বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
গ্রন্থালোচনা

পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ

মাহবুব আলম
  ১৭ মে ২০১৯, ০০:০০

'পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ' বইয়ের ভূমিকায় লেখক হায়দার আকবর খান রনো বলেছেন, '২০১৪ সালে একটি বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ' এই বিষয়ের ওপর নিয়মিত লেকচার দেবার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ করেছিল। কলা ও বিজ্ঞান উভয় অনুষদের সব বিভাগে এই বিষয়ের ওপর একটি বাধ্যতামূলক পেপারও আছে। তার ওপর পরীক্ষাও হয়। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে আমি তখন থেকে উপরোক্ত বিষয়ের ওপর ক্লাস নিয়ে আসছি। শিক্ষাদান করতে গিয়ে আমি দেখলাম যে এই বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক নেই। অথবা যা আছে তা আমার পছন্দমতো নয়। তাই আমি প্রতি লেকচারের পাশাপাশি আমার তৈরি নোটস ছাত্রদের জন্য সরবরাহ করে আসছি। সেই সব নোটস একত্রিত করে কিছু সংযোজন বিয়োজন করে এই গ্রন্থটি তৈরি করা হয়েছে। এটি দুই খন্ডে সম্পন্ন বই হবে। প্রথম খন্ডটিতে রয়েছে বাংলার মধ্যযুগ থেকে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনটি পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত ধারাবাহিক ইতিহাস।'

লেখক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের জন্য বইটি লিখলেও এই বই শুধু ছাত্রদের পরীক্ষা পাশের পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই বই একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। মধ্যযুগ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস রচনা করেছেন লেখক। এই বইয়ের পরিচ্ছেদ এক শুরু হয়েছে 'প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা এই শিরোনামে।' দুই খন্ডে প্রকাশিত এই বইয়ের ১ম খন্ডে রয়েছে ১৬টি পরিচ্ছেদ। ১৬টি পরিচ্ছেদের শিরোনামগুলো হচ্ছে- বাংলায় ইসলামের অভু্যদ্বয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ও বাংলা লুণ্ঠন, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণের বিভিন্ন পর্যায়, কৃষক বিদ্রোহ, সন্ন্যাস বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, তেলাঙ্গানা বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ, সিপাহি অভু্যত্থান, কংগ্রেস ও গান্ধীর আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টি ও শ্রমিক কৃষকের সংগ্রাম, এবং সাম্প্রদায়িকতা, পাকিস্তান আন্দোলন ও দেশভাগ। অর্থাৎ দীর্ঘ বছরের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। তবে এই ইতিহাস ব্যতিক্রমধর্মী পুরোপুরি ভিন্ন এক ইতিহাস। আগেই বলেছি সাধারণত আমরা যে ইতিহাস দেখি, পড়ি তাহলো রাজা-বাদশাদের ইতিহাস। কে কখন কীভাবে রাজা-বাদশা হলো, কীভাবে কতদিন শাসন করল, তার শাসনামলে তিনি প্রজাবৎসল ছিলেন না অত্যাচারী ছিলেন এই সব। এ বিষয়ে লেখক নিজেই বলেছেন 'আমি ইতিহাস বই লিখছি ঠিকই, কিন্তু তা পাঠ্যপুস্তক ধরনের বা গতানুগতিক ধরনের ইতিহাসের বই নয়। জনগণের চিন্তাচেতনা রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল তা তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে।'

