মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মায়াবী উপাখ্যান

আহম্মেদ পিন্টু
  ২৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আজ বহুদিন পর ছবুর আলী তার নিম্নাঙ্গে চেয়ে অপ্রতিভ হয়ে উঠল। কত বছর কেটে গেল, এমনি করে বেঁচে আছে সে! কী এক অদ্ভুত ব্যাপার! কী এক রহস্যময় হিসাব-নিকাশ! একদিন সে মরে যেতে চেয়েছিল। এ জগতের সব আনন্দ-তৃষ্ণা-মোহ তার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল। জীবনকে টেনেহেঁচড়ে বয়ে বেড়ানো মৃতু্যর চেয়েও দুর্লঙ্ঘ হয়ে উঠল। ঝাঁপ দিল মৃতু্য-সাগরে।

সেই রাতে স্রষ্টা নেমে এসেছিল এ ধরায়। ছবুর আলীর মৃতু্য-পথ রুদ্ধ করাই ছিল তখন তার একমাত্র কাজ। মহাবিশ্বের সবকিছু থমকে ছিল। সবাই মূর্তির মতো স্থির হয়ে চেয়ে ছিল ছবুর আলীর দিকে। না, ছবুর আলী আর মরতে পারল না।

ফাঁসের দড়িটা যদি ছিঁড়ে না পড়ত আজও এই ৬২ বছর বয়সে জগতের রঙ্গ সিংহাসনের রাজা হয়ে যে রূপ-রস-গন্ধ মুহুর্মুহু ভক্ষণ করে নিজেকে পূর্ণ করে চলেছে তা সেখানেই শিশিরবিন্দুর মতো টুপ করে ঝরে পড়ত। সরু খাল বেয়ে বহমান ছিপছিপে ডিঙ্গির মতো জল বয়ে যাচ্ছে তার চোখের খাল বেয়ে। চোখের জলের কোনো রং হয় না, কিন্তু এ জলের হয়। এ জল রংধনু। ছবুর আলীর মনের আকাশটা আজ রঙিন। রংধনুর সাতরঙে রাঙানো। চোখ তার প্রচার আর জল হলো প্রসার। বেঁচে থাকায় যে এত আনন্দ তা তাকে আবেগের জালে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে তোলার মতো হালকা ফুরফুরে করে তোলে।

একদিন ছবুর আলীর বাল্যকাল ছিল, ছিল কৈশোর, ছিল যৌবন। বাল্যকালটা বেশ ডাগর ছিল, বাবা-মায়ের আদর-ভালোবাসায়। কৈশোরে পা রাখতেই বাবা ঝরে গেল। অভাব ঠেলতে ঠেলতে মায়ের ফুরসতই হয় না ছেলের দিকে তাকানোর। ছেলেটিও মায়ের অভাব-ক্লিষ্ট নিপীড়িত করুণ মুখখানি চেয়ে দু'মুঠো অন্নের প্রয়োজনে স্নেহ-মমতার দাবি বিসর্জন দিয়ে মায়ের হাতে হাত মেলাতে লাগল। বিধাতার আঘাত লীলা হিসেবে স্বীকৃত, সে কেন এমন খেলা খেলল জানি না- কৈশোর শেষ হতে না হতেই মাকেও তুলে নিল। পিতৃ-মাতৃহীন অভাব-দুর্দশা-পীড়িত ছবুর আলীর কাজের লোক হিসেবে ঠাঁই হলো মহসীন দেওয়ানের বাড়িতে। বিদ্যারথে চড়ার বড়ই শখ ছিল তার। দু'চার ধাপ দিয়েও ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যাত্রা ওই পর্যন্তই। নিজ ঘরেই যে-পিপাসা মেটেনি, পর-গৃহে তা পান করতে চাওয়াটা নিতান্তই অপরাধ বৈকি! তাই মন-প্রাণ ঢেলে গৃহস্থের কাজ করে যেতে লাগল।

বেশ কেটে যাচ্ছিল দিন। এরই মধ্যে একটা স্বপ্ন এসে জড়ো হলো বুকের মধ্যে। সারাজীবন সে মানুষের গৃহে নিজেকে বন্দি করে রাখবে না। একদিন স্বাধীন হবে। বেতনের টাকা যতটা পারে সে জমাবে। এই টাকা দিয়ে একদিন সে গ্রামের সড়কের মোড়ে ছোট্ট বাজারটিতে দোকানঘর তুলবে। নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করবে।

