মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কফিন

অলোক আচার্য
  ০৯ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

রমিজ সাহেব দোকানের ক্যাশবাক্সের ওপর কিছুটা কাত হয়ে শুয়ে আছেন। তার চোখদুটো আধবোজা। মাঝে মাঝে চোখ খুলে পাশের একটি কফিনের দিকে দেখছেন। তার দোকানে বেশ কয়েকটি কফিন ছিল। সবগুলোই বিক্রি হয়েছে। কিন্তু একটা কফিন কোনোভাবেই বিক্রি করা যায়নি। এই কফিনটি কেন বিক্রি হচ্ছে না তাও বুঝতে পারছেন না। তিনি বহুবার নিজেই ক্রেতাদের কাছে এই কফিনটি বিক্রি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। এর পরেও কয়েকটি কফিন বানিয়ে বিক্রি করেছেন কিন্তু এই কফিনটি বিক্রি করতে পারেননি। তিনি কোনো মতেই বুঝতে পারছেন না কেন এই কফিনটি বিক্রি হচ্ছে না। তার দোকানের নাম শেষ বিদায় স্টোর। মানুষ মারা যাওয়ার পর যা যা দরকার সব এখানে আছে। কফিন থেকে শুরু করে সবকিছু। চুরির কোনো ভয় নেই। কারণ এসব দোকানের জিনিসপত্র সচরাচর কেউ চুরি করে না। ক্যাশবাক্সটা আগলে রাখলেই হলো। তার দোকানে দুজন কর্মচারী। তারা মাঝে মাখে রমিজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখছে। গত কয়েকদিন ধরেই তারা তাদের মালিককে এভাবে ঝিম মারা অবস্থায় দেখছে। কিছু হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দেয় না। কেবল তাকিয়ে থাকে। সেই দৃষ্টিতে কোনো রাগ নেই, উত্তর নেই। অনেকটা সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো দৃষ্টি। কারণ কিছুই জানে না। দোকানের মালিক এরকম ঝিম মেরে থাকলে ভালো লাগে না। মাঝে মধ্যে কুদ্দুস এটা দে কুদ্দুস ওটা দে বলে অর্ডার করে। তারপর আবার চুপ। আগে ঘন ঘন চা খেতো। এখন তাও খায় না। কিছু একটা যে হয়েছে এটা দোকানের কর্মচারী কুদ্দুস এবং বগা বুঝতে পারে। গত পাঁচ বছর ধরে দুজন এ দোকানে আছে। তবে রোগটা যে শরীরে না মনে সেটাই বুঝতে পারছে না। তাদের বোঝার কথাও না। একটি দুঃস্বপ্ন দেখে রমিজ সাহেবের এই অবস্থা হয়েছে। কাউকে তিনি বলেননি। তার পরিবারের কাউকেও না। ঘটনা হলো দিন সাতেক আগে রমিজ সাহেব একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। শেষ রাতের দিকে স্বপ্নে দেখলেন তিনি খালি হাতে কোথাও একটা যাচ্ছেন। একা। রাস্তার কোথাও কেউ নেই। এমনকি কোনো প্রাণীও চোখে পড়ল না। কিছু দূর যাওয়ার পর খেয়াল করলেন তার পরনে কোনো পোশাক নেই। কেমন কুয়াশা মতন জায়গা। একটু সামনে আর চোখে দেখা যায় না। তিনি সামনে এগুচ্ছেন। কেন সামনে যাচ্ছেন তাও বুঝতে পারছেন না। তার বোধ শক্তি যেন লোপ পেয়েছে। হঠাৎ দেখলেন সামনে সাদা কাপড়ে কিছু একটা ঢাকা পড়ে আছে। তিনি ভয়ে ভয়ে সামনে গেলেন। ঢাকনাটা সরাবেন, না সরাবেন না; মনে করেও তিনি সাদা কাপড়টা তুলে ফেললেন। যা দেখলেন তাতে তার অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়। অবিকল তার মতোই দেখতে একজনের লাশ সাদা কাপড়ে ঢাকা রয়েছে। তিনি প্রচন্ড ভয় পেলেন। পেছন ঘুরে তিনি দৌড় দিলেন। সামনে কি আছে না আছে তা দেখার সময় নেই। তিনি দৌড়াতে লাগলেন। একটা কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে তিনি পড়ে গেলেন। এ সময় তার ঘুম ভেঙে গেল। তার বিছানা ভিজে গেছে। রীতিমতো তিনি হাপাচ্ছেন। অন্যদিন পাশের টেবিলেই জল থাকে। আজ জল খেতে গিয়ে দেখলেন সেখানে জল নেই। তিনি তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকলেন কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তিনি আবার চোখ বুঁজে পরে রইলেন। সেদিন আর তিনি দোকানে গেলেন না। কিন্তু পরদিন থেকেই দোকানে গিয়ে তিনি মনমরা হয়ে বসে থাকেন। তার দৃষ্টি থাকে কফিনের দিকে। তারপর এই বিদঘুটে স্বপ্ন দেখার পর থেকে তিনি আরও মিইয়ে গেছেন।

এর মাসখানেক পরের ঘটনা। সেই কফিনটি কয়েকজন এসে নিয়ে গেল। একজনের লাশ গ্রামের বাড়িতে নেয়া হবে। তিনি আর কেউ নন। রমিজ সাহেব। তার চুপচাপ ভাব দেখে পরিবারের লোকজন তাকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিল। দিন পনেরো থেকে ফেরার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে। সেখানেই লাশ কবর দেয়া হবে। রমিজ সাহেবের দুই ছেলে আর দুই কর্মচারী মিলে টেনেটুনে তার লাশটা কফিনের ভেতর রেখে আটকে দিল। কেউ একজন বলে উঠলো,' তাড়াতাড়ি রওনা দেও, অনেক দূরের রাস্তা'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<61787 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1