শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ

তারাপদ আচার্য্য
  ১০ মে ২০১৯, ০০:০০

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সম্পাদক, চিত্রশিল্পী, শিক্ষা-সংস্কারক ও সমাজসেবক ছিলেন। তিনি বাংলাভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং বাঙালি জাতির অহঙ্কার। রবীন্দ্রনাথ যতগুলো কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন গীতাঞ্জলি তার অন্যতম। মূলত এই কাব্যগ্রন্থই তাকে বিশ্বব্যাপী সাহিত্যখ্যাতি এনে দেয়। তার জীবনবোধ, জীবনচেতনা, জীবনোপলব্ধি ও জীবন জিজ্ঞাসা এবং জীবনের গভীরতা সবই এই কাব্য গ্রন্থের মধ্যে নিহিত। মানবজাতির সমস্ত প্রেরণার ছোঁয়া তার এই গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে রয়েছে। গীতাঞ্জলির গীতি কবিতাগুলো একটি মহত্তর ও উন্নত সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। ধর্ম আর দর্শনের গভীর সম্মিলন ঘটেছে তার কবিতায়। এগুলো মূলত গান। এ ছাড়াও এগুলো সৃষ্টির চেতনাসমৃদ্ধ গীত রসে ভরপুর। গীতের মাধ্যমে স্রষ্টার উদ্দেশে অঞ্জলি প্রদান করা হয় বলে এর নাম গীতাঞ্জলি। এই কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ১৫৭। এর বেশিরভাগ কবিতা রবীন্দ্রনাথই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এবং অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা নিয়ে তিনি সং অফারিংস নাম দেন। মাত্র তের বছর বয়সে যে রবীন্দ্রনাথ শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ অনুবাদ করতে চেষ্টা করেন, তিনিই একান্ন বছর বয়সে নিজের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। অবশ্য অনুবাদের ব্যাপারে তিনি তেমন আশাবাদী ছিলেন না।

ইংরেজিতে লিরিক এর প্রতিশব্দরূপে বাংলায় গীতিকবিতা বা গীতিকাব্য কথাটি ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন গ্রিক লেখকরা বীণা বাদনের সঙ্গে পরিবেশিত কবিতা বা গানকে লিরিক বলতেন। একজন গীতি কবি তার কবিতায় প্রধানত অন্তরের আবেগ-অনুভূতি তুলে ধরেন। গীতিকবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন- 'গীতিকবিতায় একটি মাত্র ভাব জমিয়া মুক্তার মতো টলটল করিয়া ওঠে, আর বড় বড় কাব্যে ভাবের সম্মিলিত সঙ্ঘ ঝর্ণায় ঝরিয়া পড়িতে থাকে।' তবে একথা সত্য যে গীতি কবিতায় একাধিক ভাবকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না। বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান প্রমুখ বাংলা গীতিকবিতার ভুবনকে উলেস্নখযোগ্যভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথই বেশি কাজ করেছেন এবং বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন।

গীতাঞ্জলি প্রথম বাংলায় প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ইংল্যান্ড ভ্রমণের সময় গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেন ১৯১২ সালে। গ্রন্থাকারে তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলির নাম দিয়েছিলেন সং অফারিংস। ইংরেজিতে গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু আইরিশ কবি ডবিস্নউ বি ইয়েটস অতি যত্ন সহকারে গভীর মমত্ববোধ ও আগ্রহ নিয়ে এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখে দেন। গীতাঞ্জলি প্রথমে লন্ডনে প্রকাশ পায়। এরপর ১৯১৩ অর্থাৎ একই বছর ইউরোপে পরপর তিনটি সংস্করণ প্রকাশ পায়। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে, গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। অবশ্য ইয়েটস নোবেল পুরস্কার পান ১৮২৩ সালে। এশিয়া মহাদেশে রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম সাহিত্যে নোবেল পান। তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়েছে। চীনে গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেছিলেন জি বিং জিন, বাই কাওয়ানসহ আরো অনেকে। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে তার জীবনবোধ, প্রেমবোধ, নিঃসর্গ চেতনা, সৌন্দর্য বোধ, মানবাত্মা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধির প্রকাশ। পাশাপাশি তার মানবতাবাদ ও ঈশ্বর বন্দনা অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে। গীতাঞ্জলি ইংরেজি কাব্য গ্রন্থের শতবর্ষ পালিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য এক গর্বের বিষয়।

সম্পাদক হিসেবেও রবীন্দ্রনাথের কোনো জুড়ি ছিল না। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী থেকে যে কয়টি কাগজ প্রকাশিত হয়, তার সবগুলোরই রবীন্দ্রনাথ প্রধান লেখক ছিলেন, কিছু কিছু কাগজের সম্পাদক ছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথকে পারিবারিক কারণেই কিছু পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করতে হয়েছিল।

স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রনাথকে পূর্ব বাংলায় নিষিদ্ধ করার বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক। তখন রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে মুসলিম প্রধান পূর্ব বাংলায় তার গান-কবিতা নিষিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছিল। কিন্তু এ দেশের প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা, কর্মীরা তা রুখে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যে ব্রাহ্ম এটা অনেকেই জানেন না।

আজ যে আমরা বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করি, রমনা বটমূলে যে ছায়ানটের অনুষ্ঠান হয়, সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে শুরু করা হয়। ওই দিন দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কেবল পহেলা বৈশাখ কিংবা রবীন্দ্র জন্ম মৃতু্য দিবসেই নয় প্রায় প্রতিদিনই রবীন্দ্রনাথের গান বাজে। দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে রবীন্দ্রনাথ অবশ্য-পাঠ্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি পরাধীন জাতির মুক্তির চিন্তা প্রথম থেকেই করেছেন। তিনি বাংলার অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী মনীষী। স্বদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে তিনি কেবল অনুধাবনই করেননি, ভবিষ্যতের মঙ্গলামঙ্গল ও উত্তরণের সম্ভাবনার আলোকে তাকে বিচারও করে দেখেছেন। দৃষ্টি হয়তো অনেকেরই ছিল; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো অন্তর্দৃষ্টি ছিল না তাদের। সে কারণে সমসাময়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বাহ্যিক প্রলেপ লাগানো কৃষি সমাজের ভেতরের ক্ষতটি দেখতে পাননি। রবীন্দ্রনাথই প্রথম দেশের মানুষদের দিকে যথার্থ সহমর্মী চোখে তাকান, পীড়িত হন এবং সেই পীড়ন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় অনুসন্ধান করে ফেরেন।

আজ এ কথা বলতেই হয় যে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি দরদ ও ভালোবাসা ক'জন লেখকের আছে। জমিদার-নন্দন হয়ে বাংলার পথে প্রান্তরে নদী তীরে ধুলোমলিন কৃষকের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর কী এমন দায় ঠেকা ছিল তার। তিনি লিখেছেন গোরার মতো উপন্যাস। সোনারতরী, বলাকার মতো কাব্যগ্রন্থ। আর সংগীতের তো তুলনায়ই নেই। মূলত দুইজন বাঙালির জন্য বাঙালিরা পৃথিবীব্যাপী পরিচিত লাভ করেছেন। একজন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অন্যজন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

পৃথিবীতে এমন অনেক ব্যক্তিই আছেন যারা কেবল ব্যক্তি নন, প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। বাংলা ভাষা সাহিত্য, সঙ্গীত যতদিন থাকবে, বাংলা নববর্ষ যতদিন থাকবে, ততদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন। তিন দেশের জাতীয় সঙ্গীত যার লেখা, যিনি সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন প্রায় একশ বছর আগে তিনি আমাদের নমস্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<48643 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1