শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যোগ-বিয়োগের জীবন স্বপ্‌না

রেজা
  ১৫ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

পত্রিকায় চাকরি করে প্রিয়। সাংবাদিকতা পড়ে চাকরি করে, সাংবাদিকতা করা হয় না। এমনই বলে সে সবাইকে। কৈশোরের স্বপ্নকে শত ভাঁজ দিয়ে লুকিয়ে রাখা। পত্রিকার মালিক একজন শিল্পপতি। লোকে বলে প্রচুর টাকা তার। নিজেও সম্ভবত বলতে পারবেন না, ঠিক কী পরিমাণ অর্থের মালিক তিনি। বিত্তবান হওয়ার রহস্যাবৃত একটা গল্প বাজারে আছে। বেশ সস্তা প্রকৃতিরও বটে। চুরি করে বড়লোক হওয়ার গল্পকে সস্তাই বলা যায়। তবে চুরির কৌশল ছিল রহস্যাবৃত। প্রিয়র মতো কর্মচারীর পক্ষে জানা সম্ভব নয়।

এ দেশের মানুষের গড় আয়ু যতটা, ঠিক তার মাঝ বরাবর তার বয়সের অবস্থান। পত্রিকার সার্কুলেশন নিয়ে মাথাব্যথা নেই। মাথা তার শোবিজের লোকজনকে কেন্দ্র করে। প্রতিদিন দল বেঁধে মডেল নারী-পুরুষ, নায়ক-নায়িকা, প্রযোজক, পরিবেশক দল বেঁধে আসেন। আসেন কবি, সাহিত্যিকও। জমজমাট থাকে কাকরাইলের নূর ম্যানসনে ঠাঁই নেয়া দৈনিক চেতনা পত্রিকা অফিস। আর এই জমজমাটকে প্রাণ দিতে ব্যস্ত থাকতে হয় প্রিয়কে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছে প্রিয়। মালিক কাম সম্পাদক আবিদ হাসান আবার পছন্দ করেন সুদর্শন প্রিয়কে। বিশ্বস্ত মনে করেন। বিশ্বস্ত হওয়ার তেমন কোনো কারণ বা ঘটনা প্রিয় ঘটায়নি যদিও। বসমালিকের অনুগত থাকাটা স্বভাবে চলে এসেছিল। আবিদ হাসানের প্রায়ই উলস্নসিত ভাব। চেতনার তাপে টগবগিয়ে উঠছে আবেগ তার কণ্ঠে। যখন আবেগের জোয়ার উথলে ওঠে, তখন নিজেকে সে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না।

প্রিয়, তোমাকে দেশের বাইরে যেতে হবে। পেস্নন ভাড়া, থাকা-খাওয়া সব কোম্পানির। একদম ফ্রি। আদেশ নাকি অনুরোধ, প্রথম ধাক্কায় বোঝা গেল না প্রিয়র। এমন কথা এই প্রথম শোনা চাকরিজীবনে। অফিসের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ তার অভিজ্ঞতার থলিতে একেবারেই নেই। চোখজোড়া বড় করে বুঝে নেয়ার চেষ্টা প্রিয়র। বেশ চতুর স্বভাবের আবিদ হাসান। কম যান না তিনিও। পাল্টা প্রশ্ন করে বসেন, অদ্ভুত শোনালো নাকি কথাটা? বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার?

ফোমের চেয়ারে নিজের শরীরটাকে সামান্য এদিক-ওদিক করে নেয় প্রিয়। সহজ হওয়ার কৌশল। প্রিয় বলে, না। তবে বিস্মিত। কেন, কি বিষয়ে হঠাৎ এমন আদেশ অথবা অনুরোধ!

