বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরাঞ্চলের লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও আব্বাস উদ্দীন আহমদ

জোবায়ের আলী জুয়েল
  ২২ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

উত্তর জনপদ ভাওয়াইয়া গানের প্রাণকেন্দ্র। ভাওয়াইয়া গানে বাংলাদেশের মানুষের অন্তর আবহমানকাল ধরে হয়েছে সমৃদ্ধ।

ভাওয়াইয়া মূলত ভাবপ্রধান গান। ভাব শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি। আবার 'ভাওয়া' শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া এসেছে এমনও মনে করা হয়। কাশ বা নলখাগড়ার বিস্তীর্ণ চরকে 'ভাওয়া' বলা হয়। ভাওয়াইয়া ধু-ধু প্রান্তরের গান। সাধারণত গরুর গাড়ি এবড়ো-খেবড়ো মাটিতে যাত্রী নিয়ে যাওয়ার সময় মৈশাল এ গান গেয়ে থাকে। গরুর গাড়িই ভাওয়াইয়া গানের মূল উৎস বলা যায়। এ গানের মূল সুর নর-নারীর প্রণয়। প্রণয়ের জ্বালাই এতে অধিক রূপায়িত হয়। মৈশাল, গাড়োয়ান, মাহুত প্রমুখ এই প্রণয়গীতির নায়ক।

ভাওয়াইয়া গান মূলত কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট অঞ্চলের গান। দোতরা সহযোগে দীর্ঘলয়ে এ গানগুলো গাওয়া হয়ে থাকে। প্রেম বা ভাবই ভাওয়াইয়া গানের মূল উপজীব্য। আকাঙ্ক্ষিত বস্তু না পাওয়ার মধ্যদিয়েই নর-নারীর মনের সূক্ষ্ণতম ভাবগুলো বিকাশ লাভ করে। পাওয়ার মধ্যে যে পূর্ণতা আছে, তা দ্বারা হৃদয়ের সূক্ষ্ণতম ভাবগুলো আচ্ছন্ন হয়ে যায়, সেজন্য প্রাণে যেখানে রিক্ততার বেদনা জাগে, সেখানেই মধুরতম সংগীত জন্মলাভ করে। আর যে গানের কথায় ও সুরে পলস্নীর সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা এবং জীবনবোধের সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখতে পাই এবং যে গানের রচয়িতা ও সুরকারের সঠিক নাম জানা যায় না। অথচ যে গান যুগ যুগ ধরে গ্রাম-বাংলার সব শ্রেণির মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে তাকেই এক কথায় লোকসংগীত বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ গান আমাদের লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এবং আমাদের দেশের অমূল্য সম্পদ। ভাওয়াইয়া গান সুর লালিত্যে ভরপুর এবং এর একটি নিজস্ব গীতরীতি আছে। বৈশিষ্ট্যগত কারণে সাধারণত উত্তর বাংলার শিল্পী ছাড়া এ গানের সুর সংযোজন সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।

উত্তরাঞ্চলের লোকসাহিত্যের উপাদানগুলো সর্বপ্রথম সংগ্রহ করেন স্যার জর্জ অ্যাব্রাহাম গ্রিয়ারসন। যদিও তিনি ইংরেজ ছিলেন তবুও বাংলাভাষা ও লোকসাহিত্যের প্রতি তার ছিল গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসা। তিনি 'মানিক চন্দ্রের গান' একজন সাধারণ কৃষকের কাছে থেকে সংগ্রহ করেন। 'জার্নাল অব এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল' পত্রিকায় প্রাঞ্জল ইংরেজিতে অনুবাদসহ প্রকাশ করেন। তার সংগ্রহগুলো প্রকাশিত হওয়ার পরই আমাদের সাহিত্য বিদেশি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

