বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনের জয়গানে তুমি কাজী নজরুল ইসলাম

মনিরা মিতা
  ২৪ মে ২০১৯, ০০:০০

একজন লড়াকু ব্যক্তি যিনি হার মানিয়েছিলেন সময়কে, দুর্ভাগ্যকে, স্থান-কাল পরিস্থিতিকে, যিনি বাজিয়েছিলেন বাঁশি, লিখছেন গল্প, কবিতা, গান- যাকে অনেকগুলি অভিধায় অভিহিত করা হয়- বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, ইসলামী কবি, আমাদের জাতীয় কবি। যিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, নাট্যকর, সংগীতজ্ঞ ও বাঙালি মণীষার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন, হঁ্যা তিনি আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে অভিজ্ঞতার উৎসরণে নজরুল তার সৃষ্টিকে ঋদ্ধ করেছেন, প্রাণবন্ত করেছেন, করেছেন স্মরণীয়।

একটি রাজনৈতিক অস্থির পরিবেশ নরুলের জন্ম, সাহিত্যঙ্গনে এগিয়ে চলা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমস্যা, সংকট, হতাশা নিদারুণভাবে প্রভাবিত করে নজরুলকে। নিজেই অস্ত্র হাতে চলে গেলেন যুদ্ধে। সেখানে তিনি দেখেছেন আপামর জনসাধারণের দুঃখ জর্জরিত লাঞ্চিত-বঞ্চিত জীবন। পরাধীনতার শৃঙ্খলে ডুবে থাকা মানুষগুলোকে নাড়া দিতে তিনি গেয়ে শুনালেন আবেগময়ী ভাষার উত্তাল তরঙ্গ। "আজ সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে" মোর সুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে আজ সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে।

নজরুল ছিল অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তার প্রকাশ। জেলে বন্দি হয়েও তিনি লেখেন "রাজবন্দির জবানবন্দি" এখানে সম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। লিখেছেন ৩০০০ গান- যা নজরুলসংগীত নামে পরিচিত। কবি লেখাতে যেমন ছিলেন বিদ্রোহী, তেমনি জীবনেও। মানুষের মাঝে শাসকগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিপস্নবাত্মক চেতনাকে গতিশীল করার জন্য নজরুল তার কাব্যে অগ্নি ঝরাতে লাগলেন। সকল বাধা পেরিয়ে তিনি গেয়ে উঠলেন-

"কারার ঐ লৌহ কপাট

ভেঙে ফেল, করবে লোপাট

রক্ত জমাট

শিকল পূজা পাষাণবেদী !"

তার কবিতায় শৈল্পিক কোমলতার চেয়ে মানুষের কথা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছিল বেশি, তিনি লিখেছেন সকল ধর্মের, বর্ণের, জাতির মানুষের জন্য। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করেছেন। তাই তিনি বলেন-

"মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,

এই খানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়"

নজরুল ছিল তারুণ্যের কবি। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি তরুণদের আহ্বান করেছেন বারবার।

"যৌবনের গান" প্রবন্ধে তিনি তারুণ্যের বন্দনা করেছেন-

"আপনাদের তারুণদের প্রতি আমার অপরিসীম ভালোবাসা, প্রাণের টান, তারুণ্যকে, যৌবনকে, আমি যেদিন হইতে গান গাহিতে শিখিয়াছি সেই দিন হইতে বারে বারে সালাম করিয়াছি, সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করিয়াছি, জবা কুসুম সঙ্কাশ তরুণ অরুণকে দেখিয়া প্রথম মানব যেমন করিয়া সশ্রদ্ধ নমস্কার করিয়া ছিলেন, আমার প্রথম জাগরণ প্রভাতে তেমনি সশ্রদ্ধ বিস্ময় লইয়া যৌবনকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি, তাহার স্তবগান গাহিয়াছি।

বার্ধক্য তাহাই যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃতকে আঁকাড়িয়া পড়িয়া থাকে। বৃদ্ধা তাহারাই যাহারা মায়াচ্ছন্ন নব মানবের অভিনব জয়যাত্রার শুধু বোঝা নয়, বিঘ্ন।"

তিনি তার কবিতায় নারীকে দিয়েছেন মানুষের মর্যাদা। নারীকে যেখানে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়, ঘরের কোণে বন্দি করে রাখা হয় নজরুল সেখানে নারীকে দিয়েছেন পুরুষের সমান অধিকার। নারীকে মর্যাদা দিতে তিনি লিখিয়েছেন

"সাম্যের গান গাই-

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভোদাভেদ নাই,

বিশ্বে যা কিছু মহান চিরকল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"

কখনও বা তিনি আপন মনে গেয়ে উঠেছেন।

"মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী

আর হাতে রণ-তূর্য"-

এই বিস্ময়কর দ্বৈতসত্তার অন্যায়ের বিরুদ্ধ বিদ্রোহী এবং মানবতার হৃদয় সংবেদী প্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। "জ্যেষ্ঠের ঝড়" হয়ে তিনি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি বাংলা কাব্যের প্রচলিত অঙ্গন। কী কবিতায়, কী গানে, গল্পে সর্বত্রই মানবমুক্তির প্রেমময় বাণী, দ্রোহের বাণী ঝঙ্কৃত হয়েছে তার সৃষ্টিতে।

মধ্য বয়সে তিনি 'পিক্‌স ডিজিজে' আক্রান্ত হয়। এর ফলে অমৃতু্য তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়, হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্য।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সবকারের আমন্ত্রণে সপরিবারে তিনি ঢাকা আসেন, দেয়া হয় জাতীয়তা। মৃতু্যর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে তাকে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়।

নজরুল অমর তার সৃষ্টিতে, বেঁচে থাকবে মানুষের জীবনে। সমাজে সমস্যা ঘুরেফিরে আসে, সময়ের ব্যবধানে সমাধানও হয়। জীবনের এই কর্ষণে নজরুল তার আবেদন নিয়ে বারেবারে ফিরে আসে- "সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে।"

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50751 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1