আশা করেননি সম্ভবত এমন বিস্ময়সূচক প্রতি উত্তর প্রিয়র কাছ থেকে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করলে ভালো লাগত আবিদ হাসানের। সাধারণত মানুষ সেটাই করেন। আবিদ হাসানের চোখজোড়া সরু হয়ে আসে। কখনো-সখনো কাউকে দেখে বুঝতে চোখ চিকন করে নেন অনেকেই। ভাব এমন, সরু চোখে সব স্পষ্ট দেখা যায়। টেবিলের ওপর রাখা বেনসন হেজেজের প্যাকেট। বেশ স্মার্টলি প্যাকেটের ভেতর থেকে একটা বের করে ঠোঁটে ঝুলিয়ে দেন আবিদ হাসান। তারপর ধোঁয়ার ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা প্রিয়কে। অতঃপর বুঝিয়ে দেয়া, সঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে যাবে ব্যাংকক। ওখানে বসে তাকে নিয়ে একটা স্টোরি লিখতে হবে। আই মিন ব্যাংকক এনভারয়মেন্টে। সঞ্জু আমার প্রোডাকশনের ফার্স্ট নায়িকা। ওর অভিষেক হওয়ার আগে কিছু কথা আসুক বাজারে। সেটা হোক স্টোরি দিয়ে। তুমি হলে পারফেক্ট পারসন ওকে বুঝে নিতে। আমি আশাবাদী তোমাকে নিয়ে। আমি নিশ্চিত যে তুমি একটা দারুণ স্টোরি নিয়ে আসবে।

আবিদ হোসেন ব্যাখ্যা দিলেন কেন ব্যাংককে বসে স্টোরি লিখতে হবে। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিলেন, একজন মানুষ আরেকজন মানুষের যত কাছে অবস্থান করবে, একজন আরেকজনকে ততই ভালো বুঝতে পারবে। গল্পে তত আবেগ আর প্রাণ জেগে উঠবে। এতে চুম্বকের মতো পাঠক আকৃষ্ট হবে। আর আবিদ হোসেনের এমন ধারণায় নিজেকে সঁপে দিতে ছুটতে হবে ব্যাংকক। চাকরিজীবনে এজাতীয় প্রস্তাব এই প্রথম। ব্যাংকক প্রিয়র ধরাছোঁয়ার বাইরের একটি দেশ। দরিদ্র পরিবারের সন্তান প্রিয়। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছে। টিউশনি ছিল নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যাওযার মূল উপায়। আবিদ হোসেনের কথায় প্রকৃতির নিয়মে প্রিয় বিচলিত। বড় কিছু সবসময় প্রিয়কে ছোট হওয়ার ভয় দেখিয়েছে। তথাপি চাকরি। ভয় পেলে চলবে না।

সঞ্জুর বয়স বেশি নয় অভিনয় জগতে। পূর্ণাঙ্গ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ এখনো ঘটেনি। একটা টিভি চ্যানেলে রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে তার আত্মপ্রকাশ। অভিনয়ে না থাকলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে ডেকে নেয়া হয় সেলিব্রেটি হিসেবে। কিছু মানুষ বেশ তৎপর তাকে ঘিরে। মৌচাকের মৌমাছির মতো। আবিদ হাসান সেই তালিকার শীর্ষস্থানীয় একজন এবং পরে একমাত্র ব্যক্তি। সঞ্জুর বলা কথা ফলাওভাবে মুদ্রিত হয়ে ওঠে পত্রিকা পাতায়। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির রঙিন ছবিও আসে কয়েক কলামজুড়ে।

দুটো টিকিট বুকিং দেয়া হয়েছে। ভিসাও রেডি। কদিন বাদে ফ্লাইট। আবিদ হাসান তার নিজের অফিস রুমে সঞ্জুর সঙ্গে প্রিয়র পরিচয় করিয়ে দিলেন। যে পরিচয়টুকু আগে সঞ্জুর সঙ্গে প্রিয়র ছিল, এখন তা বেশ একটু এগিয়ে গেল। আবিদ হাসান চেষ্টা করলেন কাছাকাছি করার দুজনকে। গস্নাসের ভেতর জলের সঙ্গে চিনি মেশানোর মতো। চেষ্টা বিফল হলো না সঞ্জুর কারণেই। বেশ স্মার্ট। সম্পর্ক স্থাপনে বেশ দক্ষতা আছে।