সত্যিই তাই, এই বইতে লেখক সাধারণ মানুষের ইতিহাস লিখেছেন। যে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে। লড়াই করতে করতেই বেঁচে থাকে, সেই মানুষের ইতিহাস লিখেছেন। লিখেছেন সংগ্রামী আর সাহসী মানুষের ইতিহাস। যারা হার মানে না। যারা লড়াই সংগ্রাম করে সমাজকে এগিয়ে নেয়, মানুষকে সচেতন ও সাহসী করে তোলে। মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়, বাঁচতে শেখায়, সেই সব মানুষের ইতিহাস লিখেছেন। তাই তো এই বইতে গুরুত্ব পেয়েছে বিভিন্ন বিদ্রোহ, গণআন্দোলন ও সশস্ত্র আন্দোলনের কথা। আমাদের দেশের ইতিহাসে রাজা-মহারাজাদের গৌরবগাঁথা তুলে ধরা হয়। বলা হয় অমুক জমিদার ছিলেন দাপুটে জমিদার, তার দাপটে বাঘে-ছাগলে এক ঘাটে পানি খেত ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজতন্ত্রে রাজাই সব কিছু, ফলে সব ক্ষমতা তার হাতে। প্রজার কোনো ক্ষমতা নেই। প্রজা শুধু রাজ অনুগত থাকবে। রাজার আদেশ, নির্দেশ অনুযায়ী চলবে। এটাই রাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এর মধ্যেও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়েছে। এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইতিহাস সেইভাবে লিখিত হয়নি। তারপরও এ কাজটা হয়েছে। কাজটা করেছে সামান্য ক'জন মানুষ। সেই সামান্য ক'জন মানুষের অন্যতম হায়দার আকবর খান রনো।

এখানে একটা কথা বলা দরকার তা হলো- আমাদের দেশের ইতিহাস লিখেছেন মূলত পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদরা। এদের মধ্যে আবার অধিকাংশই ইংরেজ ইতিহাসবিদ। ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করে দীর্ঘদিন শাসন করেছে। শাসন না বলে রাজত্ব করেছে বলাই ভালো। এবং এটাই সঠিক। সেই ইংরেজ অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের লেখা ইতিহাস কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এর বাইরে এ দেশীয় যারা লিখেছেন তারা প্রায় সবাই ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির অনুগত, দাসানুদাস ছিলেন। তাদের চিন্তা-চেতনার মূলে ছিল এক ধরনের উপনেবিশক মানসিকতা। আর তাই তাদের লেখনিতে পুরো ভারতবর্ষে সাধারণ ধারণা তৈরি করা হয় যে, ইংরেজদের কল্যাণে ভারতবর্ষের মানুষ আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে। কিন্তু এটা মোটেও ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ শাসনের আগেই ভারতবর্ষে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে। এবং ভারতবর্ষ শিক্ষা-দীক্ষায়ও যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল। আর আর্থিক অবস্থাও খারাপ ছিল না। বরং ভারতবর্ষ ছিল সম্পদে ভরপুর। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয় লাভের পর লর্ড ক্লাইভ তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে মুর্শিদাবাদ শহরে প্রবেশ করে বিস্মিত হন। তিনি তার সহকর্মীদের বলেন 'এত বড় বড় দালান। এত লন্ডন শহরের চাইতেও বড় শহর'। এ কথা কোনো ভারতীয় ঐতিহাসিকের নয়, এটা ব্রিটিশ ঐতিহাসিকের গবেষণালব্ধ লেখা। এ থেকেই বোঝা যায় তৎকালীন বাংলা সম্পদে ভরপুর ছিল। আর একথা তো ব্যাপকভাবে প্রচারিত যে সেই সময় মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী জগৎশেঠের ধন-সম্পদ এত বেশি ছিল যে তা কোনো ইংরেজ কেন সেই সময়ের দুনিয়ায় অন্য কোনো ব্যবসায়ী চিন্তাও করতে পারতো না। আর যুদ্ধাস্ত্র ও প্রযুক্তির কথা যদি বলেন তাহলে বলতে হয় বিশ্বে প্রথম রকেট প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয় এই ভারতবর্ষে; মহীশুরে, টিপু সুলতানের শাসনামলে। আর ঢাকার মসলিন ছিল জগদ্বিখ্যাত। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের অনেকে মনে করেন ইংরেজরা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। এ বিষয়ে ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি উক্তি উলেস্নখযোগ্য। ইংরেজরা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে এই বক্তব্য সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন ইংরেজদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি শুধু রেলগাড়ি আর ইংরেজি ভাষা।

রাজস্ব আদায় প্রসঙ্গে লেখক ঐতিহাসিক প্রমাণাদি দিয়ে লিখেছেন 'প্রাচীন ও মধ্যযুগে কৃষকের উৎপন্ন ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ খাজনা হিসেবে সামন্ত প্রভুকে দিতে হতো। শেরশাহ ও আকবরের আমলে তা এক-তৃতীয়াংশে বৃদ্ধি পায়। পরে তা অর্ধেকেরও বেশি পর্যন্ত ধার্য করা হয়েছিল।' প্রজারা এই অত্যাচার সব সময় সর্বক্ষেত্রে মুখ বুজে মেনে নেয়নি। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিদ্রোহ করেছে। লেখক সেই বিদ্রোহের কাহিনী লিখেছেন। লেখক হায়দার আকবর খান রনো একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক। তাই তিনি শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করে এই ইতিহাস রচনা করেছেন। এবং তা সার্বিকভাবেই সম্পন্ন করেছেন।