স্বপ্নভরা বুকটা পুঁইয়ের ডাঁটার মতো তরতর করেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বিধাতা বোধ হয় সত্যিই এদের ওপর চটেছিল- হাট থেকে সাইকেল চালিয়ে ফেরার সময় সামনে থেকে ডান পায়ে বজ্রাঘাতের মতো আছড়ে পড়ে একটা মোটরসাইকেল, পা-টা কলে পিষা আখের ছোবড়ার মতো নিঃস্পন্দ হয়ে উই ধরা বাঁশের খুঁটির মতো হেলতে-দুলতে থাকে। প্রাণের বদলে পা-টা ছেড়ে দিতে হয়। হাঁটুর কিছুটা উপরিভাগ পর্যন্ত ফেলে দিতে হলো। ক্ষত সেরে ওঠার কয়েকদিন পরেই সে ওই আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল। মহসীন দেওয়ান তাকে ছুড়ে ফেলে দিল। মন আছে, প্রাণ আছে, হৃদয় আছে, যৌবন আছে, মেধা আছে, দেহের ঘরটাও আছে, শুধু নেই তার একটা খুঁটি- তাই সে মূল্যহীন, অপাঙ্‌ক্তেয়। সমাজের আর দশজনের কাছেও ধরনা দিয়েছিল, কিছু টাকা ধার দিলে সে মোড়ের ওপর পান-বিড়ি-সিগারেটের একটা দোকান দেবে- কারও হৃদয় গললো না; এদেরও মন-প্রাণ-হৃদয়-দেহ সবই ছিল, কিন্তু কারও হৃদয়ের খুঁটি ছিল না। কী করবে সে? ক্রাচে ভর করা জীবন। ইঞ্চি পরিমাণও জায়গা-জমি নেই, পয়সা নেই, যা জমেছিল তা নিয়ে গেছে পা, ঘরটাও অন্যের মাটিতে। কাঁধে উঠল ভিক্ষার ঝুলি।

অন্তত নিজ এলাকায় সে যুবকত্বের মর্যাদা বিসর্জন দিতে চায়নি। বেশ খানিকটা দূরে এইখানে এই রেলওয়ে পস্নাটফর্মে জায়গা হলো তার। চলিস্নশ বছর ধরে সে এই এলাকায় দিন কাটায় দ্বারে দ্বারে আর রাত কাটায় এই পস্নাটফর্মে।

পেছন থেকে একটা হাত এসে আলতো করে চাপ দিল ছবুর আলীর কাঁধে। ঘুরে তাকালো সে। চক্ষুদ্বয় স্থির হলো। কিছুটা বিস্ময়ের একটা খেয়ালি টানাপড়েন তাতে। অন্য স্থির চোখজোড়া অতি স্বাভাবিক। ঠোঁটে কম্পিত মৃদু হাসি।

কী, চিনবার পারিস না ছবুর আলী? বাক্যটি শেষ করতে করতে সামনে এসে মুখোমুখি বসলেন তিনি। ছবুর আলীর দৃষ্টিটা ঘুরে আবারও ওই একই ভঙ্গিতে থমকে রইল। এবার তিনি ঠোঁটটা খুলে মৃদু শব্দে হেসে ছবুর আলীর কাঁধে বার দুই চাপড় মেরে বললেন, আরে আমি মোবারক! মোবারক দেওয়ান! চোখদুটো নড়েচড়ে উঠল। ঠোঁটের ফাঁকে এক ঝলক হাসি শুশুকের মতো ভুস করে জেগে উঠল। মনটা ফিরে গেল চলিস্নশ বছর আগের সেই দেওয়ান বাড়ির আঙিনায়। দুই চোখ ভরে নেমে এলো ভালোবাসার ঢল। মোবারক দেওয়ানের চেহারার মধ্যে কী যেন খুঁজতে লাগল সে।

এই ফাঁকে মোবারক দেওয়ান সম্পর্কে দুটো কথা বলি। মহসীন দেওয়ানের প্রথম পুত্র এই মোবারক দেওয়ান। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায় অবস্থানটা বেশ উঁচু। সরকারি চাকরিতে যে চেয়ারটি দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয় তা ছিল ঈর্ষণীয়। একদিন শেষ চেয়ার পর্যন্ত তিনি পৌঁছেছিলেন। দুর্নীতির ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে গড়েছেন অর্থের পাহাড়, করেছেন বাড়ি-গাড়ি। বছর চারেক হলো অবসরে গেছেন। এখনো বিভিন্ন নামি-দামি উচ্চপর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে আকর্ষণীয় প্যাকেজে আবদারের কমতি নেই, তিনি মোটেও সাড়া দেন না।

মোবারক ভাই! ছবুর আলীর মুখে হাসি জ্বললেও চোখে জলের আঁধার।

মোবারক দেওয়ান ঠোঁটটা একরত্তি শুষ্ক মর্মর হাসিতে ভিজিয়ে নিয়ে চোখজোড়া অর্ধনমিত করে মাথা উপর-নিচ করতে থাকে। পরক্ষণেই জানতে চান-

তে তুই ক্যামুন আছু ছবুর?

ভালো আছি মোবারক ভাই? তার চোখটাও যেন হেসে উঠল। তুমি মোবারক ভাই?

এ...ই আছিরে! জবাবের ধরনটা যুতসই ঠেকল না তার কাছে। মনের দেয়ালের রংটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল।

কুন্টে যাবেন?