আমার মন বলছে ভালো একটা ট্রিপ হবে। ভালো কিছু সৃষ্টি হবে। আস্থার কলতান সঞ্জুর। প্রিয়কে বেশ বুঝে নিয়েছে যেন, অভিব্যক্তিতে তারই ছাপ। মানুষ এখন বেশ বুঝদার হয়ে উঠেছে। বুঝে উঠতে পারে। ভাবসাব তেমনই। নিজেকে উঁচুতে ধরে রাখার চেষ্টা হয়তো। কিংবা অভিনয়। প্রিয়কেও এগিয়ে থাকতে হলো।

ইন্দ্র রিজেন্ট হোটেলের পাশাপাশি দুটো রুম। অভিজাত হোটেল। ব্যাংককে আসার আগে প্রিয় ওয়েবসাইটে দেখে নিয়েছে হোটেলের বিস্তারিত। দেশ-বিদেশের অভিজাত কাস্টমারদের আনাগোনা। প্রিয় মেলাতে পারে না হিসেব, এখানে এসে কেন সঞ্জুর জীবন নিয়ে স্টোরি লিখতে হবে। হিসেব না মেলাতে পারলেও কাজটি তাকে করতে হবে। ব্যাংককে এসে অয়নকে ফোন দিয়ে জানায় প্রিয় পৌঁছেছে। অয়ন বেশ ব্যস্ততা দেখালো। আলহামদুলিলস্নাহ বলে কথা সংক্ষিপ্ত করল। প্রিয়র এভাবে যাওয়াকে ভালোভাবে দেখেনি অয়ন। সংশয় আর সন্দেহ ছিল। মুখে না বললেও অয়ন, তার উদাসকণ্ঠে তা টের পেয়েছে প্রিয়। ঘনিষ্ঠতার সূত্রে এই টের পাওয়া। অবাক হলেও জিজ্ঞেস করেনি প্রিয় এমন কিছু। অয়নকে বিব্রত করা তার অভ্যাসে নেই।

বেশ সময়ের বিরতি নিয়ে বের হয় সঞ্জু। সাদা পোশাক শরীরজুড়ে। স্নিগ্ধ লাগছে।

দেরি করে ফেললাম? সরি! মৃদু হাসি সঞ্জুর।

না। না। জার্নির ধকল তো থাকবেই।

কিছু তো খেতে হবে আগে। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। আপনার?

খিদে শুধু পেটে নয়, মনেও। আবিদ হাসান মনের ক্ষুধা বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তর দেয়ার ভেতর সৌজন্যতা থাকে। প্রিয় তা জানে। বলে, খুব খিদে আমারও।

মুখোমুখি বসে ওরা। সঞ্জুর শরীর থেকে যে পারফিউম প্রিয়র নাকে এসে লাগছে, তা অয়নের প্রিয়। মনে হলো অয়ন কাছে বসে। আশ্চর্য এক অনুভূতি খেয়ে গেল প্রিয়র ভেতর। সঞ্জুকে আপন লাগে। পরিচিত সুগন্ধির কাজ সম্ভবত এটা।

দল বেঁধে বেশ কটা চুল কপাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে সঞ্জুর। যেন কপালের রূপ বুঝিয়ে দিতেই তার এই সাজ। খেতে খেতে খেয়াল করে প্রিয়। স্টাইল নাকি এমনিতেই এমন ঝুলে পড়া চুল, কে জানে।

প্রিয়!

মিষ্টি ডাক। ঘনিষ্ঠতাই পারে এমন ডাকের জন্ম দিতে। মন্দ লাগে না প্রিয়র। সঞ্জুর রূপের কাছে বিস্ময় হার মানে।

ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত, তাই না?

কোন ব্যাপার?