এই বইয়ের বিভিন্ন বিষয় ধরে আলোচনা করলে এই লেখার পরিধি অনেক বড় হয়ে যাবে তাই বইয়ের প্রথম খন্ডের শেষ পরিচ্ছেদ 'সাম্প্রদায়িকতা, পাকিস্তান আন্দোলন ও দেশভাগ' নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে লেখার সমাপ্তি টানতে চাই। তার আগে একটা বিষয় না তুললেই নয় তাহলো দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গ। আগেই বলেছি এ বই রাজা-মহারাজাদের ইতিহাস নয়, এই বই জনগণের ইতিহাস, জনগণের সুখ-দুঃখ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও সংগ্রামের ইতিহাস। তাই এই বইতে লেখক খুব সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও দুর্ভিক্ষের বিষয়ে যা বলেছেন তা উলেস্নখ না করলেই নয়। লেখক বইয়ের প্রায় শুরুতে লিখেছেন, ইংরেজদের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ফলে বাংলায় দেখা দিয়েছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। যাকে বলা হয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৭০-১৭৭১ সাল)। মাত্র নয় মাসের মধ্যে বাংলার তিন কোটি জনগণের মধ্যে এক কোটি না খেয়ে মারা যায়। এখানে উলেস্নখ্য যে, মন্বন্তর যখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তখনও কোম্পানির রাজস্ব আদায় ছিল আগের বছরের তুলনায় ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেশি। এবং তার পরের বছর খাজনা আদায় হয়েছিল আরও ১৩ লাখ টাকা বেশি। (টাকার পরিমাণটি সেই সময়ের মুদ্রামান বিবেচনায় রেখে হিসেব করতে হবে।)

