শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লালন এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ

সাইফুদ্দিন সাইফুল
  ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

কালের আবর্তনে বর্তমান পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সভা-সেমিনারে বৈঠকে হরেক যুক্তিতে বক্তবে আর ইনিয়ে-বিনিয়ে আলোচনায় মহাত্মা ফকির লালন শাহকে বারবার কখনো একজন বাউল সম্রাট, কখনো আধ্যাত্মিক সাধক আবার কখনো একজন মরমি কবি ইত্যাদি হিসেবে বিভিন্ন নামে ভূষণে অভিহিত করে তুলে ধরা হয়েছে। আর এ বিষয়ে জোরেশোরে প্রচার-প্রচারণাও অতীতে করা হয়েছে এবং এখনো তা করা হচ্ছে। শুধু কি তাই! লালনকে কখনো কখনো বাউল সম্প্রদায়ের প্রবক্তা এবং বাউল ধর্মের রূপকাররূপেও অতীব জোর করে একটা খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানোরও চেষ্টা করা হয়েছে বা হচ্ছে। হঁ্যা! এটা ঠিক, যে বা যারা এই বিস্ময়কর দেহ-ভান্ডারে (লালনের ভাষায় রংমহল খানা) হাওয়া বা বাতাসের সন্ধানের মাধ্যমে অধরা পরমের সন্ধান পেতে চায়, আপনাকে সেই পরমাত্মার সঙ্গে মিলন ঘটাতে চায়; অপার প্রেমলীলায় একাকার হতে চায় তারাই হচ্ছে বাউল। সকাল-সন্ধ্যায় দিবানিশি আপনাকে সাধনার প্রেমরঙে রাঙিয়ে আশেক হয়ে প্রিয় মাওলার প্রতি (মনের মানুষ, অচিন পড়শী) মনোনিবেশ করে আত্মমগ্ন থেকে অধরাকে খোঁজা বা সন্ধানে একনিষ্ঠ সাধনা করে চলে তারাই বাউল সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।

অবশ্য বাউল মত ও পথের বিশ্বাসী মানুষ সাধারণত প্রচলিত ধর্ম হরেক প্রথা বা শাস্ত্রের প্রতি এতটা আনুগত্যশীল না অথবা তেমন বিশ্বাসীও না বা সেভাবে স্বীকারও করে না। তবে এই বাউলরা অত্যন্ত মানবিক সৎ এবং আদর্শবাদী জীবনযাপনের অধিকারী। সমাজে অন্য মানুষের থেকে এক ধরনের আলাদা জীবন-যাপন করে থাকে। আর সেই হিসেবে আমরা ফকির লালন শাহকে একজন সিদ্ধিপূর্ণ সাধক বাউল অথবা লোককবি বা মরমি বলতে পারি। কেননা, লালন ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন উচ্চমার্গের বাউল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সারাটি জীবনকাল ফকির লালন শাহ 'হাওয়া' সাধনার মধ্যদিয়ে অধরার সন্ধানে পারের পথ পার হয়ে অপারে যাওয়ার কঠিন সাধনায় আপনাকে তৈরি করেছিলেন।

ফকির লালন শাহ তাই তার কালামে বলেছেন-

'ধরো চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে,

সে কি সামান্য চোরা

ধরবি কোণ কানচিতে...'