এই যে একটা স্টোরি তৈরি করার জন্য এত আয়োজন। মানুষ চাইলে পারে না কী। অবশ্য চাওয়াকে প্রাপ্তির পর্যায়ে নিতে টাকা লাগে। কথাটা বলে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সঞ্জু। ধোঁয়ার মতো ভেসে আসে কাজল চোখে বিষণ্নতার মেঘ। ছোঁয়া লাগলেই যেন ঝরে পড়বে। শেষ অব্দি ঝরল। আঙুল দিয়ে দ্রম্নত জলফোঁটা সরিয়ে নিল। দুই ঠোঁটের সন্ধিক্ষণে ক্ষীণ হাসি উঁকি দেয়। শুধু ভাঙন আর জলোচ্ছ্বাস ছাড়া জলের তৃতীয় কোনো রুক্ষতা নেই। সঞ্জুর চোখ মায়াবী হয়ে ওঠে নিমিষে।

আমি কী নতুন কারোর সঙ্গে কথা বলছি, যাকে এই প্রথম দেখা? প্রশ্ন না করে পারে না প্রিয়। প্রিয়র পেস্নটে খাবার তুলে দেয় সঞ্জু। বলে, মানুষের রূপ তো স্থির নয় প্রিয়। মুদ্রার মতো মানুষের জীবনেও দুই পিঠ। প্রয়োজন মতো মানুষ তার পিঠ ব্যবহার করে। রূপ বদলে নেয়। একটা কথা না বলে পারছি না যে, আপনাকে সিলেক্ট করাতে আমি খুশি হয়েছিলাম। কারণটা আন্দাজ করতে পারেন?

মাথা নষ্ট করার মতো প্রশ্ন। উত্তরে মাথা নেড়ে অপারগতা জানাতে হলো প্রিয়কে।

পারফেক্ট ম্যান আপনি।

পৃথিবীর কোনো মানুষই পারফেক্ট নিয়ে জন্মায় না সঞ্জু।

গড় কষে বলছি। পত্রিকায় ছাপানোর মতো আহামরি, জলুস ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি। রং দিয়ে ছবি আঁকা সম্ভব, কিন্তু পোড় খাওয়া জীবনকে কীভাবে রং দিয়ে ঢেকে রাখা সম্ভব? আবিদ চাইছে আমাকে নিয়ে সাড়া পড়ে যাক চারদিক। ভালোবেসে? মোটেও তা নয়।

বস সম্পর্কে বসেরই গার্লফ্রেন্ড কথা বলছে। তাই তো? এমন বিশ্লেষণ বাহির থেকে কিঞ্চিত পরিমাণও বোঝা যায় না। সব সম্পর্কগুলো বোধহয় এমন নিয়ম মেনে কৃত্রিম বহিরাবরণে স্বার্থাঙ্গনে হাঁটাচলা করে।

প্রিয়র স্বাভাবিকভাবে বলা কথায় সঞ্জুর খাওয়া থেমে যায়। ওর চোখজোড়া প্রিয়র দিকে স্থির হয়। প্রিয় অপ্রস্তুত। কী বলেছে স্মরণ করে দেখার চেষ্টা করে প্রিয়। কোথাও ভুল বা অন্যায় বলা হলো কিনা।

বেশ বুঝতে পারেন মানুষকে? তীক্ষ্ণ প্রশ্ন।

না। আসলে তা নয়। কিছু কিছু বিষয় চিন্তা-ভাবনার স্বাভাবিক শক্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। তখন আর কী সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। সরি! কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন।

এ রকম ক্ষমা কতজনার কাছে চেয়েছেন?

