মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঘেসু

শওকত নূর
  ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ভাদ্রের গুমোটতা সন্নিকটেই। অথচ জায়গাটিকে তা খুব বেশি প্রভাবিত করে না। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর- এই তিন দিকে উঁচু ঘন আখের খেত; সম্মুখে অর্থাৎ দক্ষিণে এক চিলতে শান বাঁধানো জায়গা পেরিয়ে সগর্বে মাথা উঁচু করে আছে ঘন সবুজ ধনিচার বন। ভরদুপুরে বাতাসহীনতার সঙ্গে সূর্যের তেজ যুক্ত হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধের উপক্রম করা মাত্রই একরাশ শীতার্ত দুরন্ত বাতাস সুদূর নীলাকাশ থেকে উড়ে এসে ধনিচা বনের মাথায় ঘূর্ণি দিয়ে নিচে নেমে শান বাঁধানো জায়গাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দু'চারটা শুকনো পাটপাতা কিংবা সদ্য ঝরে পড়া হলদে ধনিচাপাতাকে আন্দোলিত করে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। হিন্দোল জাগায় সংলগ্ন একচালা কুটিরটির আপাদ-মস্তকে। কছির মাস্টার খোলা বুকে দরজায় দাঁড়িয়ে স্বস্তিতে চোখ বন্ধ করে। আহা কী প্রশান্তি! কী শীতলতা! কী স্বস্তি! খানিক চোখ বুজে থাকার পর চোখ খোলে সে। কোত্থেকে একঝাঁক জালালি কবুতর পত পত শব্দে উড়ে এসে শান বাঁধানো জায়গাটিতে আছড়ে পড়ে। শানের ওপর বুক ঠেকিয়ে খানিকটা চোখ বুজে থাকে। সম্বিতে ফিরে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে বাক বাকুম ছাড়ে। ক'দিন থেকে ভোর থেকেই কোত্থেকে একটা ছাগলছানাও এসে জোটে। ঘুরপাক ধরা কবুতর ঝাঁকের সঙ্গে সে-ও কী ভেবে কিছুক্ষণ পাক খায়। তারপর ক্লান্তিতে চার পা গুটিয়ে শুয়ে কছির মাস্টারের চোখে তার বিস্ময়ভরা দৃষ্টি ফেলে জাবর ধরে। কছির মাস্টার ওর বিস্মিত চোখের নজর দেখে নড়ে ওঠে। প্রয়াত পিতার কথা হু-হু করে তার স্মৃতিতে এসে আঘাত হানে। সে নিভৃত লজ্জায় মাথা নোয়ায়। শৈশবে পিতা তার নির্বুদ্ধিতা দৃষ্টান্তে তার বোধে খোঁচা দিতে এরই কাতারে তাকে নিয়মিত দাঁড় করাতো। চতুষ্পদের ওই বিস্ময়ভরা চোখ কোনো অলৌকিকতায় তার খোঁজ কি জানে? তাই কি তার ওভাবে চেয়ে থাকা? সে দরজা এঁটে ভেতরের চৌকিতে গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। ছাগলছানাটি বার দুই মৃদু ম্যা ম্যা শব্দে তাকে বিদায় সম্ভাষণ দিয়ে ধীর পায়ে জায়গাটি ছাড়ে।

