শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনের শুভেচ্ছা

রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা বিজ্ঞানমনস্কতার উপলখন্ড

গওহর গালিব
  ১৫ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন যখন উচ্চারণ করেন-

আমার সময় গো-ক্ষুরের মতো বিভাজিত

মুহূর্তগুলো কালো কৃষকের পায়ের মতো ফাটা

\হ(সূচনাপর্ব/ফিরিনি অবাধ্য আমি)

তখন তার সম্পর্কে একটু সচেতন হতে হয় বৈকি। কবিতার পাঠক হিসেবে আমার বয়স হাজার বছরেরও অধিক, আমায় পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ প্রলম্বিত এক দুস্তর পথ। কাব্য যাত্রার দীর্ঘ এ পথ যখন সংকীর্ণ হতে হতে ডোবার কাদায় রূপ নিতে শুরু করেছে, তখন সহসাই এ হেন উচ্চারণ আমাদের হতচকিত করবে- সেটাই স্বাভাবিক। কারণ কবি চলমান সময়ের আসল রংকেই ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন তার কবিতার ক্যানভাসে। রোমাণ্টিকতা, দ্রোহ, কল্পনাবিলাস কিংবা স্রোতের উল্টোদিকে যাত্রা না করে কবি বিজ্ঞানমনস্কভাবে তার কাব্যাদর্শের পথে যাত্রা করলেন চলমান সময়ের সোসিও-ইকোনমিক কনটেক্সটে। তিনি কবিতা লিখতে গিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলেন এমন এক ত্রিমাত্রিক বাস্তবতায়- যার একদিকে নিরন্ন অসহায় মানুষ, অন্যদিকে করপোরেট পুঁজিবাদী বৈশ্বিক শিল্পায়ন। তাইতো কবি স্বীয়সত্তা ও সময়কে আবিষ্কার করে বলতে বাধ্য হন, 'আমার সময় গো-ক্ষুরের মতো বিভাজিত'। আর সময়ের এ সঠিক শঙ্খধ্বনি শ্রবণ করার পারঙ্গমতা অর্জন করার মধ্য দিয়েই রেজাউদ্দিন স্টালিন হয়ে ওঠেন বিজ্ঞানমনস্ক কবি তালিকায় পুরোধা ব্যক্তিত্ব।

বিজ্ঞান তার স্বভাবগত কারণেই একটা অমোঘ নিয়মের অধীন- তেমনি কবিতাও একটা নিয়ম ভাঙার নিয়মের মধ্যে আবর্তিত। উচ্ছৃঙ্খল উষ্ণতা কোনোভাবেই সার্থক শিল্পের জন্ম দিতে পারে না। সত্যিকার সাহিত্য সৃষ্টির জন্য চাই শৈল্পিক সৌষম্য সাধন। একটি সর্বাঙ্গসুন্দর কবিতা সৃষ্টির জন্য কাব্যিক অনুশাসনের মধ্যে থাকা খুবই জরুরি। একজন কবি তখনই বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠেন যখন তিনি কাব্যকলার সঠিক শৃঙ্খলগুলোকে মান্য করেন এবং সেই সঙ্গে পূর্বের শৃঙ্খলগুলোকে ভাঙতে ভাঙতে আবিষ্কার করেন নতুন কোনো ফর্মের। এই দ্বিবিধ শর্তে রেজাউদ্দিন স্টালিন উতরে যান সঠিক শ্রমের পথ ধরে। সে কারণে স্টালিনের কবিতার বিজ্ঞানাগারে প্রতিটি শব্দই এই একটি কবিতার চরিত্র হয়ে দাঁড়ায়। তারা উপসারিত হয় কিংবা আওয়াজ তোলে। তারা আওয়াজ তোলে কখনো মৃদু, উচ্চ কিংবা মধ্যম সুরতন্ত্রীতে। এভাবেই স্টালিনের কবিতার বিজ্ঞানাগারে তৈরি হয় এক একটি নতুন কবিতা-

'কিছু শব্দ বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে

আমি নিরক্ত শব্দগুলোকে

নতুন অর্থে জাগিয়ে দিতে চাই

\হযেমন কালো শব্দটির স্থলে লাল

সাদার জায়গায় হলুদ

... ... ... ...

