শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রজ্বল স্বপ্ন

জীম হামযাহ
  ১৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

আট দশ গেরামের পোলাপানদের ত্যাদড় নাচ নাচিয়ে, সবার চোখে ধুলো দিয়ে সাবিনা যে শেষে রুবেলের সঙ্গে ভাগিয়া যাবে এমনটা কেউ একটি বারও ভাবেনি। এমন খবর শোনার পর সবাই থতমত! হিসেবের মধ্যে অনেক হেভিওয়েটরা থাকলেও কোনোভাবেই তিন গেরাম পরের গেরামের আরকুম আলির পোলা রুবেল কারও গুনতির মধ্যে ছিল না। হ্যাংলা লিকলিকে কালো লম্বা গড়নের রুবেল মিয়াকে দেখতেও যেন চোখে লাগে না এমন। গেরামের সমবয়সীরা ঠাট্টা করে তারে ডাকে হিরো আলম। সেই রুবেল গত কয়েক মাস থেকে বাড়িতে থাকত না। একদিন বাড়ি ফিরলে সে জানায় ছুটিতে এসেছে। আবার চলে যাবে। এবং সে জানালো শহরের বড় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে সিকিউরিটি প্রধানের দায়িত্বে আছে। এমনকি তার হাতে এখন রাইফেলও থাকে।

একথা শুনে সবাই খিক খিক করে হাসে।

ঠিকমতো রাইফেল সামলাতে পারিছ তো?

রুবেল মুখের ওপর জবাব দেয়- শুধু রাইফেল কেন তোদের মতো পোলারে কোলে নিয়া ঘুরতে পারমু।

রিফাত কয়-বাহ, তোর তো চাকরি হয়েছে এবার মোটা দেখে কারও সঙ্গে তোর বিয়ে দিতে হবে।

রুবেল পাল্টা জবাব দেয়- তোদের মাথা ঘামাতে হবে না, আমার বউ মোটাই হবে দেখিস।

রুবেলের এসব কথা তখন সবাই ফানের তুপানে উড়িয়ে দিয়ে তাকে নিয়ে তারা ব্যাপক মশকরা করেছিল। আর সেই রুবেলই যে তাদের এমন তব্দা লাগিয়ে দেবে কে জানত?

প্রথমে কেউ কোনো কিনারা করতে পারছিল না। একে ওকে সন্দেহ আর কানাঘুষার একপর্যায়ে ঘটনার দু'দিনের মাথায় যখন জানলো তিন গেরামের পরের গেরামের হিরো আলমখ্যাত রুবেল সবাইকে ভিলেন বানিয়ে নায়ক হয়ে গেছে তখন সবার মাথায় একসঙ্গে যেন বৈশাখী ঠাডা পড়ল। উত্তরপাড়ার মঞ্জুর কপালে হাত দিয়া পাক খায় আর কয়-কুত্তায় কামড়াইছে, আমারে কুত্তায় কামড়াইছে! পশ্চিমগাঁয়ের লিটন মাথায় হাত দিয়ে ধপাস বসে পড়ে। লাগা গেরামের সোহেল কয় হায় হায় নিজে না খাইয়া তার পিছে আমার টিপিনের টাকা খরচ করছিলাম! চতুর কেউ কেউ লোক-লজ্জায় নিজেদের প্রকাশ না করে অন্যকে ঠাট্টার ছলে নিজেদের তৎক্ষণাৎ ঢাকতে শুরু করে। এমন ভাবে যে সাবিনারে তারা কোনোদিনই পাত্তা দিত না। সাবিনার সঙ্গে তাদের কোনোভাবেই যোগাযোগ ছিল না। তারা উল্টো অন্যদের দিকে আঙ্গুল দিয়ে কয়-হেদের এখন কী হইব? এই বলে তারা খিক খিক করে হাসে।