নীলাকাশ থেকে দুরন্ত বাতাস নিত্যকার মতোই আছড়ে পড়ে শীতলতা ছেড়েছে, কোনো কবুতর ঝাঁক আসেনি; আসেনি ছাগলছানাটিও। অথবা এসে থাকলেও এরই মধ্যে সদলবলে উৎখাত হয়েছে তারা। সেদিন দরজা খুলে হকচকিয়ে যায় কছির মাস্টার। অন্যদিনের মতো দৃষ্টিতে আসছে না তাদের কেউই। একদল যুবক জায়গাটিতে বৃত্তাকারে বসে দেদার তাস চালাচ্ছে। সংখ্যায় তারা পাঁচ। একজন অবশ্য বৃত্ত ভেঙে একটু পেছনে অবস্থান নিয়েছে। গোমড়ামুখে গভীর মনোযোগ ধরে রেখে সে খেলা দেখায়। চারের অতিরিক্ত বিবেচনায় নিশ্চয়ই খেলায় নেয়া হয়নি তাকে। মিনিট দশেকের মতো তাদের কণ্ঠস্বর একেবারেই ফিসফিসানো পর্যায়ে থাকে। একটা দলছুট কবুতর হঠাৎ তাদের পাশেই উড়ে পড়ে ত্বরিত বাক বাকুম ধরায় তাকে তাড়ানো সূত্রে তারা হাই-হুট হুট শব্দে প্রথমবারের মতো গলা উঁচায়। তখনই বৃত্তছুট যুবক চাপাকণ্ঠে বলে, আস্তে, আস্তে। মাস্টার সাবের ডিস্টার্ব হইব। অন্য চারজনের মধ্যে যে সবচেয়ে তাগাড়া সে তৎক্ষণাৎ উত্তর ঝাড়ে, আরে চুপ যা, ঘেসু। গলাছিলস্নায় অহন জাগনা থাকে নাকি? বেড়ার ফাঁকে ফুঁচকি দিয়া দেখো ব্যাটায় তলা উদলা কইরা ঘুমাইতেছে। আর যে নাক ডাকানি রে, হেঃ হেঃ হেঃ।

হাসির রোল পড়ে গেলে কবুতরটা এক লাফে ধনিচা বনের মাথায় উঠে স্থির হতে চায়। ক্রমাগত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পৌঁছালে ধনিচার মাথা বেঁকে সে আবারও নিচে আছড়ে পড়তে গিয়ে পতপত শব্দে নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা ওদের মাথা বরাবর ঊর্ধ্বাকাশে উড়াল ধরে। ওদের একজন হা করে উপরে তাকিয়ে বলে, যা শালা মাঙ্গীর পুতে ডরাইয়া চৌঠা আছমানের পথ ধরছে, হিঃ হিঃ হিঃ। এবারে অন্যরাও খেলা ছেড়ে উপরে তাকায়, খুব শূন্যে দৃষ্টি। কবুতর জলন্ত সূর্যের দিকে উড়ছে। দ্রম্নত তাসে ফেরে তারা। এবারে মাটিতে তাস ছোড়ায় বেশ গতি এসেছে। ঘন ঘন শব্দ হচ্ছে; আগে মৌখিক, তারপর শানের ওপর : এই তর গোলামের..., আমার কাছে রঙের বিবি আছে না? আমার সাহেব, আরে আমার টেক্কা- থপ্‌ থপ্‌ থপ্‌। অশ্লীল কথায় হইচই বাধে। চারজনের একজনের পেট কামড়ি উঠেছে- গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা। সে উঠে যেতে উদ্যত হতেই অন্যরা টেনে ধরে। আরে না, যাবা কই? ইয়ার সময় ইয়া টান দিলে চলে? আরে বয় কইতাছি হালার ভাই, হালা। অহন উইঠা গেলে এক্কেরে খতম দিমু তরে। যেতে উদ্যত জন হাতে হ্যাচকা টান ফেলে চেঁচায়, আরে..., মশকারি করিস না। বিষে প্যাট ছিঁড়া যাইতেছে। পেট খালি হইছে তো। প্যাটে কিছু না দিলি পর ছ্যাদা হইয়া যাইব। ছাড় অহন। ঘেসুরে নিয়া খেল। অন্য তিনজন চেঁচায়, আরে রাখ তর ... এর ঘেসু। ধ্বজভঙ্গরে নিয়া খেলুম না। অরে নিয়া খেললে আমগোরও বউ থাকব না; ছাইড়া চইলা যাব। ঘেসু বাদ। যা ঘেসু যা, তুই বাদ। তুই জীবনের আসল খেলাই পারস না, আর তাস। যা অহন যা। গিয়া কবিরাজের সন্ধান করগা। চিটাগাঙ্গে একটা কবিরাজ আছে, নাম কবিরাজ আব্দুল করিম কবিরত্ন। এক্কেরে ষাইট বছইরারেও ষোল বছরের ফিট বানাইয়া দেয়। বিফলে মূল্য ফেরত। তর বউর তো অহনও অন্যত্র বিয়া হয় নাই। যদি ওষুধ খাইয়া ভালো হইতে পারস, ফিরাও আইতে পারে। যা, অহন আমরা তিনজনাই খেলব।