গ্রিয়ারসন সম্পাদিত ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত 'খরহমঁরংঃরপ ঝঁৎাবু ড়ভ ওহফরধ'-এর পঞ্চম খন্ডে তিনি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বহু গানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যা পরে আব্বাস উদ্দীন আহমদ কর্তৃক সংগৃহীত গানগুলোতেও পাওয়া গেছে। আজ অবশ্য উত্তরাঞ্চলের লোকঐতিহ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত। আমরা জানি বাংলাদেশে লোকগীতিকা ও লোকসংগীতের যে বিপুল ভান্ডার সঞ্চিত আছে অনেক মনীষীর মতে তা বিশ্ব জয় করতে পারে।

উত্তরাঞ্চলের লোকসংগীত আলোচনা প্রসঙ্গে এখানকার প্রাকৃতিক এবং অন্যান্য অবস্থা সম্পর্কে আমাদের কিছুটা প্রাথমিক ধারণা থাকা আবশ্যক। বৃহত্তর রংপুর জেলার পার্শ্বেই জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা, পূর্বে আসামের গারো পাহাড় ও পশ্চিমে যমুনা নদী, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, করতোয়া, পূর্ণভবা, ধরলা, সমকা ও দুধকুমার প্রভৃতি নদীর পলি দিয়ে গঠিত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের মাটি। এই নদীগুলোর নিরন্তর ধারা পরিবর্তন, ধূসর বালুচরের সূচনা ও এখানকার অধিবাসীদের মনকে উদাস করে সৃষ্টি করেছে লোকসাহিত্যের উর্বর পশ্চাদভূমি। নদ-নদীর ঐশ্বর্যে চিহ্নিত বাংলাদেশের প্রায় সব জেলার লোকসাহিত্য সম্পর্কে এ কথা সর্বজন বিদিত।

এখানকার প্রাথমিক যুগের নৃপতিদের মধ্যে রংপুরের 'চাকলা বোদা' নামক স্থানে নৃপতি পৃথ্বিরাজের রাজত্বকালীন স্মৃতির ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়েছে। নীলফামারী জেলার ডিমলা নামক স্থানের কিছু দক্ষিণে ধর্মপালের স্মৃতি বিজড়িত অনেক বিষয়াদির অনুসন্ধান পাওয়া গেছে। সাঁওতাল, কোচ, হাজং, রাজবংশী ইত্যাদি উপজাতীয় সংস্কৃতির রসধারায় লোকসংগীতের ভান্ডার পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।

উত্তরাঞ্চলের লোকসংগীতের মধ্যে ভাওয়াইয়া গান সমাজের সাধারণ স্তরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভাওয়াইয়া গান তথ্য ও ভাবপ্রধান, নর-নারীর প্রেমই এর মূল বিষয়বস্তু। বিরহই প্রেমের সর্বোত্তম অংশ। এর প্রধান ভাবধারা বিরহের কিংবা অতৃপ্তির যে দীর্ঘ নিঃশ্বাস শুনতে পাওয়া যায় তা এ গানকে এক অনবদ্য বেদনা মধুর রস রূপ দিয়েছে। এ ধরনের একটি গানের কয়েকটি লাইন উদ্ধৃতি দেয়া হলো-

পরথম যৈবনের কালে না হৈল মোর বিয়া

আর কতকাল রহিম ঘরে একাকানী হয়া

রে বিধি নিদয়া

হাইলা পৈল মোর সোনার যৈবন মলেয়ার বাড়ে

মা ও বাপে মোর ইল সাদী না দিল পরের ঘরে

রে বিধি নিদয়া।

উদ্ধৃত লাইনগুলোর মধ্যে নারী মনের হতাশা ও নিরাশার সুর ধ্বনিত হয়েছে। ভাওয়াইয়া গানও এই রিক্ততার বেদনায় মধুর হয়ে উঠেছে। ঘরের মধ্যে কাঁচা সোনা ফেলে রেখে যে সওদাগর পোড়া সোনার সন্ধানে দূর দেশে যায়, তার মতো মূর্খ আর কে আছে? তার প্রেমেরই বা কি মূল্য। ঘরের কাঁচা সোনা যে চিনল না, সে বিদেশের পোড়া সোনা চিনবে কি করে? নিরক্ষর কোনো অজানা কৃষক কবির রচনায় এই অপূর্ব ভাবটি কি মধুর রসেই না ব্যঞ্জনা লাভ করেছে।