নিজেদের সব স্বপ্ন আর পরিকল্পনা এভাবে বানচাল করে দিবে সাবিনার মা-বাবাও চিন্তা করেননি। তারাও একেবারে জব্দ হয়ে গেলেন। সাবিনার মা কন- হারামজাদি করল কী, কী কপালরে কই নিয়া ডুবাইল! কত ভালো ভালো ঘর থেকে কত সায় সুন্দর পুলাপান পস্তাব নিয়া আইছিল, হেদেরও ফিরাইয়া দিছি। আর এখন...নিশ্চয় ঐ হারামজাদা আমার মেয়েরে জাদু-টুনা করে মাথা আউলাইয়া দিছে, না হলে...।

সাবিনার মায়ের এমন আহাজারিতে সাবিনার বাপ উল্টো সাবিনার মায়ের দিকে চেতে ওঠেন।

সব দোষ তোর। তুই লাই দিয়া দিয়া মেয়েরে নষ্ট করছোস। তুই সব নষ্টের মূল।

মেয়ের ভুলে নিজের ওপর এমন অপবাদ শুনে সাবিনার মাও সাবিনার বাপের প্রতি জ্বলে ওঠেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চেত চেত কথা চালাচালি চলতে থাকে। পাড়াপড়শি কেউ কেউ আগুনে ঘি ঢেলে আরও চেতিয়ে দেয়। সমুঝদার লোকে কয়-যা হইবার হইছে, বাদ দেও। এসব নিয়া নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা উচিৎ না। কথায় আছে- কপালের লিখন না যায় খন্ডন। বিয়া-শাদি এসব উপরের ফয়সালা। মানিয়া নেও, দুদিন পরে যার মাইয়্যা তার জামাই, আমরা মাঝপথে দুশমন হইয়া লাভ নাই...।

হিসেবে যে এত গড়মিল হবে মা-বাবা ঠাহরও করতে পারেননি। অথচ সাবিনারে নিয়া তাদের চোখে-মুখে কত মোহ ছিল। আগুনের মতো চোখ ধাঁধানো মেয়ে ছিল সাবিনা। এই মেয়ের কারণে তাদেরও ডিমান্ড ছিল বাড়তি। ভালো ভালো কয়েক জায়গা থেকে পস্তাব আসার পর বিয়ের বাজারে নিজেদের উচ্চ মর্যাদা সহজেই অনুধাবন করতে পারছিলেন। বাড়িতে ঘটকের পর ঘটক আসে। কনে দেখতে পাত্রের পর পাত্র আসে। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ প্রবাসী, কেউবা কোনো চাকরিজীবী। রসমালাই থেকে নিয়ে হরেক পদের মিষ্টি-মিটাই নিয়া আসে কনে দেখতে। সাবিনা আসিয়া যখন সামনে দাঁড়ায় তারা খেই হারিয়ে ফেলে। তাদের চোখে-মুখে ঘোর লাগে। সেই ঘোরে ঘোরে তাদের পকেটে হাত দেয়। তিন হাজার, পাঁচ হাজার হাতের আন্দাজে যা উঠে সাবিনারে দেয়। সালামি বাড়িয়ে দেয় যাতে সালামির দোষে পাত্রী হাতছাড়া হয়ে না যায়। সাবিনা হাসিমুখে টাকা হাতে নিয়ে সালাম দিয়ে কেটে পড়ে। তারপর পাত্র নাছোড় হয়ে লাগে ঘটকের পিছে। ঘটক লাগে সাবিনার বাপ-মায়ের পিছে। বাপ-মা কয়- হইবো না। লন্ডনি সিটিজেন পাত্র ছাড়া অন্য কারও হাতে দিমু না।

তাইলে দেখাইলেন যে?

দেখতে চাইলে কি আর না করতে পারি। দুই পক্ষের পছন্দ হইলেই তবে না বিয়ে।

লন্ডন থেকে আসবে কুমার লন্ডন নিয়া যাবে এমন ঘোরে যখন বিভোর, তাদের সেই মোহের ঘোরে রেখেই একরাতে রুবেলের হাত ধরে পালিয়ে গেল সাবিনা!