এবার তৈয়ারকৃত নতুন শব্দে

একটি সম্পূর্ণ কবিতা লিখতে চাই :

যন্ত্রণায় যন্ত্রণায় আগুনের পাতারা সাদা হয়ে গেছে।

সেই সাদা পাতার আড়ালে সবুজ বানরেরা আর্তনাদ করে। (নতুন শব্দের কবিতা) এভাবেই নতুন শব্দের ব্যবহারে পূর্বাপর অক্ষরবৃত্তের পথ ধরে তিনি আমাদের নিয়ে চলেন তার স্বকীয় কাব্যভুবনের হরিৎ উপত্যকায়। আসলেই তাই- রেজাউদ্দিন স্টালিন কাব্যকলার সব শৃঙ্খল মেনেই নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন তার স্বতন্ত্র স্বর। দেয়াল দিয়ে ঘেরা আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো যখন এক লবণাক্ত সমুদ্রময় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে উঠছে তখন কবি তার সুচৈতন্য দ্বারা আমাদের দেয়াল ভাঙার গল্প শোনাতে চান। 'সহে না জনতার জঘন্য মিতালীর মতো'- কবি স্টালিন তৈরি করেন সেই আপ্তবাক্য যাকে বলা যেতে পারে-'সহে না জনতার জঘন্য বৈরী'। তাইতো কবি এই বৈনাশিক বাস্তবতা থেকে 'মীমাংসিত হতে চান এভাবে-

দেয়ালের গল্প আমি অনেক শুনেছি,

এইবার দিগন্তের গল্প কিছু বলি

... ... ... ...

আমি জানি অত্যন্ত গোপনে আমার বন্ধুরা

সারারাত দেয়াল তুলছে

পাছে দখল হয়ে যাবে ভয়ে

... ... ... ...

আমি দুই হাতে কান চেপে দিগন্তের দিকে দৌড়ে যাই

... ... ... ...

দেয়ালের হাত থেকে উজ্জ্বল উদ্ধার পাবি

আয়, আমার বিস্তৃতির মধ্যে

অসীম অদৃশ্যময়তায়...।'

(দেয়াল ও দিগন্ত)

এই বক্তব্যে এসে কবির মনোভাবনা হয়েছে ঊর্ধ্বাচারী। বিশ্বযুদ্ধের প্রচন্ড ক্ষরদাহে বৈশ্বিক অশান্তির বাস্তবতা দৃষ্টে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলির মধ্যে যেমন ঊর্ধ্বাচারী শান্তির বাণী বিশ্বমানবকে শুনিয়ে স্বস্তি দিয়েছেন; তেমনি আপাতদৃষ্টে পলায়নপর মনে হলেও কবি স্টালিন যেন গৌতম বুদ্ধের মতোই করজোড় মিনতি জানাচ্ছেন- শান্তি-শান্তি-শান্তি চাই। এভাবেই কবি সমকালীন বিদ্বেষের খোয়াড় ও নিমজ্জন থেকে উদ্ধার পেতে নিজেকে ইউলিসিস করে তোলেন।

\হসমাজে বসবাসকৃত মানুষ হিসেবে কোনোভাবেই আমরা আমাদের সামাজিক দায় এড়াতে পারি না। কবিরাও এর বাইরের কেউ নন; বরং তারা একার্থে আরও বেশি সামাজিক। সাধারণ জনগণ ও লেখকদের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী একবার বলেছিলেন 'লেখক মাত্রই সামাজিক, বাদবাকি আর সবাই পারিবারিক।' (সাহিত্য খেলা)