কথিত ঘেসুর মন খারাপ হয়ে যায়। সে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়। বেলার দিকে তাকিয়ে মাথা নামায়। ধনিচা বনের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। খেলার বৃত্তটা এখন ছোট হয়ে এসেছে। ওরা আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছে। এবারে তুরুপ পড়ার ফাঁকে একজন বলে, ঘেসুর আসলে কী হইছে রে?

কী আর হইব? হালায় একটা ধ্বজভঙ্গ। বউ কি আর অর রূপ-চেহারা দেইখ্যা থাকব। ছুরতও তো নাই হালার, হ্যান্ডেল মাইরা মাইরা হালায় সব খোয়াইছে।

কিন্তু হালায় ধ্বজভঙ্গ হইল ক্যামতেরে?

ক্যামতে আবার? কইলাম না হালায় বয়স হওনের পর থেইকাই অতিরিক্ত হ্যান্ডেল দিয়া দিয়া সব শেষ দিয়া ফালাইছে। অহন আর বউরে দিব কী? বউ কিছু না পাইয়া গ্যাছে গিয়া। হাঃ হাঃ হাঃ। হু হাঃ হাঃ হাঃ। হু হাঃ হাঃ হাঃ। খুক্‌ খুক্‌ খুক্‌ থুঃ। দূর! গলায় কাশ আটকাইছে। এত হাসন ঠিক না।

আমি তো হুনছি হালারে অতিরিক্ত স্বপ্নদোষে পাইছে। এই জন্যই হালারে ধ্বজভঙ্গে পাইছে। দ্বিতীয় জন বলে।

কিন্তু আমি তো হুনছি এই সব কোনো ব্যাপারই না। মুক্তার ডাক্তার আমারে সব খুইলা কইছে। এই সব নাকি জীবনের সাধারণ ব্যাপার। এই সব নিয়া অতিরিক্ত ভাবনা-চিন্তা কইরাও নাকি স্নায়ুবিক দুর্বলতা আয়। তাতেও নাকি সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু তা নাকি সাময়িক। ওই যে হাই স্কুলের দেয়ালের পোস্টারে সব লেখা আছে যে। পড়স নাই? তরা তো আবার গন্ডা মূর্খ। চৌদ্দগুষ্টিত পড়ালেখা নাই।

কিন্তু ঘেসুর বউ যদি আর ফিরা না আয়, অর কী হইত? হালায় সারা জীবন কানা হইয়া থাকত না? হালার ঘেসু। ঘেসুরে ঘেসু, থুক্‌। হালা গন্ডা মূর্খ।

চল অহন উঠি। মুক্তার ডাক্তারের লগে ঘেসুর ব্যাপারে আলাপ পাইড়া আমরা সব পরে জাইনা লমু। আমগোরও জানার দরকার আছে।