ধন কাঙ্গালি সাউধের ছাইলা রে-

আরে মোর ধনক নাই গো মন,

ঘরে থুইয়া কাঞ্চা সোনা (ও মোর বন্ধু) বৈদেশে গমন।

আধ্যাত্মিক চেতনাসমৃদ্ধ ভাওয়াইয়া গানও পরিলক্ষিত হয়। যেমন-'ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে', 'ছাড়রে মন ভবের খেলা' ইত্যাদি। 'বাউদিয়া' নামক উদাসী সম্প্রদায় এ গানের রূপকার। কারও কারও মতে এই 'বাউদিয়া' থেকেই ভাওয়াইয়া কথাটির উৎপত্তি হয়েছে।

ভাওয়াইয়া গান প্রধানত দুই প্রকার- দীর্ঘ সুর বিশিষ্ট ও চটকা সুর বিশিষ্ট। প্রথম শ্রেণির গানে নর-নারীর বিশেষত নব-যৌবনাদের অনুরাগ-প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার আবেদন ব্যক্ত হয়। এরূপ গানের মধ্যে 'ওকি গাড়িয়াল ভাই' 'যেজন প্রেমের ভাব জানে না' 'কোন দ্যাশে যান মইশাল বনদূরে' 'নউতন পিরিতের বড় জ্বালা' ইত্যাদি অধিক জনপ্রিয়।

ভাওয়াইয়া গানের অন্য অংশের নাম চট্‌কা গান। গ্রামে চট্‌ শব্দের অর্থ তাড়াতাড়ি। চট্‌কা সুরের ভাওয়াইয়া গান খুব দ্রম্নত লয়ে গাওয়া হয় বলে এ গানগুলোকে আমরা চট্‌কা নামে অভিহিত করে থাকি। ভাওয়াইয়া গানে গুরুগম্ভীর বিষয় ও দীর্ঘ টানের সুর ব্যবহৃত হয়, লঘু স্তরের বা চট্‌কদার বিষয় ও ক্ষিপ্রতালে সুর অবলম্বন করে চট্‌কা গান রচিত হয়। এ শ্রেণির গানে যথেষ্ট হাস্যরসের উপাদান থাকে। চটকা গানের ভিতর দিয়ে সাধারণত দাম্পত্য জীবনের আশা, আকাঙ্ক্ষা, মনোমালিন্য, কামনা-বাসনা ও সংসার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের চিত্র প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। 'ওরে পতিধন বাড়ি ছাড়িয়া না যান' 'পানিয়া মরা মোক মারিলুরে' 'ওরে কাইনের ম্যায়ার ঠসক বেশি/ব্যাড়ায় শালী টাড়ি টাড়ি' প্রভৃতি গান এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

এই দুই শ্রেণির গানের সুরের মিশ্রণে অন্য এক শ্রেণির গানও প্রচলিত, যা ক্ষীরোল গান নামে পরিচিত। যেমন- 'আমায় এত রাতে কেনেরে ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে'। 'কোন- বলে ডাকিলু কোকিলরে'।

মইশের পিঠে চড়ে মইশালরা মাঝে মাঝে উঠে মইশ চড়াতে আসে, গ্রামের তরুণীরা কাপড় ধোয়ার অথবা কলস ভরার ছল করে নদীর পাড়ে এসে মইশালদের ভাওয়াইয়া গান শুনে মুগ্ধ হয়। মইশালরা যখন ঘরে ফিরে যেতে শুরু করে, তখন নারী হৃদয় মইশালদের আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় শোকার্ত হয়ে ওঠে। তারা মইশালদের যেতে দিতে চায় না। মইশালদের উদ্দেশ্যে তারা গেয়ে ওঠে-