প্রিয় মাথা নাড়ে। বিশ্বাস করে সঞ্জু।

রাতে বসার সিদ্ধান্ত নিয়ে যার যার রুমে ফেরে ওরা। হাতে নগদ তিন ঘণ্টা। রুমে ফিরে অয়নকে কল দেয় প্রিয়। নো রিপস্নাই। অয়নের এই একটা অভ্যাস, কোন কারণে তার স্বস্তি না থাকলে সহজে সে ফোন রিসিভ করে না। অভিমান হয় প্রিয়র। অভিমানটা অনেক সময় রাগে উত্তীর্ণ হয়। দেশ থেকে এত দূরে এসে যদি খুব সহজে অয়নকে রিচ না করা যায় ফোনে, তাহলে এত টানের কী মানে দাঁড়ায়। এমন অনুভূতিও উঁকি দেয় প্রিয়র মধ্যে। তিন ঘণ্টা সঞ্জুকে নিয়ে ভাবা হলো। তিন ঘণ্টা পর নতুন কিছু শোনার অপেক্ষায় নিজেকে সাঁপ দেয় প্রিয়।

সুইমিং পুলের পাশে একটা নিরিবিলি জায়গায় ওরা বসে। এবেলায় সঞ্জুর পোশাক বদলে গেছে। পরনে নীল শাড়ি। শাড়িতে বেশ মানিয়েছে। চোখ নামানো কঠিন। সেই কথা না বলে থাকেনি প্রিয়। অকৃত্রিম ধন্যবাদ জুটেছে প্রিয়র বিনিময়ে।

প্রিয়। কোটি টাকার প্রজেক্ট আবিদ হাসানের। আমি সেই প্রজেক্টের কাঁচামাল। কী করে হলাম, তার একটা গল্প আছে। শুনবে?

আপনি সম্বোধন থেকে তুমিতে চলে এসেছে সঞ্জু। জড়তা বা আড়ষ্টতা, কোনোটাই নেই। শ্রোতাকে কাছে টেনে নেয়ার গল্পকারের এ এক কৌশল হতে পারে।

মফস্বলের মেয়ে সঞ্জু ভালোবাসতো কলেজের সহপাঠী রুদ্রকে। ভালোবাসার শুরুটা ছিল শৈশব থেকে। সবুজ ঘাস আর মেঠোপথের প্রান্ত ছুঁয়ে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় খুব ভালো ফল হয় রুদ্রের। চলে আসে শহরে চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার ইচ্ছে তার। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সঞ্জুকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন ছিল। ডাকবাক্স নেই। আছে ম্যাসেঞ্জার। ইনবক্স। নিয়মিত যোগাযোগ আর দেখাদেখি চলত এনড্রয়েড ফোনে। টাকা ধার করে সঞ্জু এনড্রয়েড ফোনসেট কিনেছিল। সঞ্জুর অপেক্ষা ছিল কেবল রুদ্রের জন্য। আর রুদ্রের ব্যস্ততা আর অপেক্ষা বেড়ে গেল ভালো একটা ফলাফলের জন্য। কিছুটা অনিয়মিত হয়ে পড়ল যোগাযোগ একপর্যায়ে। অনিয়মিতই একদিন নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। রুদ্রের সহজ দেখা মেলে না। অভিমানে একদিন সঞ্জু শহর অভিমুখী হয়। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রবল ইচ্ছেটা তখন তার একমাত্র সঙ্গী।

কর্মজীবী নারী হোস্টেলে ঠাঁই মেলে। কাজ খোঁজে। হোস্টেলের মেয়েদের সঙ্গে সখ্য গড়ে। বাড়ি থেকে যে কয়টা টাকা সঙ্গে ছিল, একদিন সেটা শেষ হয়ে আসে। রুমমেট রুম্পার মিডিয়ার জগতে ঘোরাফেরা। প্রতিদিন অনেক গল্প শোনে সঞ্জু তার কাছ থেকে। রুম্পা গল্প শোনায় আর আড়চোখে দেখে সঞ্জুকে। পরিমাপ করে, কতটা আগ্রহী হয়ে উঠছে সঞ্জু এ বিষয়ে। সঞ্জু দেখতে সুন্দর। এমন চেহারা দরকার মিডিয়ায়, ঘুরেফিরে শোনায় রুম্পা সঞ্জুকে সেই কথা। হাত খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুম্পার কথা রেকর্ডের মতো কানে বাজতে থাকে।

