শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অনুশোচনা

দালান জাহান
  ২১ জুন ২০১৯, ০০:০০

বৃদ্ধটি বটগাছের নিচেই বসে থাকে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতে। অথচ গত এক বছর আগেও এখানে এমন কেউ ছিল না। এই বৃদ্ধ এখানে আশার আগেও এই বটের গুঁড়ি অথবা ডালে লাল নীল ফিতা বেঁধে গেছে কত জানা অজানা মানুষ। কিন্তু বৃদ্ধ আশার পরেই সৃষ্টি হয়েছে যত বিপত্তি। যারা মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার আশায় এখানে ফিতা বাঁধতে আসেন তাদের বাধা দেন এই বৃদ্ধ। তাদের মধ্যে একজন হলো সৈয়দ সালাম। তার সঙ্গে বেঁধে গেল বৃদ্ধের বড় বিপত্তি। সালাম সাহেব ফিতা বাঁধতে আসতেই বৃদ্ধ খুব চটে গেলেন। তার মাথার অর্ধ সাদা চুলগুলো আলপিনের মতো দাঁড়িয়ে গেল। বৃদ্ধ চোখ লাল করে সৈয়দ সাহেবকে বললেন, 'তুই তো হজ করে এসেই বিয়ে করবি'। 'তুই কেন ফিতা বাঁধতে এসেছিস'? কিন্তু সৈয়দ সাহেবের কাছে এই কথাটা মনঃপূত নয়। তিনি কিছুতেই বৃদ্ধের এহেন আচরণ মেনে নিতে পারছেন না। ইতোমধ্যেই সে নানা হয়েছেন ঘরে স্ত্রী আছে যে কি না সৈয়দ সাহেবের দশ বছরের ছোট আর এখনও সে যতেষ্ঠ যৌবনা। ওড়ে এসে জুড়ে বসা বৃদ্ধের এসব আজগুবি কথা সৈয়দ সাহেব মেনে নিতে পারলেন না। এই এলাকায় তার একটা আধিপত্য আছে, সুনাম আছে। এলাকার দশজন তাকে মান্যগণ্যও করে। তাই তিনি ঠিক করলেন গ্রামের সবাইকে ডেকে এই বৃদ্ধার একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। কথামতো একদিন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বট গাছটির তলায় উপস্থিত হলেন। তার মধ্যে একজন ছিলেন কায়সার চৌধুরী নামেও প্রভাবশালী ব্যক্তি। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ কটূক্তি করে বললেন, 'এসব ভন্ডামি এখন আর চলে না।' এসব ধান্দাবাজি বন্ধ করতে হবে। এরপর সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই ভন্ড বৃদ্ধকে এখান থেকে তাড়াতে হবে। বৃদ্ধ তখন একা একা হাসছিলেন আর এমনভাবে হাত দিয়ে তার পাকা দাড়িতে আঁচড় দিচ্ছিলেন যেন নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। হঠাৎ বৃদ্ধটি উঠে দাঁড়ালেন এবং উচ্চস্বরে কায়সারকে লক্ষ্যে করে বললেন, 'আগামী শুক্রবার তোমার মেয়ের বিয়ে হবে' কায়সার উঠে দাঁড়ালেন এবং বিস্ময়পূর্ণ চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কারণ তিনি একজন কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা- যার মেয়ের বয়স তেত্রিশ পার হলেও এখনও বিয়ে হচ্ছে না। কিন্তু সে কখনও মেযের বিয়ের জন্য ফিতা বাঁধতে আসেনি।

তখন সবাই সিদ্ধান্ত নিল আগামী শুক্রবার মেয়েটার বিয়ে হয় কিনা তা দেখতে হবে। তারপর বৃদ্ধের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। যদি এই আইবুড়ো মেয়ের বিয়ে হয় তাহলে বৃদ্ধের সব কথা মেনে নেব আর যদি না হয় তখন বৃদ্ধের ব্যবস্থা আছে। পরের শুক্রবার হঠাৎ করেই মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল এক ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে। কন্যার পিতা কায়সার চৌধুরী আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিভিন্ন উপহার নিয়ে বটতলায় হাজির হলেন। কিন্তু বৃদ্ধ কোথায়? তার চিহ্নও খোঁজে পাওয়া গেল না। শুধু বটের নিচে তার বিছানাটা পড়ে আছে। একজন বলে উঠলো কামেল লোক ছিল তাকে তোমরা চিনতে পারলে না। এই বলে সবাই চলে যাচ্ছিল।