চল অহন, চল। গলাছিলার ঘুম ভাঙনের সময় হইছে। হুঃ হুঃ হুঃ হুঃ। খুক্‌।

ভূমি থেকে আধো হাত উঁচু চৌকিটা নড়বড়ে। ওয়ারবিহীন বালিশটা দলপাকানো জীর্ণ কাঁথায় ফেলে তারই উপরে হাঁটু গেড়ে বসে কছির মাস্টার। কোনোমতে গলা উঁচিয়ে মুখমন্ডল ধরে রাখে বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা আয়নায়। পেছনে প্রলেপ ক্ষয়ে যাওয়া আয়নায় এমনিতে মুখমন্ডল খুব স্পষ্টমতো ফুটে ওঠে না। তার ওপর দুপুরের এই সময়টাতে প্রাকৃতিক কী এক কারণে নিত্যদিন মুখমন্ডলটা বিকৃত দেখায়; যার দেখা মেলে তাকে নিজের প্রতিকৃতি বলে অবিশ্বাস জাগে। এ মুহূর্তে অবিশ্বাসটা ঘোরতর হয়ে জেঁকে বসছে তার মননে মগজে। নির্বুদ্ধিতার কারণে জন্মদাতা পিতা তাকে ছাগলছানার কাতারে দাঁড় করাত; তা মেনে নেয়ায় আপত্তি জাগে না। কিন্তু এরা আজ কী শুনিয়ে গেল? যা শুনিয়ে গেল তার সঙ্গে সম্পর্ক জ্ঞান-গরিমার নয়, মুখচ্ছবির। মুখচ্ছবিতে সত্যি কি সে গলাছিলা ওই গৃহপালিত পাখিতুল্য? কিন্তু কী বিবেচনায় সে তা হতে যাবে? তার সম্মুখমাথায় টাক, পেছনে একগাছি পাতলা চুলে শেক্সপিয়ারিয়ান ভাব দোদুল্যমান। তার ভ্রূ নেই, দাড়ি-গোঁফ আদৌ সেভাবে মাথা তোলেনি আজও। সব মিলিয়ে সে কি তেমনই, তাই? হয়তো বা তাই। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কারণ, এ পরিসরে সেই শুধু জানে তার জীবনের একান্ত নিভৃত কথাগুলো। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে আজ সে প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে। এখন পর্যন্ত সে এমন কোনো অনুভূতি দ্বারা তাড়িত হয়নি যা তাকে কোনো নারীর সান্নিধ্য পেতে উন্মুখ করতে পারে। এ বোধ করি তার নিয়তি। নিয়তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে ঘর-দুয়ার, চেনা পরিমন্ডল ছেড়েছে সে। চাকরির নামে এখানে এসেছে।

কুটিরের সোজা পশ্চিমে প্রায় ৩০০ গজের পর গাঁয়ের বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল। তারই দ্বিতীয় শিক্ষক হয়ে এসেছে কছিম মাস্টার। এখানে তার কর্মজীবনের বছর দেড়েক গেছে। এই বছর দেড়েক সে মাঠের মধ্যকার এই ফাঁকা কুটিরে আছে। স্বভাবে সে লাজুক, অসামাজিক বিধায় অদূরের গাঁয়ে কারও বাড়িতে জায়গীর হয়ে ওঠেনি। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা দয়াপরবশ হয়ে তার আটা-চাল ভাঙানোর এই কল ঘর, অদূরে স্কুল হওয়ার কারণে যাকে পরিত্যক্ত হতে হয়েছে, তাতে তাকে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই দেড় বছরে সে গাঁয়ের কারও সঙ্গে মেশেনি; ইচ্ছা করেই নিজেকে স্কুল আর কুটিরে সীমাবদ্ধ রেখেছে। আজই প্রথম এ নির্জন কুটিরচত্বরে একদল যুবকের আবির্ভাব ও খেলায় মেতে ওঠা সে লক্ষ্য করেছে। এ পরিসরে তাকে তাচ্ছিল্যের অভিজ্ঞতাও তার এই প্রথম। বিষয়টি তাকে সীমাহীন অস্থির ও কৌতূহলী করে তোলে। সে ভাবে, তবে কি তার অগোচরে গ্রামবাসী, বিশেষত গাঁয়ের তরুণসমাজ তাকে এভাবেই দেখে? আজ বিকালেই গাঁয়ের পথে হেঁটে সে বিষয়টির প্রমাণ নেবে।