এখানে জেনে রাখা অতীব গুরুত্ব যে, বাউল কোনো ধর্ম কিংবা ধর্মের নাম নয়; বাউল নিছকই একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের নাম। যদিও এই বাউলদের আবির্ভাব বিগত খ্রিস্টাব্দ ১৬৫০ শেষে বা ১৮০০ শতকের শুরুতে। লালন জন্মের বহুকাল আগেই এই সম্প্রদায়ের বা মতের প্রচলন ঘটেছে। একথা সত্যি যে, লালন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রচার অথবা প্রসার করার জন্য এই ধরাধামে আবির্ভাব হননি। যেহেতু জানি যে, 'ধৃ' শব্দ থেকে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি; আর এর আবিধানিক অর্থ হলো ধারণ করা। শাস্ত্র বলছে- 'পৃথিবীং ধর্মনাং ধৃতাং' অর্থাৎ এই পৃথিবীকে ধারণ করে আছে ধর্ম। পৃথিবীর বুকে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের সম্মুখে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ অসংখ্য এই কথিত 'ধর্ম' নামের বিষয়টি মানুষের বিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত। এদিকটা একটু দার্শনিক কিংবা চিন্তা ও বোধের জায়গা থেকে বিবেচনা করলে একদম স্পষ্ট হবে যে, ফকির লালন শাহের গুরুবাদী মতবাদটি উলিস্নখিত 'ধর্ম'র মতো কোনো ধর্ম নয়; ইহা একান্ত প্রেম, ভক্তি, সাধনা, মানবিকতা সর্বোপরি গুরু-শিষ্যের যুগল সাধনার প্রেমময় অমৃত ধারা। আর তাই তো এই গুরুবাদীতে সত্য কথা, সৎ কর্ম, সৎ উদ্দেশ্য, মানুষকে ভালোবাসা এবং জীবের প্রতি সদয় হওয়া'র মতো মানবের চরম গুণাবলিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একটু সহজ করে বলতে হয়, ইসলামের সুফিবাদ, বৌদ্ধ সহজীয়া মত ও বৈষ্ণব মতের গভীর সংমিশ্রণে এই গুরুবাদী দর্শন বা মতবাদের উদ্ভব। ফকির লালনের ধর্ম ও জাত-পাত নিয়ে ইদানীং অনেকেই এক অদৃশ্য অন্ধকারে হারানো কোনো বস্তু খোঁজার মতো অহেতুক মাতামাতিতে মেতে উঠেছে। লালনকে কথিত ধর্মের জালে আটকিয়ে বেঁধে ফেলার এক অশুভ পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন হলো! লালনকে নিয়ে কেন এই অযথা বাড়াবাড়ি বা সময়ক্ষেপণ? এর পেছনে কি তবে অন্য কোনো স্বার্থপরতা লুকিয়ে আছে? আমরা তা জানিনা। অথচ লালন তার দীর্ঘ জীবনে কখনো কোনোদিন কোনো সাধুসঙ্গে আলোচনায় তার ভক্ত শিষ্যদের কাছে বা তার অসংখ্য মহতী পদে নিজেকে হিন্দু-মুসলিম অথবা অন্য কোনো প্রচলিত ধর্মের মানুষ বলে এতটুকু পরিচয় দেননি। সত্যিটা এই যে, ফকির লালন শাহ ব্যক্তিগত জীবনে একটি বিশেষ মত-পথের বিশ্বাসী ও অনুসারী ছিলেন। আসলে লালন অত্যন্ত জেনে-বুঝে সচেতনভাবে তার প্রচলিত ধর্ম কি এবং তার সঠিক জন্মগত পরিচয় কি তাও গোপন করেছেন। যারা প্রকৃত বাউল মত-পথের বিশ্বাসী তারা সমাজে বিদ্যমান প্রচলিত ধর্ম বিশেষ করে লালন তার গানে এসবের তেমন কোনো ইঙ্গিত বা তথ্য তিনি সচেতনভাবে তুলে ধরেননি। তিনি একজন মানুষ, শুধুই মানুষ এই বিষয়টি তার কালামে সাবলীলভাবে উঠে এসেছে।

ফকির লালন সাইজি বলেছেন-

'সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন

লালন বলে আমার আমি

না জানি সন্ধান...'

লালন একজন দার্শনিক ও সমাজ চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন বলেই তিনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থা এবং দীর্ঘদিন হয়ে আসা বিভিন্ন কুসংস্কার কুপ্রথাগুলো বদলের পক্ষে লড়াই সংগ্রাম করেছেন ও তার মতকে ভাবকে প্রকাশ করেছেন। লালন মূলত একজন মহান দার্শনিক এবং কালের বিপস্নবী সন্তান ও বিরাট সমাজচিন্তক। আর এই জন্যই তার সব কালামের মধ্যে দার্শনিকতার ছোঁয়া স্পষ্ট। তাই ফকির লালন শাহকে বাংলারতো বটেই পৃথিবীর একজন খ্যাতনামা লৌকিক দার্শনিক বললে অবশ্যই ভুল হবে না। আর জাত-পাত-ধর্ম-শাস্ত্র গোত্র-বর্ণের বেড়াজাল ছিন্ন করে ঐকান্তিকভাবে মনে-প্রাণে বিশ্বাসে প্রেম-মানবতা শান্তির মহাবাণী মহাসুধা পরম অমৃতধারা মানুষ ও মানবতার তরে ছড়িয়ে দিয়ে লালন আজ বিশ্বকে মানবহৃদয়কে জয় করেছে। এমনি করেই লালন মানুষের জয়গান গেয়েছেন এবং মানুষের ভেতরে থাকা সেই সহজ মানুষকে খুঁজেছেন।