গেরামের মাইনস্যে কয়- অতি লোভে তাতি নষ্ট। বেশি খেলা ভালা নায়।

গেরামে ইউনিয়ন নির্বাচনের আলোচনা তুঙ্গে ওঠায় কয়েকদিনের মধ্যে সাবিনা আর রুবেলের আলোচনা ঝিমিয়ে আসে। ভুলতে পারে না উত্তরপাড়ার মঞ্জু, বিলপাড়ের সাদ্দাম, দক্ষিণগাঁয়ের সুমন, পশ্চিমের লিটন, এভাবে সামাদ, রিংকু, সোহেল তারা। তারা এখনো হিসাব মেলাতে পারে না। বসে বসে ঝিমায়। আর সাবিনার দেয়া এসএমএসগুলো আবার পাঠ করে।

কয়েকদিন পর মঞ্জু, সাদ্দাম, সুমন, লিটন তারা একদিন পরস্পর মুখোমুখি হলে কোনো কিছু না বলে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসে। এই কয়দিন আগেও তারা ছিল পরস্পর পরস্পরের শত্রম্নভাবাপন্ন। সন্দেহ আর অবিশ্বাসে কেউ কারও ছায়া দেখতে পারত না। সোহেল কয়, কী খেলাটা না খেললোরে। সাদ্দাম কয়, গেল তো গেল ওই রুবেইলস্নার সঙ্গে আর মানুষ পাইল না...। এ বলে তারা খিক খিক করে হেসে নিজেদের সব আফসোস বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বলে- আসলে আমাদের কারও মধ্যে কোনোদিনও কোনো ঝগড়া-বিবাদ ছিল না। এখনো নাই। মাঝখানে আমরা শয়তানের পালস্নায় পড়ছিলাম। আমাদেরও অনেক ভুল আছে। আমরা সবকিছু ভুলে আবার ভাই ভাই হয়ে যাই।

তারা পরস্পর একে অন্যের গলাগলি, বুকাবুকি করে দোকান থেকে এক ব্যাগ মুড়ি আর দুই পকেট চানাচুর কেনে। চানাচুরের পকেট ভেঙে মুড়িতে মাখাতে মাখাতে সবাই চলে যায় ভাঙা কালভার্টের দিকে। কালভার্টে বসে বসে তারা মুড়ি খায় আর গান ধরে। গানের এক লাইন প্যারোডি করে গায়-

অতীতের কথাগুলো, পুরনো স্মৃতিগুলো মনে মনে রাইখো

আমিতো ভালা নায় কালা লইয়াই থাইকো...।

তারা গান গাচ্ছিলো ঠিক এই সময়ে পশ্চিম গেরামের মৃণাল বাবু এ পথে আসতে আসতে তাদের সামনে থমকে দাঁড়ান। তারা তখন গান থামিয়ে মৃণাল বাবুর দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে- দাদা আপনি?

মৃণাল বাবু তার বাউল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলেন, 'হ আমি কিন্তু তুমরা ইখানে চিলস্নাই চিলস্নাইয়া কী গাইছো?'

দুঃখে গাইছি দাদা দুঃখে।

তোদেরও এই বয়সে দুঃখ! মৃণাল দাদা হাসেন।

আপনি বুঝি দাদা গাঁউ এলাকার কোন খবর রাখেন না? কী গেমটা না খেললো দাদা। আচ্ছা দাদা আপনিই কন, আর কি কোন মানুষ পাইলো না, রুবেলের মাঝে কী এমন দেখল?

মৃণাল দাদা তাদের দিকে পিটপিট তাকিয়ে তারপর গলা উঁচিয়ে কন- হ, এই কথা। এসব মনের কারসাজিরে দাদা, মনে মনে মিল হইলে অস্ট্রেলিয়া থাকিও উড়িয়া আইবো। মাঝে মাঝে তুমরা ফেসবুকে দ্যাখো না। আর মনে মনে যদি মিল না হয় জোর করি কিছু হয় না। জোরাজুরিতে গেলে সব্বনাশ! সব্বনাশ! কপাল পুড়বো...। তারপর মৃণাল দাদা বলেন আমি একখান গান গাই তুমরা শুনো। এই বলে তিনি আকাশের দিকে খানিক তাকিয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে কপালে হাত রেখে গলা ছাড়েন-