পুরোটা বিকাল গাঁয়ের পথগুলো ধরে হেঁটেছে কছির মাস্টার। মাথা নিচু থাকলেও কান সর্বদা খাড়া রেখেছে। না, কোনো দিক থেকে ওইসব শব্দপাত তার কানে ওঠেনি। না সে সাক্ষাৎ পেয়েছে তাস খেলোয়াড় ওইসব উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের কারও। সূর্যাস্তে পায়ে ক্লান্তি নিয়ে সে এসে আশ্রয় নেয় তার কর্মস্থল প্রাইমারি স্কুলটির বারান্দায়। ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। তার ক্লান্ত শরীর-মন অলস ভাবালুতায় বুঁদ হয়ে আসে। চোখ বুজে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয় সে! স্কুল ঘরের পেছনেই আম-কাঁঠালের বন। বাদুড়ের ডানা ঝাপটানির শব্দে তন্দ্রা কাটে তার। প্রচুর মশা এখানে। পন পন শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। তবু ওঠে না সে। ওপাশের ঝিঁঝিঁর ডাক, খাটাশ, পাতিশেয়ালের হাঁকডাক তীব্রতর হতে থাকে। বুঁদ হয়ে সে বুনো শব্দপাতেই কান ধরে রাখে। হঠাৎ ওপাশ থেকে চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসে। কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলে :

ঘেসু মানে কী? হিঃ হিঃ হিঃ। পুরুষকণ্ঠ।

জানি না, হিঃ হিঃ হিঃ। নারীকণ্ঠ।

ঘেসু মানে ধ্বজভঙ্গ, হিঃ হিঃ হিঃ।

ধ্বজভঙ্গ! কইলেই হইল!

তয় কী?

পাঁজি পোলাপান যে কেউ কোনো কাজ ভালো মতো না পারলেই তারে ঘেসু কয়। ঘেসু বলতে নির্দিষ্ট কেউ নাই।

কিন্তু তোমার ঘেসুয়ে কী পারে নাই?

আমার মাথা।

আমি জানি।

কী?

একজন ধ্বজভঙ্গ যা পারে না, তাই, হিঃ হিঃ হিঃ।

আমার মাথা। হিঃ হিঃ হিঃ। ছাড়ো, চইলা যাই।

হুম, কইলেই হইল! ঘেসুয়ে তোমারে যা দিতে পারে নাই তা দিয়াই না ছাড়ুম।

কথোপকথন চলতে থাকে। শুনতে উৎসাহ বোধ করে না কছির মাস্টার। ঘৃণায় তার বুক ধরে আসে। উঠে অন্ধকারে হাঁটা ধরে সে। এখান থেকে বাঁয়েই কাঁঠাল বনের প্রান্ত। ফিরে তাকাবে কি সে ? নাহ। ঘৃণায় তার মুখে থুথু জমে যাচ্ছে। সে চলতে থাকে। স্কুলঘরের পেছন থেকে কেউ ছায়ামূর্তির মতো উঠে দাঁড়ায়। চুপচাপ বিপরীতে হাঁটা ধরে। কে সে? নিশ্চয়ই ওই অভিসারী যুগলের কেউ নয়। তবে তার মতো আরও কি কেউ ঘাপটি মেরে যুগলের কথোপকথন শুনছিল? কে সে? ভাবতে ভাবতে কুটিরে এসে ওঠে কছির মাস্টার। কুটিরের পূর্ব পাশের পথ দিয়ে কদাচিৎ লোক চলাচল করে। কারা যেন চাপা কথোপকথনে যায় :

তবারক ঘেসুর আসলে কিছু নাই, বুঝলা?

থাকব ক্যামনে? মানুষ কয় না যৌবনের অত্যাচার। তারও তো একটা সীমা থাকে। অত্যাচারেরও সীমা থাকে। তার সম্পর্কে যা শুনলাম...।

তার সীমা নাই। এমন অত্যাচার সে করছে! শেষে নাকি হুদা হুদিও কাপড়চোপড় নষ্ট হইত। তহনই যদি হালায় চিকিৎসা লইত! কয়বার কইরা হালায় ফাঁস লইল-ডাইল ভাইঙ্গা পইড়া বাঁইচা যায় খালি।

অর বউ কি আর আইব? কী মনে হয় তোমার?