তারপর একদিন মিডিয়ার আলোয় নিজেকে আবিষ্কারের দৌড় শুরু হয় সঞ্জুর। রুম্পার হাত ধরে ছোটা। রীতিমতো রিলেরেস। রুম্পা সঞ্জুকে আবিদ হাসানের হাতে তুলে দেয়। আবিদ হাসান যেন সেই অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে ছিলেন।

সেই শুরু। একদিন এবং তারপর প্রতিদিন আবিদ হাসানের সঙ্গে দেখা হতে লাগল। রুটিন ওয়ার্ক দাঁড়িয়ে গেল প্রতিদিনের। শহরের ছোট-বড় হোটেল নখদর্পণে চলে এলো। অভাব পূরণের চাহিদা মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি। প্রতিটি মানুষই তার কাছে নতজানু। রুদ্রের অভাব, আর্থিক অভাব দূর করার প্রবল চাহিদা সঞ্জু একসময় নিজের ভেতর আবিষ্কার করে। যোগ আর বিয়োগের প্রাপ্য ফলাফল হয়ে আসে আবিদ হাসান। আস্থা আর ভরসার কারুকাজময় এক সত্তায় পরিণত হয়। সঞ্জুর একমাত্র আপনজন হয়ে ওঠে।

এভাবে কেটে যায় অনেক কটা দিন। তারপর হঠাৎ অনেক গল্প নিয়ে হাজির একদিন অল্পবয়সী অপরিচিত এক নারী। সুদর্শনা। স্মার্ট। বাসার ঠিকানায় উপস্থিত। প্রযুক্তির যুগে আজকাল কাউকে খুঁজে বের করা কোনো কঠিন কাজ নয়। সঞ্জু আর আবিদ হাসানের ঘনিষ্ঠতাপূর্ণ অনেক গল্প তার জানা। সঞ্জুর শরীরে কোথায় লাল তিল আছে, জন্মগত একটা দাগ আছে, সেই গল্পও অকপটে শুনিয়ে দিল সঞ্জুকে। এত গোপন কথা কী করে জেনে গেল এই নারী? বিস্ময়ের চেয়ে বড় ধাক্কা ছিল কে এই নারী প্রশ্নটি। অনেক উত্তর প্রশ্ন ছাড়াই পাওয়া যায়। নারীর পরিচয় পাওয়া গেল। আবিদ হাসানের দূরত্বহীন কাছের একজন বান্ধবী। অপরিচিত নারী সঞ্জু সম্পর্কে যে তথ্য দিয়ে ফেলল, তাতে তাকে আর অবিশ্বাস করার সুযোগ থাকে না। বিশ্বাস করতে হলো এই সুদর্শনা আবিদ হাসানের দূরত্বহীন কাছের জন।

একটু বাতাসেই দুলে ওঠে মানুষের মন। বাতাস যদি ঝড়ের হয় তাহলে কথাই নেই। সহজে দোলা থামে না। আবিদকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না। সঞ্জুর অন্যমনস্ক হয়ে পড়া আবিদের চোখকে ফাঁকি দিল না।

এনিথিং রং, ডার্লিং?

ডার্লিং সম্বোধনের আকর্ষণ উধাও। অপরিচিত নারীর সঙ্গে সঞ্জুর সাক্ষাতের ফল সম্ভবত এটা। গায়ে পড়া, গায়ে পড়ে নুইয়ে থেকে বোঝাতে চাইছিল যে, সঞ্জুর স্পর্শ ছাড়া আবিদ হাসানের সুস্থতা নেই। মনটা আর বিশ্বাসের জায়গায় এসে দাঁড়ায় না সঞ্জুর। বিশ্বাসই বোধহয় একমাত্র স্থাপনা, যা ভেঙে গেলে পুনর্নির্মাণ হয় না। সংস্কারও চলে না।

