শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তফুল

সাজ্জাক হোসেন শিহাব
  ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

রাদি উলাইল বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল ৮টায়। প্রতিদিন যেমনটি থাকে, ঠিক তেমনটি। এ সময়ে এখানে লোকজনের ভিড় লেগে না থাকাটা বিস্ময়ের। আজও সেই বিস্ময়টাকে প্রশ্রয় দেয়নি বাস দাঁড়ানোর এই জায়গাটা। রাদি প্রতিদিনের এই স্বাভাবিকতার সঙ্গে ঢের পরিচিত এবং এটা সে উপভোগও করে বটে। কিন্তু আজ কিছুতেই সে চেনা এই বিষয়টার সঙ্গে নিজেকে খাপ-খাওয়াতে পারছে না। কারণ, তার মুখ দিয়ে থেমে থেমে সবুজ রঙের দুর্গন্ধময় পিত্তি বের হচ্ছে। সে পিত্তি ভিড় ঠেলে একটু ফাঁকা জায়গায় ফেলে আবার পূর্বের জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে রাদি। তার এই কান্ড দেখে কেউ কেউ বিরক্তও হচ্ছে। শুধু এক সুন্দরী মেয়ে বাদে। মেয়েটিকে রাদি আজই প্রথম দেখছে। মেয়েটি বেশ ভালোবাসা জাগানো চোখের অধিকারী। অবশ্য একজন সুন্দরীর দিকে ছেলেরা যেভাবে তাকায় রাদি তেমনভাবে দেখেনি। মেয়েটির দিকে তা খুব বেশি খেয়াল নেই। তার নজর দুটো জিনিসের দিকে। এক নম্বর খেয়াল হলো বাস। আর অন্যটা হলো, দেহভ্যন্তর থেকে মুখ বেয়ে বের হওয়া বিচ্ছিরি তরল পদার্থ। বাস মাথায় থাকলেও পিত্তি নিয়েই তার এখন যত বিপত্তি। সে সবাইকে অস্বস্তিতে রেখেছে শুধু সকাল ৮টার বাস ধরার আশায়। এ ছাড়া যে উপায়ও নেই। সকালের বাস মিস করলে দুর্ভোগেরও শেষ নেই। উলাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে তাকে গুলশানে যেতে হয় প্রতিদিন। অফিসে। এই বাসটা মিস হলে পরের বৈশাখী গাড়িতে যেতে হবে। ওই গাড়িতে আরও ভিড়। আর ওটা মিস করলে লোকাল গাড়িতে করে ভেঙে ভেঙে যেতে হবে। উলাইল বাসস্ট্যান্ড টু গাবতলী। গাবতলী টু গুলশান-১। আর এটা ঘটলে তার কপালেও বিপদ আছে। ইতোমধ্যে সে এই মাসে দুইদিন দেরিতে অফিসে গেছে। আর একদিন দেরি হলেই তার এক কর্মদিবসের পুরো টাকা কেটে নেয়া হবে। এটাই তার অফিসের নিয়ম। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে সে এমন পরিস্থিতিতেও লোকজনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুতেই পুরো বেতন হাত ছাড়া করা যাবে না। তার কাছে টাকার মূল্য অনেক। কারণ, তার স্ত্রী টাকা না থাকলে তার সঙ্গে অদ্ভুত সব আচরণ করে। টাকা ছাড়া আজ সকালে সে খিচুড়ির সঙ্গে যে পেঁয়াজ খেয়েছে, মাঝেমাঝে সে সেটাও কিনতে পারে না। অবশ্য খিচুড়ি খাওয়ার সময় কাঁচা পেঁয়াজের স্বাদ নেয়ার ফল থাকে ভোগ করতে হয়। আজও হচ্ছে। সেই কাঁচা পেঁয়াজ খেয়েই মাঝেমাঝে লোকজনের মধ্যে গা ঘিনঘিন করা পরিবেশ এনে দিচ্ছে সে। কারণ, ওই অম্স্নজল বের করার সময় তার যে মুখবিকৃতি ঘটছে ওটা দেখে যে কেউই অস্বস্তিতে পড়তে বাধ্য। পড়ছেও তাই। রাদির এমন কান্ড দেখে সবার সংযমের বাঁধ ভেঙে গেলেও ওই মেয়েটা কিছুতেই রাদির ছিমছাম দেহ থেকে চোখ ফেরাচ্ছে না। মেয়েটার ক্রমাগত নিখুঁত চাহনিতে একটা অস্বাভাবিক ভাব ফুটে উঠছে। যেনও তাকে রাদি জাদু করেছে, ধীরে ধীরে এমনভাবে দেখছে মেয়েটি। নাজেহাল রাদি প্রথমে মেয়েটিকে খুব খেয়াল করেনি। বাস টার্মিনাল থেকে একটু দূরে গিয়ে অনেক্ষণ পর নিজ মুখ থেকে থুথু বিয়োগ ক্ষণে তার চোখে পড়ে মেয়েটি। নিজের বেহালদশায় সুন্দরী মেয়েদের দৃষ্টিতে আটকা পড়া কোনো পুরুষের জন্য মোটেও স্বস্তিকর ব্যাপার নয়। রাদির ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো, যা অন্যদের বেলায় ঘটে। এমন বিব্রতকর মুহূর্তে মেয়ের চোখে চোখ পড়াতে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সে কী করবে। তাই কিছুক্ষণ থতমত থাকার পর নিজেই নিজের মন্ত্রণাদাতা হয় রাদি। নিজেকে একটু সামলিয়ে নিয়ে সে এদিক ওদিক তাকায়। রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে আর আসছে। কিন্তু তার যে গাড়ির জন্য অপেক্ষা, সেই বৈশাখীর কোনো খোঁজ নেই। প্রথম প্রথম ভালো সার্ভিস দিলেও এখন বৈশাখী বড্ড বাজে হয়েছে। সময় জ্ঞান নেই। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। একটু হতাশ হয়ে রাদি ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে। এরপর রাস্তা থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। অপেক্ষা করে বাসের। মেয়েটি আস্তে আস্তে রাদির পাশে এসে দাঁড়ায়। রাদি এবার সেটা খেয়াল করে। এরপর মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটিও রাদির দিকে তাকায়। দুজনের চোখাচোখি হয়। মেয়েটির গভীর বাদামি চোখ। সেটা দেখে রাদি একটু অন্য মনস্ক হয়ে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার যেনও দায়িত্ব পড়েছে মেয়েটির কাঁধে, এমনভাব করে মেয়েটি একটু হাসি দিয়ে বলে,