পাগলে পাইছে তোমারে? বউ আর আহে। সে অহন তলে তলে কত পানি খাইতাছে! বিদেশ থেইকা বাড়ি আইলা। কয়দিন থাকো; সব বুঝতে পারবা। কত বড় খানকি মাইয়ালোক বুঝবার পারবা। আরে মাগী, তর জামাইর না হয় নাই-ই কিছু। তাই বইলা তুই...। যারা আসলে বদ জামাইর কিছু থাকলেও তারা বদামি করত।

কথোপকথনটি শিগগির অশ্রম্নত হয়ে আসে।

বিনা পানাহারে মাঝরাত অবধি বিছানায় জেগে থাকে কছির মাস্টার। দু'চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। অব্যক্ত যন্ত্রণায় সে ছটফট করে। বারবার কাঁঠাল বাগানের সেই কথোপকথন, কুটিরের পেছনের কথোপকথন এসে তার কানে আঘাত হানে। মনের ঘৃণা তীব্রতর হতে থাকে। শরীরের উষ্ণতা বাড়ে। উঠে দাঁড়ায় সে। স্কুলের দিকে হাঁটা ধরে। দোচালা টিনের ঘর। অন্ধকারে বুনো হাতির মতো দাঁড়িয়ে আছে। দরজা সাদাটে হওয়ায় অন্ধকারেও তার অস্তিত্ব একটু দূর থেকেই চোখে পড়ে। আগে দু-একবার সে তেমনটি লক্ষ্য করেছে। কিন্তু আজ দরজার অস্তিত্ব চোখে পড়ছে কই? খোলা কি দরজা? তাই তো মনে হচ্ছে। রিংয়ে দেয়া রশির গিট খুলে কেউ ভেতরে ঢুকেছে কি?

উৎকণ্ঠা নিয়ে দ্রম্নত খোলা দৃশ্যমান দরজার দিকে এগোতে থাকে কছির মাস্টার। হঁ্যা, দরজাটা খোলাই দেখতে পায় সে। ভেতর থেকে কটমট ধরনের শব্দও ভেসে আসে। খানিকটা ঘাবড়ে যায় সে। নিশ্চয়ই ভেতরে কেউ আছে। এত রাতে চোর ছাড়া আর কে হবে? চেঁচাতে গিয়ে থামে সে। এতটা দূর থেকে কেউ শুনতে পাবে না চেঁচামেচি। একা কী করবে সে? তবে কি ভয় পেয়ে ফিরে যাবে? এভাবে চুরি হতে দেবে স্কুলে? আলমারীতে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রয়েছে। ওপাশ থেকে একটা পরিত্যক্ত ইট তুলে নেয় সে। গলা উঁচিয়ে বলে, কে? স্কুলঘরে কে? কোনো উত্তর নেই। কটমট শব্দটা বাড়তে থাকে। ইট উঁচিয়ে ধেয়ে যায় সে দরজায়। এ কী! ঘরের ধর্ণায় ওভাবে ঝুলছে কে? নির্ঘাত ফাঁস নিয়েছে কেউ। বেঁচে আছে এখনো। লাফিয়ে বেঞ্চে উঠে যায় সে। এক হাতে জাপটে ঝুলন্ত শরীরটাকে উঁচিয়ে তোলে।