পারিবারিক কিন্তু আত্মকেন্দ্রিকতার ঘুণ বর্তমানে সাধারণের চেয়ে লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তীব্রভাবে পরিদৃষ্টমান। আত্মপ্রচার, আত্মপ্রসার, আত্মপ্রাপ্তির প্রাসাদে বন্দি হয়ে আমাদের বেশিরভাগ কবিরা আজ সমকাল ও সমাজ থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। ধসে যাওয়া এই প্রতিপার্শ্বে রেজাউদ্দিন স্টালিন সচেতনভাবেই ঘুরে দাঁড়ান। সামাজিক দায়গুলোকে তিনি শ্বাসগ্রহণের মতোই অনুভব করেন। হতাশা, অবিশ্বাস ও ধ্বংসন্মুখ সমকালের মাঝে দাঁড়িয়ে তাই তার আত্মপলব্ধি-

'সমকালে কালবেলা কালে কালে দীর্ঘ বেলা যায়

গড়ায় গভীরভাবে পাথরের উট

মরু কঁ্যারাভার মতো আতঙ্ক উঠে আসে মানুষে মানুষে

মানুষ তবুও থাকে, থাকে

আমিই থাকি না শুধু পালাই ভেতরে

শামুকের সন্দেহে নিজেকে লিপ্ত হতে দিই

আমি কি মানুষ...'

(সমকালে কালবেলা)

এই যে কবির- 'আমি থাকি না শুধু পালাই ভেতরে কিংবা আমি কি মানুষ....'? উচ্চারণের মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন কবি হিসেবে অনেক বেশি সামাজিক। সমাজের ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে নিজেরে কষ্টের জায়গাটিকে চিহ্নিত করাই হলো সামাজিকতার নামান্তর।

আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির ওপর অঘাতে, দেশীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন যখন এক নিদারুণ ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পতিত তখন স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ্যা হতে বাধ্য আমাদের মেধা ও মনন। সমকালীন তথাকথিত রাজনৈতিক সচেতন কবিরা যখন স্স্নোগানসর্বস্ব কবিতা লিখে একধরনের পাঠকদের মন কেড়ে নেয়ায় ব্যস্ত, তখন রেজাউদ্দিন স্টালিন আমাদের নতুনদের জেগে ওঠাকে চিহ্নিত করেন একজন দার্শনিকের প্রজ্ঞায়- 'একটি দীর্ঘ রাত্রির উপত্যকায় শাহবাগকে উঠে আসতে দেখলাম। যেন বহুপথ পার হয়ে একটি মরু কাঁরাভা আশ্রয় নিয়েছে তাঁবুতে/ শহরের সমস্ত ফ্লাট, সড়ক, বিপণি, প্রেসক্লাবে বৈদু্যতিক আলোর ফিস্‌ফাস্‌ /সিন্ধু সারসের মতো সর্তক সজাগ।'

(রাত্রির উপত্যকায় শাহবাগ)

এভাবেই চেতনার বিশ্বাসী অনুষঙ্গে এবং নতুন শক্তির আত্মবোধনের চিহ্নায়নের সূত্রে রেজাউদ্দিন স্টালিন শিল্পের কাছে হয়ে উঠেন আত্মনিবেদিত। তাই সমকালীন চিন্তায় তার কবিতার প্রেক্ষাপটে সময়ের এই বির্নিমাণ ভাবনা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। সময় ও সমকালের প্রতি কবির এই সচেতনতার কারণেই আমরা তাকে চিহ্নিত করাবো একজন বৈশ্বিক কবি হিসেবে। রেজাউদ্দিন স্টালিন সময়ের বেদিত হৃদয়ের রক্ত ঢালতে জানেন; রক্ত ঢেলে দিয়েই তিনি একদিন হয়ে উঠবেন ওই বেদিরই কোনো এক তির্যক উপলখন্ড।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<75481 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1