তখন হঠাৎ বাতাস ঠেলে সামনের দিকে ভেসে আসল বৃদ্ধের ভেজা ভেজা কণ্ঠ। কায়সার চোখ উপুড় করে উপরে তাকাতেই দেখল বৃদ্ধ মগডালে উঠে বসে আছেন। কায়ার বৃদ্ধকে নেমে আসার মিনতি জানালেন কিন্তু বৃদ্ধ বলল, 'আমি তোমার জন্যই এখানে উঠে এসেছি'। 'আমি তোমার কোনো কিছু গ্রহণ করতে এখানে আসিনি'। 'বরং তোমার কি লাগবে আমার কাছে চাইতে পার '! 'তুমি চলে যাও এবং তোমার ছোট ভাইয়ের হক আদায় কর'। 'এরপর তোমার হারানো ছেলেও ফিরে আসবে'। এবার মেয়েটির বাবা তার ভুল বোঝতে পারল। কিন্তু এটাও ভাবলো যে, এতসব সে জানলো কী করে! তার সঙ্গের লোকজনও একটা লম্বা নিঃশ্বাসের রেখা টানলো মনে এবং সমস্বরে বলল, হুম কথা ঠিক। এরপর সবাই মিলে সৈয়দ সাহেবকে হজে পাঠালেন। সৈয়দ সাহেব হজ্বে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর। তার স্ত্রী মারা গেল। সবাই হতবাক হলো আবার। বৃদ্ধ প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবেন এমন আশায় লাশ নিয়ে হাজির হলো বৃদ্ধের সামনে। সবাই যখন বৃদ্ধের কাছে মৃতের প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করছেন বৃদ্ধ তখন মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। যখন কেউ প্রিয়জন হারানোর শোকে পাথর হয়ে যান তেমনি একটা প্রতিমূর্তি বৃদ্ধের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। তারপর বৃদ্ধ তার পুঁটলা থেকে একটি রক্ত গোলাপ বের করে ছুড়ে মারলেন লাশের দিকে। সবাই ভাবলো লাশটা হয়তো প্রাণ ফিরে পেয়েছে, জেগে উঠবে এখন। কিন্তু না তেমন কিছু হলো না। বৃদ্ধ বললেন, অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি কারও প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখি না। জীবিত কালে সৈয়দ সাহেব তার প্রতি যথেষ্ঠ অবজ্ঞা এবং অবহেলা করেছেন, যে কারণে এই মহিলার মৃতু্য হয়েছে। কিন্তু কায়সার চৌধুরীর মনের শান্তি শেষ হয়ে গেল। ফিরে আসতে লাগলো অতীতের কুয়াশামাখা স্মৃতি। যে স্মৃতি শুধু ভিজিয়ে যায় না ভাসিয়েও নিয়ে যায় সর্বনাশা সমুদ্রের মতো। ক্রমে ক্রমে কায়সার চৌধুরী ফিরে গেলেন তিরিশ বছর আগের সময়ে। যখন ছিল তার টগবগে যৌবন। শক্তি এবং ক্ষমতার দাপটে এমন কিছু নেই যে সে করেননি। সবকিছুই এখন তার চোখে বায়ুস্কোপের মতো ভাসছে। একটা ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাস তার নাক ভেদ করে চলে গেছে পাকস্থলিতে। কায়সার ব্যথায় ছটফট করতে লাগলেন। কায়সার অনুভব করলেন বাতাস তো নয় যেন আস্ত একটা মানুষ ফুটবল খেলছেন তার পেটে। তিনি ব্যথায় অস্থির হয়ে গেলেন এবং একপর্যায়ে কায়সার প্রচন্ড রকম বমিও করলেন। বমির সঙ্গে বের হয়ে এলো রক্ত মিশ্রিত কতগুলো কয়েন। কায়সার স্বস্তি পেলেন কমেও গেল পেটের ব্যথা। কিন্তু হঠাৎ ১৩০ ডেসিবলের মতো প্রকান্ড শব্দ হলো যেন একটি জেট বিমান তার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বের হয়ে চলে গেছে। কায়সার আবার নিজের অজান্তেই জ্ঞান হারালেন। যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে অনুভব করলেন একটা শীতল ছায়া তার চারপাশে তৃত্তাকারে ঘুরছে। কানে ভেসে আসছে দৌড়বাজ ঘোড়ার দুরন্ত খুঁড়ের শব্দ। কায়সার চোখ কচলে ভালো করে সামনে তাকাতেই, আরও আশ্চর্য হলেন। জনশূন্য এক জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। একটি ব্যাঙ নিজের চেয়ে দশগুণ বড় আস্ত একটি সাপকে গিলে ফেলছে। একটি ফুল পলকে পলকে পরিবর্তন হচ্ছে চারটি রঙে। কি সব হচ্ছে আমার সঙ্গে! লতাপাতায় পরিপূর্ণ এত ঘন জঙ্গল তো এখন কোথাও নেই। ভয়ে অস্থির কায়সারের কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ভয়ে ভরা ঘাম। হঠাৎ একটু দূরে ভালো করে তাকিয়ে দে দেখলেন অত্যন্ত অভিমানে ভরা মুখ নিয়ে একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসে আছে তার ছোট ভাই। যাকে তিরিশ বছর আগে বাঁশ কাটার কথা বলে নিয়ে এসে সৈয়দ সালাম এবং সে মিলে হত্যা করেছিলেন এমনই এক ঘন জঙ্গলে। কায়সার ভাবলেন স্বপ্ন দেখছি নাতো! সে নিজের শরীরে চিমটি কাটলেন, কিন্তু ব্যথা অনুভূত হলে বোঝলেন এ স্বপ্ন নয় বাস্তব। কিন্তু এটাও ভাবলেন