- ভাইয়া, কোথায় যাবেন?

\হমেয়েটির আন্তরিকতায় রাদির গম্ভীরতা কমে যায়। একটু সুরেলা গলায় রাদি বলে,

- গুলশান-১।

\হমেয়েটি রাদির কথাশুনে একটু আগ্রহভাব নিয়ে বলে,

- আমিও গুলশানেই যাব, ভাইয়া। আমি ওখানে একটা চাকরি পেয়েছি। আজই জয়েন।

রাদি, মেয়েটির কথার উত্তরে বলে,

- ও, তাই! অভিনন্দন।

\হমেয়েটি রাদির কথার জবাবে বলে,

- আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ, ভাইয়া।

রাদি, মেয়েটির কথার বৃত্ত থেকে বের হতে চাইছে। কারণ, তার গলার ঠিক বহির্মুখে এসে আবার দলা পাকাচ্ছে অম্স্নজল। রাদি, মেয়েটির কাছে থেকে দ্রম্নত সরে যায়। একটু দূরে গিয়ে ফেলে আসে অপ্রত্যাশিত দেহের অন্ততৃষ্ট বস্তু। এরপর রাস্তার পাশে লোকজনের ভিড় থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়িয়ে রয়। মেয়েটি আবার রাদির কাছে আসে। রাদি কিছুতেই মেয়েটির এমন কান্ডের কারণ খুঁজে পায় না। তাই এবার কারণ উৎঘাটনের চেষ্টা করে রাদি। সে নিজের খোলস ছেড়ে মেয়েটিকে বলে,

- আপনি আমাকে কখনও দেখেছেন?