সাইজি বলেছেন-

'এই মানুষে সেই মানুষ আছে,

কত মুনি ঋষি-যোগী-তপস্বী

তারে খুঁজে বেড়াচ্ছে...'

লালন তার মানুষ সমাজ রাজনৈতিক সচেতনার ভাবনা, সমাজ পরিবর্তনের যে স্বপ্ন তিনি দেখতেন সে বিষয়গুলোকে তুলে ধরতে হবে। তৎকালীন সময়ে কুষ্টিয়া থেকে কাঙ্গাল হরিনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত 'গ্রামবার্তা প্রবেশিখা'য় রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী খবর, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা, সমাজপতি জমিদারদের অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে বক্তব্য নিয়মিত প্রকাশ হতো। আর লালন শাহ এসবকে সমর্থন করতেন, কাঙ্গালকে উৎসায়িত করতেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, লালন একজন সমাজ রাজনৈতিক সচেতন মানুষ ছিলেন। কেননা, লালন অন্যদের চেয়ে একেবারে আলাদা, তার ধ্যান-জ্ঞান চিন্তা-ভাবনা চেতনাবোধ বৈষয়িক বিষয়ে মূল্যায়ন অনেক বেশি গতিশীল ও বাস্তবমুখী। আমরা লালনের এসব বিষয়কে মূল্যায়ন করতে চাই, তার সঠিক ভাবনাকে চেতনার জায়গাকে পরিষ্কার করে যথাযথ প্রয়োগের দ্বারা উপকৃত হতে চাই। তবেই আমরা এই সমাজে যারা সমাজপতি সেজে ধোঁকা দিচ্ছে, সাধু, মোড়ল, মাতব্বর হয়ে মানুষকে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করছে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারব। গড়ে তুলতে পারব অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোময় দিন। অন্ধত্বে ঢাকা এই সমাজ ও সমাজের মানুষের কবল থেকে আপনাকে সতত মুক্ত রাখতে পারলেই দেহকে মনকে চেতনাকে অহর্নিশি চেতনজ্ঞানে জাগ্রত রাখা সম্ভবপর হবে।

লালন সাইজি তাই বললেন-

'এসব দেখি কানার হাটবাজার,

বেদ-বিধির পর শাস্ত্র কানা

আর এক কানা মন আমার...'

এই ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা অনেক অনেক কাল ধরে জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ, উঁচু-নিচু, ছোট-বড় ইত্যাদি অজুহাত তুলে বিভেদ সৃষ্টি করে আসছে। এখনো মানুষ হয়ে মানুষের মধ্যে অনেক বৈষম্য ও ভেদাভেদ। ধর্ম পরিচয়ে মানুষ একে অন্যের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে, দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করেও কেন জানি ধর্মের কারণে একজন অন্যজনের আপন হতে পারছে না। অথচ মহান স্রষ্টার কাছে মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই, সব মানুষকেই ভালোবেসে তিনি সৃষ্টি করেছেন। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আলো, বাতাস, পানি, মাটি, ছায়া দিতে মহান আলস্নাহ এতটুকু কার্পণ্য করেনি। আর আমরা মানুষ জাত-পাত টেনে ধর্ম পরিচয়ে আলাদা হচ্ছি। ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টি দিলে দেখতে পাবো যে, লালনের জীবনকালে অর্থাৎ উনিশ শতকের সময়ে যে ধর্মান্ধতার জয়জয়কার, অন্ধ বিশ্বাসের দৌরাত্ম্য, ধর্ম নিয়ে প্রচন্ড বাড়াবাড়ি, জাত-পাত-বর্ণ-গোত্রের ভেদাভেদ, মানুষে মানুষে বৈষম্য আর অন্ধ-বদ্ধ মিথ্যা গোঁড়ামিতে ভরপুর সমাজে বসবাস করে ফকির লালন আধুনিক যুগের মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে ভেবেছেন এবং সাধন-ভজন করেছেন।