'কোন দ্যাশে যান মইশাল বন্ধু

মইশের পাল লইয়া

ওরে আইজ ক্যানেবা মইশাল তোমরা

মইশের বাতান থুইয়ারে'

ভাওয়াইয়া গানের সুরের বৈচিত্র্য হচ্ছে, এই গানের টানা সুর, তাতে শিল্পীর গলা ভাঙার আশঙ্কা থাকে। তবে চট্‌কা গান চটুল, দ্রম্নত তালের এবং পরিবেশ নিতান্তই ঘরোয়া। দোতরা ভাওয়াইয়া গানের প্রধান বাদ্যযন্ত্র।

ভাওয়াইয়া গানে বাংলাদেশের মানুষের অন্তর আবহমানকাল ধরে হয়েছে সমৃদ্ধ। শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ ভাওয়াইয়া গানকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি ভাওয়াইয়া গানকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষের মুখ থেকে তুলে এনে শহরের শিক্ষিত মানুষের ড্রইংরুমে জায়গা করে দিয়েছিলেন। আব্বাস উদ্দীন আহমদকে ভাওয়াইয়া গানের পথিকৃৎ বলা যায়।

ভাওয়াইয়া গানকে যারা গ্রামের অভব্য শ্রেণির গান বলে ঘৃণা করতেন তারাও গোপনে তাদের ড্রইংরুমে বসে বিমুগ্ধ হয়ে শুনতেন আব্বাস উদ্দীন আহমদের মধুঝরা কণ্ঠের ভাওয়াইয়া।

সংগৃহীত ভাওয়াইয়ার পাশাপাশি রয়েছে বিখ্যাতজনদের লেখা ভাওয়াইয়া গান তারা হলেন- তুলসী লাহিড়ী, আব্দুল করীম, একেএম আব্দুল আজিজ, কাজী মকবুল হোসেন, হাফিজুর রহমান, হরলাল রায়, মহেশ চন্দ্র রায়, সিরাজ উদ্দীন, মো. কছিম উদ্দীন, রবীন্দ্রনাথ মিশ্র, শমসের আলী, নুরল ইসলাম জাহিদ, নীল কমল মিশ্র, মোস্তাফিজুর রহমান।

ভাওয়াইয়া গায়ক আব্বাস উদ্দীন আহমদের জন্ম কোচবিহার জেলার কালজানি নদীর নিকটবর্তী বলরামপুর গ্রামে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর। তার পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ জাফর আলী আহমদ। মাতার নাম হীরামন নেসা। মৌলভী মোহাম্মদ জাফর আলী আহমদ অত্রাঞ্চলের জোতদার এবং একজন প্রথিত যশা আইনজীবী ছিলেন।

আব্বাস উদ্দীন আহমদ শৈশব থেকেই তীক্ষ্নবুদ্ধি ও মেধাসম্পন্ন ছিলেন। তিনি ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন তুফানগঞ্জ হাই স্কুল থেকে। ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি ভর্তি হয়েছিলেন কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজে। কৃতিত্বের সঙ্গে আইএ পাস করার পর তিনি বিএ পড়তে আসেন আমাদের রংপুর কারমাইকেল কলেজে এবং পরে রাজশাহী কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তিনি এ দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশিদিন লেখাপড়ার সুযোগ পান নাই। এরপর তিনি বিএ ভর্তি হন কোচবিহার কলেজে। কিন্তু এখানেও বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন নাই।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্টের পর তিনি তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে গান গাওয়া শুরু করেছিলেন। চাকরি নিয়েছিলেন পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে।

কোচবিহারের এক অনুষ্ঠানে আব্বাস উদ্দীন আহমদের গান শুনে কাজী নজরুল ইসলাম বিমোহিত হয়েছিলেন। তাকে তিনি কলকাতায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