- না।

\হ-মেয়েটি উত্তর দেয়।

রাদি মেয়েটির কথার পিঠে বলে,

- তাহলে এত আশ্চর্য রকম সাবলীলভাবে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন কিভাবে?

মেয়েটি কোনো রকম ভনিতা না করে তৎক্ষণাৎ বলে,

- আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি প্রতিদিন নিয়মিত এই পথে ঢাকায় যান। ভাবলাম আমিও তো এ পথেই যাতায়াত করব, তাই আর কি আপনাকে আপন করার চেষ্টা করছি।

রাদি আগ্রহ ভরে মেয়েটির কথাশুনে- তারপর বলে,

- আপনার মুখ কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে হয়তো। মেয়েটি, রাদির এমন কথাশুনে চোখদুটো প্রায় বন্ধবন্ধ ভাব করে একটু টেনে টেনে বলে,

- আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি আসলে অন্য কথাও বলতে চাই।

রাদি একটা ভারিক্কিভাব নিয়ে বলে,

- তা বেশ। বলুন। শুনি।

রাদির মনোযোগ এখন মেয়েটির দিকে। ওদের কথার মাঝেই একটা বৈশাখী বাস দ্রম্নত চলে যায়। প্রথমে দুজনের কেউই তা খেয়াল করেনি। কিছুক্ষণ পর আচমকা মেয়েটি ঐদিকে খেয়াল করে বলে,

- ধুর! বাস তো চলে গেল!

\হমেয়েটার এমন কথাশুনে রাদির মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। মনে মনে মেয়েটার দোষও দেয়। এরপর সে মেয়েটিকে বলে,

- আপনার জন্যই বাস মিস করলাম। অফিসে দেরি হয়ে গেল। আমার একদিনের বেতন কাটা পড়ল!

রাদির কথায় মেয়েটির মুখ ভারী হয়ে যায়। তাই কিছুক্ষণ থেমে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রাদি আবার বলে,

- অবশ্য আমার চেয়ে আপনার ক্ষতিটা বেশি হলো। কারণ, আপনার চাকরির প্রথম দিনেই দেরিতে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হলো। এটা ঠিক না। আচ্ছা চলুন, পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে একটু চা খাই। যা হওয়ার তা তো হবে। একটু মেজাজটা ঠান্ডা করে আসি। পরের গাড়ি আসতে তো একটু আধটু সময় নেবেই। এ সময়ে একটু চা খাওয়া যেতে পারে। কী বলেন?

\হমেয়েটি, রাদির কথায় সায় দেয়। এরপর তারা চায়ের দোকানে যায়। চায়ের স্টলের সামনে রাস্তার পাশেই একটা বেঞ্চ পাতা আছে। সেখানে বসেই দুজনে চা খেতে থাকে। তাদের পাশেই আরও একজন লোক বসা। ওই লোকটি রাদি আর মেয়েটির দিকে মাঝেমাঝে চুরি করে তাকাচ্ছে।

এবার মেয়েটি ওইদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের সম্পর্কে বলা শুরু করে।

- আমার নাম মেঘলা। দেশের বাড়ি রংপুর। বাবার চাকরির সূত্রে এখানেই থাকি। অবশ্য এখন বাবার চাকরি নেই, বাবাও নেই।

রাদি বুঝতে পারে মেঘলার বাবা ইহলোক ত্যাগ করেছে। সে একটু সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে মেঘলাকে। মেঘলা এবার তার কথার জাল বুনতে লাগে।

- আমার বাবা কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে গিয়েছিল। অফিসের কাজে। আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় তার প্রাণ যায়। এখনও সেই বিয়োগ-ব্যথা আমার হৃদয় থেকে যায়নি। যাবেও না কখনো।