যদি থাকে নসিবে, আপনি আপনি আসিবে

জোর করে মন হরণ করো না...।

মৃণালদার গান তাদের প্রবলভাবে স্পর্শ করে। গানের ঘোরে তারা তন্ময় হারিয়ে যায়। মুখে কোনো বাক্য ফোটে না। গান শেষ হলেও রেশ রয়ে যায়। তারপর তারা সবাই ঘোর থেকে জেগে এক বাক্যে কয়- আপনি ঠিক কইছেন দাদা, সব নসিবের খেলা।

তাই বলে সবকিছুতে নসিবের ওপর ভর করি হাত-পা ছেড়ে দিলে হইব না চেষ্টাও করা লাগব। মৃণালদা চোখে চোখ রেখে তাদের দিকে একটু ঝুঁকে খানিকটা গম্ভীর স্বরে কন- তুমরারে একখান প্রশ্ন করি বুঝিয়া উত্তর দিবা, সিরিয়াসলি। আবারও কইছি সিরিয়াসলি!

মৃণালদার এই কথায় তাদের ঠোঁট ফাঁক করে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময় শেষে নিজেদের প্রস্তুত রেখে কয়- হ দাদা করেন।

তখন মৃণালদা কন- মনে করো তোমরা সবাইরে যদি তোদের বাপ-মা এখনই বিয়ে দিতে চায় তুমরা কি এখনই বিয়ে করতে প্রস্তুত? বুঝিয়া কও।

মৃণালদার এমন আচমকা কথায় সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাদের ঠোঁট আলগা হয়ে যায়। তারা আবারও একে অন্যের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে এনে নিজে নিজে ভাবে। তারা ভেবে দেখে যে আসলে বিয়ে করার সঙ্গতি তাদের এখনো আসেনি। তারা এখনো পড়ুয়া ছাত্র। লেখাপড়া করে তাদের অনেক দূর লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। ক্যারিয়ার গড়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে...। তাদের এখনো অনেক পথ বাকি।

মৃণালদা কন- শুন বাছাধনেরা! কল্পনার ভূগোলে বসি বসি নানা রঙ্গের ছবি আঁকা যায়। হরেক রঙ্গের খোয়াব দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিনরে মনা সব। বয়সের অভিজ্ঞতা বড় অভিজ্ঞতা। বয়স আমার কম হয়নি। তোমরা হইছো আমাদের ভবিষ্যৎ। একটা কথা কই শোনো, আগে নিজেরে গড়ো। নিজেরে গড়তে পারলে তুমরা না, দুনিয়া তুমরার পিছে পিছে ঘুরবো কইলাম। এখন তোমাদের সোনালি সময়। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও তুমাদের আরও অনেক কিছু শিখতে হইব, অনেক জ্ঞান অর্জন করতে হইব...। রাস্তা-ঘাটে না ঘুরিয়া সময়ের দাম দাও না হইলে একদিন পস্তাইবা কইলাম পস্তাইবা...। মৃণাল দার সম্মোহনী কথামালা মূহূর্তে যেন তাদের সম্বিতে টেনে টেনে নিজেদের নিজেরে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। এমন কথা আগে যে শোনেনি তাও নয়। এগুলো তারা জানতও বটে। কিন্তু এখন লাগছে কথাগুলো তারা এই নতুন করে শুনছে এবং মর্ম উপলব্ধি করতে পারছে। তখন তারা দেখল যে তাদের পরীক্ষা খুব সন্নিকটে কড়া নাড়ছে তাদের কোনো প্রস্তুতি নাই। তারা এখনো বই কেনেনি। তারা পড়ার টেবিলে বসে না। নিয়মিত কলেজেও যায় না। শুধু শুধু ফাউ সময় নষ্ট করছে। অথচ তাদের নিয়ে তাদের বাপ-মায়ের যত স্বপ্ন আর শ্রম।

তারা ভাবে। তারা ভাবনার গলি পথে ঘুরপাক খায়। পাক খেতে খেতে তাদের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ বিস্তার করল। তারপর সেই ছাপে হিসেব কষতে কষতে তারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এক তাজা এবং বেগবান স্বপ্নে!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<58790 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1