইরে পা রাখে। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ভেতরে বড্ড হাঁস-ফাঁস লাগছিল। বাইরে বের হয়ে এসেই তার নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ ধরে-কী দরকার আছিল লুভ দেখানোর! এক মাসের বেতন তো জলেই ভাইসা গেল। তার একবার ইচ্ছে করছিল প্যাকেটটি ড্রেনে ফেলে দেয়।
বাস্তবে ফেরে সে। কাকটি আরেকবার ডেকে উঠল। কাকটি ঘাড় বাঁকিয়ে সদানন্দকে দেখছে। হয়তো কাকটি বলতে চাচ্ছে-সামনে খাওন লইয়া বইসা ভাব দেহানোর মানে কী? তুমি চেটেপুটে খেয়ে আমার জন্য দু-চারটে রাখো! সদানন্দ সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে খাবারের দিকে হাত বাড়ালো। জীবনে প্রথমবারের মতো 'চাইনিজ খাবার' খেতে যাচ্ছে সে...। হাত রাখতেই টের পায় খাবারটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তবু মুখে তোলার মুহূর্তে মাথার ওপরে কাকটি আবারও ডেকে উঠল। সদানন্দ তাকাতেই দেখতে পায়-তার সামনে একটি কালো কুকুর হাঁটু মুড়ে বসে আছে। সদানন্দের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মনে মনে বলে, মেহমান আরাকজন আইছে...। তারপর কুকুরটির চোখে চোখ রেখে বলে, বুঝছি তুমিও জীবনে প্রথমবার চাইনিজ খাইতে চাও। সদানন্দ ওখান থেকে সরে আরেকটু দূরে গিয়ে বসল। সুযোগ পেয়ে কুকুরটি আর দেরি করে না, মুখ বসিয়ে দেয় বক্সটির ভেতর। কাকটিও গাছ থেকে নেমে পড়েছে। ভয়ে ভয়ে ছোঁ-মারার সুযোগ খুঁজছে।
পাশ থেকে সদানন্দ কুকুর আর কাকটির চাইনিজ ভক্ষণের দৃশ্যটি চরম মুগ্ধতা নিয়ে দেখতে লাগল...