লালন শাহ সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি তিনি আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ মানবিক মূল্যবোধ আর শ্রেণিসংগ্রামের মুক্তির জন্য এক বিপস্নবী মন নিয়ে সব অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। এই জন্য সমাজ সচেতন মুক্তচিন্তা ও রাজনৈতিক চিন্তার অধিকারী হয়ে লালন অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছিলেন।

তাই তো সাইজি তিনি তার কালামে বললেন-

'এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে,

\হযেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান

জাতি গোত্র নাহি রবে...'

মূলত লালন ছিলেন একান্তে রক্ত-মাংসে গড়া একজন সাধক পুরুষ। আপনাকে কঠিন সাধনার মধ্যে নিমজ্জিত রেখে আত্মারূপে পরমাত্মার সন্ধানে দীর্ঘ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে, চেতনজ্ঞানের অধিকারী হয়ে এই ভবদেহকে ঐকান্তিক সাধন-ভজনের পরম ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। মানুষের মধ্যেই পরমাত্মার আসন, দূরের গয়া-কাশী কাবা নয়, এই মানবদেহে আছে দিল-কাবা; আর সেখানেই শাইরূপে নিরঞ্জনের দেখা মেলে। লালন এই দেহ-সাধনার নিরিখেই মানুষের পূজা করেছেন। ফকির লালনের কালামের ভেতরে মানুষ ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে, প্রেম-আধ্যাত্মিকতা ভাব-সাধনা নিয়ে এবং আত্মা-পরমাত্মা বিষয়ে বস্তুবাদী দর্শনের আলোকে এক ধরনের মৌলিকতা সৃজনশীলতা নান্দনিকতা ও যুগ-চেতনার রূপ-রস ছন্দ ভাব-ভাষা প্রকাশ পেয়েছে। সাধক লালনের এই চেষ্টা-সাধনা আজ মানবকুলে ধন্য ধন্য সাড়া পড়েছে। জগতে মানুষই সব, মানুষের মধ্যেই সেই অধরা অসীম পরমাত্মা মহাজন দিব্য অধিষ্ঠিত; ফকির লালন শাহ এই কথাটিই তার কালামের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

সাইজি তাই বলেছেন-

ভজ মানুষের চরণ দুটি / নিত্য বস্তু পাবে খাঁটি

মরিলে শোধ হবে মাটি,

ত্বরায় এই ভেদ নাও জেনে...'

অনেককাল ধরেই এই সমাজের একশ্রেণির মানুষ ফকির লালন শাহকে একজন প্রচলিত ধর্মবিরোধী, সমাজবিরোধী, প্রথাবিরোধী, কাফের, নাস্তিক, মোরশেক এবং ভন্ড ইত্যাদি প্রচার করে আসছে। এখনো তা শরিয়ত বিশ্বাসী মানুষ না জেনে না বুঝে লালনকে সমানভাবে বিরোধিতা করেই চলেছে। অথচ লালন সম্পর্কে এরা একেবারে অজ্ঞ আর অন্ধ বিশ্বাসের ধোঁকায় পড়ে ধর্মকে পুঁজি করে সমাজকে আপনার হাতের মুঠোয় পুরে ক্ষমতাসীনদের সহযোগিতায় বিষোদগার করেই যাচ্ছে। সমাজের মানুষ সাধারণত পারিবারিক সামাজিকভাবে ধর্ম আর রাজনীতির মধ্যে বেড়ে ওঠে, এটিকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। লালন তাই সমাজের মধ্যে থেকে গুরুবাদী মতের পাশাপাশি প্রচলিত ধর্ম শাস্ত্রকে যুক্তির নিরিখে মেপে মূল্যায়ন করেছেন। উদাহরণ যে, এই দেহের চামড়া ছাড়া যেমন হাড়-মাংস রক্তের আশা করাটা যুক্তিহীন, তেমনি হাড়-মাংস রক্ত ছাড়াও চামড়া আশাটাও বোকামি। আর তাই শরিয়ত বাদ দিয়ে যেমন মারেফত হয় না, তেমনি মারেফত উপেক্ষা করে শরিয়ত পরিপূর্ণতা পায় না। ফকির লালন এজাতীয় সব সমস্যাটা ভালো করেই আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন বলেই তার পথও তিনি দেখিয়েছেন। লালন ধর্মবিরোধী নয, লালনের গানে ধর্মের অনেক বিষয় নান্দনিকভাবে প্রকাশমান। তবে ধর্মের গোঁড়ামি, ভন্ডামি, কুসংস্কার অন্ধত্বের বিপক্ষে কথা বলেছেন আর ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে তাদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদ করেছেন; লড়াই করেছেন।