সাম্প্রদায়িকতা, পাকিস্তান আন্দোলন ও দেশভাগ প্রসঙ্গে লেখক দেশভাগের জন্য ব্রিটিশ শাসকদের ভাগ কর, শাসন কর নীতিকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন ধূর্ত ব্রিটিশরা দু'শ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি দিয়ে। ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময়ও তারা ওই নীতিই অনুসরণ করে। এ ক্ষেত্রে জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতে হিন্দু-মুসলিম দুই জাত ইংরেজদের হাতে মোক্ষম অস্ত্র তুলে দেয়। সেই সঙ্গে কংগ্রেসের নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও ক্ষমতার লোভ ইংরেজদের এ বিষয়ে আরও উৎসাহী করে তোলে। '৪৬-এর হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্রিটিশদের এ ক্ষেত্রে আরও একটা চমৎকার সুযোগ এনে দেয়। এই ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান শত শত বছর ধরে এক সঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করেছে। কিন্তু কখনোই রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। যা হয় '৪৬ সালে। এক কলকাতাতেই পাঁচ হাজার মানুষের মৃতু্য হয়। এই দাঙ্গার সূচনা হয় ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট জিন্নার ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে'তে। পাকিস্তান দাবি আদায়ের জন্য জিন্নাহ ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘোষণা করেন। কিন্তু কার বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন তা তিনি পরিষ্কার করেননি। তবে দেখা গেল এই অ্যাকশন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নয় বরং স্বদেশী ভ্রাতা হিন্দুদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে লেখক লিখেছেন, সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা ১৬ আগস্ট সরকারি ছুটি ঘোষণা দিলেন। সেই দিন সকালবেলা মুসলিম জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা সৈয়দ নওশের আলীর বাসায়ও মুসলিম লীগের গুন্ডারা আক্রমণ চালিয়েছিল। খবর পেয়ে নিকটবর্তী হিন্দু পাড়ার যুবকরা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে এসে শেষ মুহূর্তে নওশের আলীর পরিবারকে রক্ষা করে। সেদিন বিকালে মুসলিম লীগের জনসভায় সোহরাওয়ার্দী চরম হিন্দু বিদ্বেষী উত্তেজনাময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সকালবেলা থেকেই মুসলিম লীগাররা সশস্ত্র মহড়া দিতে থাকে। অবশ্য বিষয়টি একেবারে একতরফা ছিল না। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে এবং সোহরাওয়ার্দীর কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু গুন্ডা এবং তাদের নেতারা প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ... কলকাতায় মুসলমানের চেয়ে হিন্দুর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই হিন্দুর চেয়ে মুসলমানই মারা গেছে বেশি। চরম সাম্প্রদায়িক ও নিরুদ্বিগ্ন কংগ্রেস নেতা প্যাটেল এই বীভৎস বিষয়টিকে এভাবে মূল্যায়ন করেন, 'হিন্দুরা এতে তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান হয়েছে'। হিন্দু-মুসলমান উভয় দলের সাম্প্রদায়িক নেতারা, প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এবং ব্রিটিশ রাজ (যাদের নীতি ছিল উরারফব ধহফ জঁষব) সবাই এই দাঙ্গার জন্য কমবেশি দায়ী। ইতিহাসবিদ জয়া চ্যাটার্জি লিখেছেন, 'এই রক্তক্ষরণের দায়িত্বের অনেকটাই বহন করেন সোহরাওয়ার্দী নিজে; কারণ তিনি হিন্দুদের প্রতি খোলা চ্যালেঞ্জ দেন এবং দাঙ্গা শুরু হওয়া মাত্রই তা দমনে সন্দেহজনক অবহেলার (ইচ্ছাকৃত বা অন্য কারণে) কারণে ব্যর্থ হন।' এই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। পাঞ্জাবে শিখ আর মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছিল। দাঙ্গা প্রতিরোধ করার জন্য গান্ধী আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন এবং ছোটাছুটি করে বেড়িয়েছেন। তিনি ছুটে গেছেন নোয়াখালীতে (যেখানে মুসলমানরা হিন্দুদের হত্যা করেছে) এবং বিহারে (যেখানে হিন্দুরা মুসলমানদের হত্যা করেছে)। এই দাঙ্গার আসল ফল হলো এই যে, দেশ বিভাগ অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে।

শেষ পর্যন্ত দেশ ভাগ হয়। বাংলা ভাগ হয়। ভাগ হয় পাঞ্জাব। এই দেশ ভাগের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যে যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী অন্যতম, বিশেষ করে দায়ী তার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, এ বিষয়টা সাধারণভাবে আলোচিত হয় না। আলোচনা হয় দেশ ভাগের জন্য জিন্নাহ, নেহরু, প্যাটেলরাই দায়ী। যা হোক লেখক ইতিহাসের নির্মম সত্যকে নিখুঁদভাবে তুলে ধরেছেন তার পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ বইতে।

হায়দার আকবর খান রনোর এই ইতিহাস গ্রন্থ ছাত্রদের জন্য লেখা হলেও এই গ্রন্থ ছাত্র, যুবকসহ সব বয়সের সবার পাঠ উপযোগী একটি অসাধারণ সুখপাঠ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থ ছাত্রদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্যও একটি আবশ্যিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ এই গ্রন্থটি পড়লে বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের অন্যকোনো ইতিহাসের বই না পড়লেও চলবে।

আমি এ গ্রন্থের ব্যাপক প্রচার আশা করি। আশা করি এ গ্রন্থ সর্বমহলে সমাদৃত হবে। এ গ্রন্থের প্রথম খন্ডের মূল্য ধরা হয়েছে ৪২৫ টাকা। ২৭২ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে পল্টনের সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ছায়াবীথি। সবশেষে বইটির প্রচ্ছদের প্রশংসা না করে উপায় নেই। বইয়ের নাম পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ হলেও বইটির প্রচ্ছদে পলাশীর যুদ্ধ বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নয় প্রচ্ছদে রয়েছে মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, মাস্টার দা সূর্য সেন, তিতুমীর, ঝাঁসির রানী লক্ষ্ণী বাঈ, প্রীতিলতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল ও বেগম রোকেয়ার ছবি। যা রীতিমতো চিন্তার খোরাক জোগায়। এজন্য বইটির প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রম্নব এষকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<49705 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1