এতদিন পরেও তাকে এত তরুণ লাগছে কেন? তাহলে সে কি মরেনি? আর না মরলেও তো তার বয়স বাড়ার কথা! কায়সার তার ছোট ভাইয়ের দিকে যেতে পা-বাড়াতেই লোকটা হাত তোলে তাকে অগ্রসর হতে মানা করলেন এবং স্পষ্টভাবে বললেন, 'তুমি তো আমাকে অনেক বছর আগেই মেরে ফেলেছ আমি সেই অবস্থায় আছি।' আমার বয়সের কোনো পরিবর্তন হবে না। 'তুমি আমার কাছে এসো না আর আসলেও আমাকে ছুঁতে পারবে না'। আরও বললেন, 'কি ভাবছ ভাই? আমি এখনও যুবক আছি কী করে? 'নিজের দিকে তাকাও তুমিও যুবক সেই স্বার্থান্বেষী কায়ার'! কায়সার এবার নিজের শরীরে তাকালেন মুখে হাত দিলেন কিন্তু কোথাও তার বয়সের ছাপ পেলেন না; মুখের দাড়িগুলো হাওয়া হয়ে গেছে। সমস্ত শরীরে সেই তিরিশ বছর আগের যৌবনের আমেজ। কায়সার যেন কোনোভাবে নিজের থেকে সরে এসেছেন। কোথা থেকে কোথাও চলে এসেছেন কিন্তু কিছুই সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ কোনো কিছু পাওয়ার মতো সব ঘটনা মনে পড়ল কায়সারের। একটি মেয়ের কারণে সৈয়দ সালামের ষড়যন্ত্রে সৎ বড় ভাইকে হত্যা করে ওই মেয়ের সঙ্গে সৈয়দ সালামের বিয়ে দেয়া এবং ছোট সৎ ভাইয়ের সম্পত্তি গ্রাস করা এবং পরবর্তী সময়ে ছোট ভাইকে নিখোঁজ বলে চালিয়ে দেয়া। এই সব কিছুই এখন মনে পড়ছে তার। একটু পর আরেকটা ঝিরঝির ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। সঙ্গে টিপ টিপ বৃষ্টি। কায়ার ভিজে টয়টুম্বর হলেও তার ছোট ভাইয়ের শরীরে একফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে না। তখন তার ছোট ভাই আবার তার দিকে তাকালেন এবং চোখ বড় করে হাসলেন। হাসতে হাসতে ঢুকে গেলেন ওই চার রঙা ফুলটির ভেতরে। এদিকে সাপখেকু ব্যাঙটি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছেন কায়সারের দিকে। কায়সার আবারও ভয়ে জ্ঞান হারালেন।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন হাসপাতালের বিছানায়। তার হারানো ছেলেও ফিরে এসেছেন; তার স্ত্রী, কন্যা, কন্যার জামাই সবাই তার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। কায়সার সবার দিকে তাকালেন তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। কিন্তু কায়সার কাউকে চিনতে পারলেন না। তার স্ত্রী পুত্র আত্মীয়রা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। সমস্ত কান্নার ভিড় ঠেলে কায়সার দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন সেই বটতলার দিকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<54498 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1