মহাত্মা সাধক লালন বলেছেন-

'সুন্নত দিলে হয় মুসলমান / নারী লোকের কী হয় বিধান,

বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ/ বামনি চিনি কিসেরে...'

সমাজ সমাজের মানুষ অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়গুলোকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, কি করণীয় এবং বস্তুগতভাবে তা বাস্তব তৎপরতার মাধ্যমে প্রাধান্য দেয়ার নাম যেহেতু রাজনীতি; সেহেতু লালন তা ব্যক্তিগত সাধকজীবনে রাজনীতির চিন্তার বাইরে যাননি এবং তা গুরুত্বও দিয়েছেন। সমাজ উন্নয়নে পরিবর্তনে, সামাজিক পেক্ষাপট বদলে দেয়া, মানুষের চিন্তা-ভাবনা বোধ চেতনা জাগ্রত করা, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিতর জন্য সমষ্টিগতভাবে লড়াই সংগ্রাম করাটা যদি রাজনীতি হয়ে থাকে; তবে তা লালন সাইজি তার চিন্তায়-ভাবনায় সাধনায় করে দেখিয়েছেন। সমাজে মানুষের মুক্তি কিসে, মানুষ কীভাবে তার এই ভবনদী পার হতে পারবে তারই চিন্তা করেছেন ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। লালন সমাজে বঞ্চিত, অবহেলিত, শোষিত নিপীড়িত অধিকারহারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের পক্ষে কথা বলেছেন, তৎকালীন সময়ে সমাজে বিদ্যমান ছোট-বড়, উঁচু-নিচু, ধনী-গরিবের সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে লালন এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে নিজেকে একজন শ্রেণিসংগ্রামের আপসহীন সাহসী নেতা হিসেবে কালের সামনে তুলে ধরতে যারপরনায় অধিক সক্ষম হয়েছিলেন।

সমাজ সচেতন লালন তাই বলেছেন-

'কেমন ন্যায়-বিচারক খোদা/ বলো গো আমায়,

তাহা হলে ধনী-গরিব/ কেন এ ভুবনে রয়...'

এখানে একটি কথা বলতেই হচ্ছে যে, আসলেই কি আমরা লালনকে বুঝতে পেরেছি? তাকে চিনতে পেরেছি? বা তাকে প্রকৃতার্থে চেনার চেষ্টা করেছি? নাকি লালনকে শুধু একজন গুরুবাদী মানুষ হিসেবেই ভেবেছি! লালনকে একান্তে গুরুবাদী মানুষ মনে করে তাকে যেন কেন জানি তার অন্য পরিচয় থেকে বাদ দিয়ে কোথায় যেন ঠেলে ফেলে দিচ্ছি এবং খুবই খাটো করে ফেলছি। আসলে এখানেই আমাদের চরম সংকীর্ণতা রয়ে গেছে। মূলত লালনের রচিত সব কালামের মধ্যে অন্তর্নিহিত যে ভাব-ভাষা, কথা, চেতনজ্ঞানের আধ্যাত্মবাদের প্রকাশ পেয়েছে, সেটাকেই আপন মনে চিন্তা-চেতনায় ভাবে-ভাবনায় বোধে বিশ্বাসে এই জগৎময় দেহটার মধ্যে খুঁজে পাওয়ার মধ্যদিয়ে সাধনার দ্বারা মনের মানুষের সন্ধান পেলেই লালনকে আমরা বুঝতে পারব বা তাকে চিনতে সক্ষম হবো। আর তখনই হবে লালনের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস ও আত্মজ্ঞানের স্বার্থকতা। জয় হোক লালনের, জয় হোক গুরুবাদী দর্শনের, জয় হোক মানুষ ও বিশ্বমানবতার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<65520 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1