\হমেঘলার এমন কথাশুনে রাদি এবার অমায়িকভাবে বলে,

- ধৈর্য ধরুন। এমনটি তো যে কোনো সময় ঘটতে পারে। যে কেউ এর শিকার হতে পারে।

চায়ের দোকানের টিভিতে এক ধরনের অশ্লীল প্রেমের ভিডিওগান চলছে। এমন গান সহজে রাদি শোনে না। কিন্তু আজকে শুনতে হচ্ছে। কান তো আর বন্ধ রাখা যায় না। ভিডিওর দিকে চোখ পড়ে রাদির। অর্ধনগ্ন ভিডিও গিলছে স্টলের মানুষ। লজ্জায় চোখটা নামিয়ে নেয় রাদি। এরপর কি যেনও ভেবে আবার বলে,

- আমরা প্রতিদিন একসঙ্গে যাতায়াত করব, কেমন?

রাদির কথায় মেয়েটি খুশি হয়। মেঘলা এবার রাদিকে বলে,

- আসলে আমার মা আমাকে এমনটি করতে বলেছে। কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে চলতে। কারণ, দুর্ঘটনার পরপর আমার বাবাকে যখন হাসপাতালে নেয়া হয়, তখন তার চিকিৎসার জন্য বেশ বড় পরিমাণের টাকার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার পাশে তো পরিচিত কেউ ছিল না। আর তার মোবাইলটাও দুর্ঘটনার পরপর কেউ সুযোগ বুঝে নিয়ে যায়। এরপর যা হওয়ার তাই-ই হলো। ডাক্তাররা তার কোনো আত্মীয়র খুঁজে পেল না। সেটা না পাওয়াতেই বাবা চলেই গেল। কারণ, দুর্ঘটনায় বাবা মাথায় অনেক ব্যথা পেয়েছিল। এর ফলে দুর্ঘটনার পরপরই একটা অপারেশন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেখানে অনেক টাকার দরকার ছিল। কিন্তু একজন অপরিচিত লোকের জন্য কে এত টাকা ব্যয় করবে! কেউ এগিয়েও আসেনি। বাবা চলে গেল। আমার মায়ের ধারণা, পাশে কেউ থাকলে অন্তত এমনটি ঘটতো না। তাই আমাকে দিয়ে মা শপথ করিয়েছে, যাতে করে আমি কারও না কারও সঙ্গে যাতায়াত করি। আমি আজ এমন একজনকে খুঁজছিলাম যে নিয়মিত এখান থেকে এ সময়ে অফিসে যায়। খেয়াল করে দেখলাম, আপনি তেমনই একজন, যার সঙ্গে নিয়মিত এই পথে যাওয়া যাবে। তাই না?

\হমেঘলার কথাশুনে রাদি এবার মুখ খুলে বলে,

- আপনার ধারণা ঠিক।

রাদি, মেঘলার চায়ের কাপের দিকে ইশারা করে বলে,

- চা তো শরবত হয়ে গেল। চায়ে চুমুক তো দিবেন, নাকি!

রাদির কথাশুনে মেঘলা মুচকি হাসে। রাদি হাসে মেঘলার মুখ দেখে।

তাদের এমন হাসি দেখে সকালের সোনালি রোদও যেনও তাদের গায়ে এসে চুমু খেতে লাগলো। রাদি রোদ থেকে বাঁচতে পাশের একটা বটগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। এমন সময় চোখের নিমিষেই একটা পাগলা বাস এসে উঠে পড়লো তাদের গায়ের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে মেঘলা, রাদি আর তাদের পাশে চা পান করতে থাকা লোকটা ছিন্নভিন্ন শরীরে পড়ে রইলো উলাইল বাসস্ট্যান্ডে। তাদের রক্ত জমাট বেঁধে থোকা থোকা হয়ে ফুলের পাপড়ির মতো হয়ে রইলো। রক্তফুল! যে ফুল ফুটিয়ে কেউ কেউ দিব্যি হেঁসে খেলে জীবন পার করছে আমাদের সঙ্গে। আমাদের সমাজে!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67480 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1