রমজানের ছুটি। সপ্তাহ খানেক ঘরের বাইরে বেরোয়নি কছির মাস্টার। সেদিন দুপুরবেলা হঠাৎ কবুতরের ডাকে চমকে ওঠে সে। ছাগলের ডাকও শুনতে পায়। এ কদিন ওসব একটিবারও শোনা যায়নি। কৌতূহল নিয়ে কুটিরের দরজা খোলে সে। চমকে ওঠে শানের ওপরকার দৃশ্য দেখে। সেই কবুতরটা ঘুরে ঘুরে বাক বাকুম করছে। পাশেই ঝুড়িভর্তি ঘাস নিয়ে সে-ই ছাগলছানাটাকে ঘাস খাওয়াচ্ছে কথিত তবারক ঘেসু। দ্রম্নত বাইরে বেরিয়ে আসে কছির মাস্টার। তবারক মিঞার সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

কবে সুস্থ হলেন? তবারক মিঞার উদ্দেশ্যে বলে সে।

আউজগাই। তবারক মিঞা মাথা নিচু করে।

এ ছাগল বুঝি আপনার?

জী না।

ঘাস খাওয়াচ্ছেন যে?

আমি যে ঘেসু।

মানে?

যে ঘাস কাটে তারে কয় ঘেসু। ঘাস না কাটলেও কয়, কোনো কামকাজ না করলেও কয়। কারণ, কাজ হিসাবে ঘাস কাটার কোনো মূল্য নেই। মূল্যহীন কাজে পরের ছাগল আর নিজের ছাগল বলতে কথা নাই- একই কথা। যাউক এত শখ কইরা কষ্ট কইরা মরণের হাত থেইকা বাঁচাইলেন, একটু তো দেখতেও গেলেন না অভাগার বাড়িতে।

সময় হয়নি। তা মরতে চেয়েছিলেন কেন ওভাবে?

পুরানা অভ্যাস।

তার মানে আগেও মরার চেষ্টা করেছেন?

তা করছি অনেক বার, কিন্তু তখন আসলে মরতে চাই নাই। ইচ্ছা কইরাই গাছের কচি ডালে ফাঁস লইয়া লইয়া অন্যদের মায়া বাড়াইতে চাইছি। কিন্তু এবারে সত্যিকারেই মরতে চাইছি।

কেন? এবারে সত্যিকারে মরতে চাইলেন কেন?

এবারে মনের ঘোর অন্যবারের চাইতে খুব বেশি ছিল যে!

কী ঘোর?

সবাই হেলা করলে যে ঘোর হয়।

যেমন?

বাপ মা-ও কত আপন, অথচ তারাও যখন হেলা কইরা ঘেসু মনে কইরা সন্তানের মরণ চায়। তহন আর পাক্কা ঘোর না হইয়া যায় কই?

পাক্কা ঘোর মানে?

এই ধরেন ছেলের বউরে আনতে গিয়া মায় যহন অপমান হইয়া আইসা ছেলের ওপর গায়ের ঝাল ঝাড়ে, তহন খালি পাক্কা ঘোর আহে চৌক্কে।

কী সে ঘোর? কেমন লাগছিল তাতে?

মনে মনে খালি দেখতেছিলাম আমি মইরা গেছি, আর সেই শোকে বাপ-মায় এমনকি বৌয়েও মাতম কইরা কানতাছে। বুক চাপড়াইতেছে, মাটিতে মাথা আছড়াইতেছে। মরণের ওপার থিকা আমি তা দেইখা খুব সুখ পাইতাছি। তাগো পরাজয় দেইখা সব কষ্ট ভুইলা হাসতাছি। হুসে আসলে তাই তাগো পরাজয় দেখতে উতালা হইয়া পড়ি। ভাবলাম, এইবারই হইব শেষ খেলা। এইবার আর কচি ডালে না; এইবার তাগোর পরাজয়ের খেলা দেখমু ঘরের ধর্ণায় ঝুইলা থাইক্যা।

কোনো খেলা কি দেখলেন ধর্ণায় ঝুলে?

নাহ্‌। একদম না। কোনো খেলা না।

কী দেখলেন?

খালি আন্ধার। বিজগোবি আন্ধার। এমুন আন্ধার জিন্দিগিতে দেখি নাই।

ধর্ণায় ঝুলে যে সুখ চেয়েছিলেন, তা কি পেলেন?