রুদ্র ফিরে এসেছে। রুদ্রের নাম বলতেই ফোলা বেলুনে খোঁচা লাগল যেন। সব বাতাস বেরিয়ে চুপসে গেল। বানোয়াট গল্প সঞ্জুর। আবিদ হাসানের কাছ থেকে দূরে থাকার কৌশল। কাজে দিল। সেদিনের মতো দূরত্ব বজায় ছিল। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে আবার ফিরে যায় আবিদ হাসান তার জায়গায়।

সঞ্জুর গল্পে রাতটা ফুরোচ্ছে না। প্রিয় অন্য এক সঞ্জুকে বুঝতে যাত্রা শুরু করেছে। গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেশ। গল্পের এই জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল সঞ্জু। টেবিলে রাখা পানিশূন্য গস্নাসের দিকে অপলক চেয়ে কিছু ভাবছে।

প্রিয়! ভুল আর অন্যায় কী এক বিষয়?

ভুল অসাবধানবশত হতে পারে। অন্যায় মানুষ জেনেশুনেই করে। প্রিয়র ব্যাখ্যায় সঞ্জুর স্বস্তির নিঃশ্বাস।

কেন এতটা বিশ্বাস নিয়ে আবিদ হাসানের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠল, ভেবে পাই না আজও।

কিসের অবিশ্বাস?

ভালোবাসার। নারীপ্রীতি আসলে আবিদ হাসানের একটা শখ। বলতে পারো বদাভ্যাস।

এত কিছু বুঝেও কেন তার সঙ্গে পথচলা! প্রিয় বিস্মিত দেখে সঞ্জুর ঠোঁটের কোণে একফালি হাসি উঁকি দিয়ে মিলিয়ে গেল।

গাড়িটা খুব দ্রম্নত চলছিল। হঠাৎ ব্রেক করা রিস্ক। দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ধীরে ধীরে ব্রেক করতে হবে। সেই অপেক্ষা। অপেক্ষার সঙ্গে তুমিও আছো।

কীভাবে?

এই স্টোরি তোমাকেই তৈরি করতে হবে। যেন আবিদ হাসানের মতো সাইকোপ্যাথিক মানুষের মুখোশ খসে পড়ে। তোমরাও স্বচ্ছন্দে সাংবাদিকতা করতে পারো।

নয়নের কল রিং প্রিয়র মোবাইলে। অভিমান গেছে সম্ভবত অয়নের। একটুও দেরি করল না ফোন রিসিভ করতে প্রিয়, হ্যালো অয়ন! ওপাশ থেকে অয়ন-

এভাবে ফাঁকি না দিলেও পারতে প্রিয়! অয়নের কথায় অবিশ্বাসের সাইক্লোন। কী বলছে, কেন বলছে এসব, সঞ্জুর সামনে অয়নকে প্রশ্ন না করার কারণ, অয়নকে ছোট না করা। বিশ্বাস দিয়ে যে সম্পর্ক শুরু, তার মধ্যে অবিশ্বাসের অস্তিত্বকে দেখা মানে তাকে ছোট করা। প্রিয় ছোট করতে চায়না অয়নকে সঞ্জুর সামনে। অথচ কথাটা বলে অয়ন ফোন কেটে দিল। সঞ্জু বলে, অয়নের কোনো দোষ নেই। এসব আবিদ হাসানের কাজ। তোমার সঙ্গে আমার স্ক্যান্ডাল ছড়াতেই সে এই কাজটি করেছে প্রিয়। কোটি টাকার ছবির অভিষেক নিছক একটা অজুহাত মাত্র।

দুটো দিন ব্যাংকক ঘোরাফেরা। অতঃপর অন্য এক স্টোরি নিয়ে দেশে ফেরে সঞ্জু আর প্রিয়। আবিদ হাসানের উদ্দেশ্য হাসিল হয় না। ফাঁস হয়ে যায় তার কুকর্ম। সাংবাদিক হিসেবে প্রিয়র কর্মতৎপরতা বেড়ে যায় ভিন্ন পত্রিকায়। আর সঞ্জু ফিরে যায় সবুজে, তার পুরনো ঠিকানায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<75492 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1