আব্বাস উদ্দীন আহমদ মাত্র ২৩ বছর বয়সে কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানিতে দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করেছিলেন বিমল দাস গুপ্তের সহায়তায় এবং শৈলেন রায়ের লেখা গান দুটি সে সময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। গান দুটি ছিল 'কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল ঝরে গো' এবং 'স্মরণপারের ওগো প্রিয়'।

কাজী নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতায় আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামী গানের পাশাপাশি একাধিক ভাওয়াইয়া গানের রেকর্ড হয়েছিল। বলাবাহুল্য, গানগুলো সে সময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরে আব্বাস উদ্দীনের কী গান বাজারে আসছে সেই গান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন গ্রামোফোন কোম্পানির লাখো লাখো শ্রোতা। পাঁচ হাজার অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়ে তিনি সংগ্রহ করেছেন অনেক দুর্লভ ভাওয়াইয়া গান। যার বেশির ভাগ গানে তিনি সুর সংযোজন করে গানগুলোকে সুখ শ্রাব্য করেছিলেন।

তার ছোট ভাই আব্দুল করীমের লেখা ভাওয়াইয়া গানগুলোতেও তিনি সুরারোপ করেছিলেন। শুধু দেশে নয়- লস অ্যাঞ্জেলস, শিকাগো, নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, টোকিও, মেলবোর্নসহ পৃথিবীর বহু দেশে তিনি এই ভাওয়াইয়া পরিবেশন করে ভাওয়াইয়া গানকে বিশ্বসভায় স্থান করে দিয়েছিলেন।

আব্বাস উদ্দীন আহমদ যখন গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন মুসলমানদের গান গাওয়া ছিল হারাম। কিন্তু আব্বাস উদ্দিন আহমদ মুসলমান নাম নিয়েই গান গেয়েছেন এবং তার বিশেষ গায়কী ঢং ও সুরেলা কণ্ঠ জয় করেছিল অসম্ভব সে যুগের প্রতিকূল অবস্থাকে। এটি ছিল আব্বাস উদ্দীন আহমদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। আব্বাস উদ্দীন আহমদ ছিলেন ভাওয়াইয়া গানের জনক। তিনি হলেন ভাওয়াইয়া সংগীতের কিংবদন্তির ইতিহাস এবং একটি মাইলফলক। বাংলাদেশের মুসলমানের হৃদয়ে পৌঁছানোর ছিল সে সময় দুটি পথ। তার একটি তাদের মনের কথা এ দেশের 'লোকগীতি' অন্যটি তাদের প্রাণের কথা- 'ইসলামী গান'। আব্বাস উদ্দীন আহমদ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এবং সুকৌশলে বেছে নিয়েছিলেন এ দুটি পথ। অনেকে মনে করেন আব্বাস উদ্দীন আহমদের গ্রামের বাড়ি রংপুরে, আসলে কথাটা ঠিক নয়। রংপুরে কখনই তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন নাই। ঢাকার পুরনো পল্টনে স্থায়ীভাবে আব্বাস উদ্দীন আহমদ বসবাস করতেন। আব্বাস উদ্দীনের গানের রেকর্ডগুলো এক অমর কীর্তি। আমার শিল্পীজীবনের কথা (১৯৬০ খ্রি.) তার রচিত একমাত্র গ্রন্থ। তিনি সংগীতের অবদানের জন্য 'মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০ খ্রি.)', 'শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৯ খ্রি.)' এবং 'স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১ খ্রি.)' ভূষিত হন। উলেস্নখ্য, তার কনিষ্ঠ পুত্র মোস্তফা জামান আব্বাসী এবং কন্যা ফেরদৌসি রহমান ও খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী।

ভাওয়াইয়া গানের জনক আব্বাস উদ্দীন আহমদ দীর্ঘদিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগ ভোগের পর ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর (১৯০১-১৯৫৯ খ্রি.)।

আব্বাস উদ্দীন আহমদ ভাওয়াইয়া গানকে কণ্ঠে তুলে নিয়ে বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করে গেছেন, বাঙালি জাতি সে জন্য চিরকাল তাকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<76492 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1