না না না! কিসের সুখ? খালি কষ্ট। বাপরে বাপ! সেই কষ্টের কুল-কিনারা নাই, কীভাবে তার বর্ণনা দিমু? দড়ি যখন গলায় শক্ত কইরা আটকাইল, তখন মনে হইল কেউ পাওয়েত্থোন মাথা পর্যন্ত চামড়া ছুইলা লইতাছে। সেই কষ্ট যদি জাহান্নাম হয়, মায়ের দেয়া ওই অপমান, বউয়ের দেয়া ওই অপমান তার তুলনায় কিছুই না, সেইগুলান হইব বেহেশতি সুখ।

মরতে চাইলেন তারপরও?

না না না। ক্যান চামু?

কী চাইলেন?

খালি বাঁচতে চাইলাম। দড়ি খুলার জন্য কত চেষ্টা করলাম উপর দিকে হাত বাড়াইতে। হাত একটুও তুলতে পারলাম না। মনে হইল কিসে জানি হাত দুইটারে হাতির মতো শক্তি দিয়া নিচে টানতাছে। খালি ভাবলাম, এমুন ভুল কেন করলাম আমি? কী হইব আমার? জগতে এমনকি কেউ নাই আমারে ভুলের জাহান্নাম থিকা এখন বাঁচাইতে পারে? তারপর কী হইল মনে নাই। সুস্থ হইয়া যখন জানলাম, একজন আমারে সেই জাহান্নামের কষ্ট থেইকা উদ্ধার করছে, তহনই কাল বিলম্ব না কইরা তার কাছে ছুইটা আসলাম। ভাবলাম তার ডিস্টার্ব হয়, তাই বইসা রইলাম। ডিস্টার্ব করলাম কি?

নাহ্‌! ভুল বুঝতে পেরেছেন কি তাহলে?

জী।

আর কখনো করবেন একই ভুল?

না না না, আর কোনো দিন না।

শুনুন, কথাগুলো : জীবজগৎ মাত্রই সংঘাতময়। প্রত্যেককেই বৈরিতার সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। একটা পিঁপড়া, মানুষ, চারাগাছ, হাতি, তিমিমাছ প্রত্যেককেই। কেউ আপনার প্রতি অন্যায় করতে পারে; তার প্রতিকারের জন্য বেঁচে থাকাটাই জয়সূচক। কিন্তু আত্মহত্যা কোনো প্রতিবাদ নয়। এটাও এক প্রকার খুন-নিজেকে খুন। অন্য কাউকে খুন করলে মানুষের আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু আত্মহত্যাকারীর বিচার মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় স্বয়ং বিধাতা তার বিচার করেন। তাহলে আর আত্মহত্যার মাহাত্ম্য কী থাকে? পরাজয়ের ওপর পরাজয়, নাকি বলেন?

জী।

যদি জানতে বা বুঝতেন আপনি আত্মহত্যা করলে কেউ আপনার জন্য কাঁদবে না, বরং ধিক্কার দেবে, তবে কি এ কাজে অগ্রসর হতেন? জী না।

থাক সে সব। এখন কী কাজ করবেন ঠিক করেছেন? কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকাই তো জীবন-কাজই মহান, কাজই জীবনের পরম বিজয়।

আমি ঘাস কাটুম। বাঁইচা থাইকা খালি ঘাস কাটুম। বাঁচার চাইতে বড় সুখ আর নাই। বাঁইচা থাইকা ঘাস কাটতেও সুখ।

ঘাস কাটবেন মানে?

আমি যে ঘেসু। ওই যে কইলেন কাজই জীবন! ঘাস কাটাই তো আমার কাজ। তয় অহন আর খালি খালি না; ঘাস কাটুম এই যে, এর লাইগ্যা। এর মতো আরও যারা থাকব তাগোর অনেকের লাইগ্যা। কিরে ছাগা, দলবল লইয়া খাবি না আমার ঘাস? আমি তো ঘেসু।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66427 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1