কুন্টেও লয়, তুর কাছেই অ্যালছি।

ছবুর আলীর কাছে মোবারক দেওয়ান আসবে, এ কেমন কথা! এ কি কখনো হয় না-কি! তার চৌদ্দগুষ্ঠির তো কেউ কোনোদিন তাদের কোনো উপকার করেনি। তারই-বা এখন কী করার আছে? কোনো অপরাধ করেছে না-কি সে? মনে তো পড়ে না। সে যে ঢঙে চেয়ে আছে মোবারক দেওয়ানের দিকে, যেন অর্ধ-প্রস্ফুটিত শাপলা।

নিঃশব্দে হেসে বলেন, তুর কাছেই অ্যালছি, তুর কাছেই। তুই ভাবুত্তু, তুর কাছে কিসোক অ্যালছি দুনিয়াত এ্যাতো মানুষ থাকতে? একটু থেমে বলেন, যার কাছে যাই ব্যাবাক আমারই মতো, তাই তুর কাছে অ্যালছি। মন অশান্তিত ভরা, কিচ্ছু ভালো লাগে না।

তুমার ব্যাটা-বিটিরা?

এক ব্যাটা এক বিটি, দুজনেই আমিরিকাত থাকে। আমিরিকা বুঝিস তো?

মাথা কাত করে বলে, হঁ্যা।

গাঁওত শুননু তুই বিয়া করিসনি। দুই-একজন তুর খবর জানে। বিয়া করিসনি ক্যা?

লিজেই চলব্যার পারি না, আবার বউ! তার কণ্ঠাদেশ ফেটে আক্ষেপ গলে পড়ে।

যৌবনত কষ্ট দিছু!

ফকিরের আবার যৌবন! এক ঘাটোত ভিড়লেই হয়!

আচ্ছা ছবুর, এ্যাতোদিন জি তুর কুনো খুঁজ-খবর করিনি, আমার উপুর তুর ঘিন্না বা রাগ হত্তে না?

যার জীবন তাকই চালান ল্যাগবে, আগ হবে ক্যা। তুমাক দেকা আমার যা শান্তি ল্যাগিত্তে মোবারক ভাই!

তুরা কত সহজেই শান্তি প্যাস ছবুর! একটা নিশ্বাস বুকের খাঁচা ভেঙে বের হয়ে আসে। তুই কি জানিস, এই দ্যাশের জন্য তুই কী করুছু?

একটা অস্পষ্ট লজ্জারেখা দ্রম্নতগতিতে মুখাকাশে চিলিক মারল বিদু্যৎ-রেখার মতো।

কী করমু! কিছুই করব্যার পারিনি। দ্যাশটাত থ্যাকা খালি লিই, কিছু দিবার পারি না!

তুই খালি লিছু, কিছুই দিবার পারিসনি, কিন্তু তুই কুনো ক্ষতি করিসনি। আর আমি? যা দিছি তার ম্যালা বেশি লিছি। দ্যাশটার ম্যালা ক্ষতি র্কোযা ফেলিছি।

ছবুর আলী নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে। মোবারক আলী দড়াম করে শুয়ে পড়ে ছবুর আলীর বিছানায়। চটের বিছানা, আর ছোট্ট একটা বালিশ, নিচে শান-বাঁধানো পস্নাটফর্ম। বালিশ-বিছানার দুরবস্থার কথা নাই-বা বললাম। যে শয্যা তাকে এতটা বছর ধরে মাতৃস্নেহে আগলে রেখে নির্বিঘ্নে ঘুম পাড়িয়ে এসেছে তা যেমনই হোক, নিলামে চড়ালে নির্ঘাত অনেক নির্ঘুম নামজাদারা হুমড়ি খেয়ে পড়বে কেনার জন্য।

ওই গানডা ধর। রাতের ব্যালা আমাকেরে কাচারি ঘরোত ব্যোসা তুই গাত্তুলু আর আমি মন দিয়া শুনুত্তুনু।

একই ভাবে দৃষ্টি মেলে রাখে ছবুর।

তাকায়্যা আছু ক্যা? গানডা ধর। ধর...ধর।

তুই যদি আমার হইতিরে ও বন্ধু

আমি হইতাম তোর, কোলেতে বসাইয়া তোরে করিতাম আদর...

আকাশের গা বেয়ে শামুকের মতো ঠেলে উঠছে চাঁদ। চাঁদ আজ ঝরনা। অবিরাম জোছনা ঝরছে পৃথিবীর বুকে। বাতাস বইছে। যুবতী সারসের শাদা ধবধবে পালকের মতো মনোমুগ্ধকর এক বাতাস। ঢেউ উঠেছে গাছের ডালে ডালে, পাতায় পাতায়, ফসলের বুকে।

ছবুর আলীর সুর মর্ত্য ছুঁয়ে ধাবিত হচ্ছে স্বর্গের দিকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<77531 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1