মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিপস্নবী মুখ

আহম্মেদ পিন্টু
  ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

কবিরের মা'র যেখানে বিয়ে হয়েছিল সেখানে জন্ম হয়নি কবিরের, পরেরবার যেখানে বিয়ে হয়েছে সেখানেও নয়। তাহলে কোথায় জন্ম হয়েছিল কবিরের? কখন জন্ম হয়েছিল? এই মায়েরই সন্তান সে কি? তাহলে বাবা? সত্যিই সেই লোকটি বাবা? এমন সব নানান প্রশ্নে চারপাশ যখন ধোঁয়াশা ঘোলাটে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠলো, জনমনে বিভ্রান্তি জ্বলেপুড়ে এক সময় ক্লেশোক্তিতে পরিণত হয়ে ইটভাটার কালো ধোঁয়ার মতো চারদিকে গোটা এলাকা যখন দূষিত করে তুললো, ঠিক তখনই বোমাটা ফাটলো- আমিই কবিরের বাবা।

তিনি কোথা থেকে এলেন? তিনিই যে কবিরের বাবা তার প্রমাণ কী? তাহলে কবির চিনতে পারছে না কেন? নিশ্চয় লোকটার মাঝে কোনো ধান্দা আছে। কবিরের মা না বললে তো আর তাকে মানা যায় না! দুনিয়ার যে হালচাল তাতে কে কখন কোন মতলবে খাড়া হয় কে জানে! প্রশ্ন, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় চারপাশটা খইয়ের মতো ফুটতে লাগল।

তাহলে? কবির এখন আত্মহত্যা করবে? না-কি ওকে ছুড়ে ফেলা হবে ময়লার মতো? গ্রামের এক শিক্ষিত, স্বনামধন্য মুরব্বী ব্যক্তি প্রশ্নগুলো সবার মাঝে ছুড়ে দিলেন।

তাহলে আপনেই সমাধান দ্যান। যুবকদের মাঝ থেকে একজন বলল।

\হছেলেটি যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে সেটা ওকে করতে দাও।

না। যার জন্ম পরিচয় লিয়া সমস্যা আছে তার কোনো কতা শুনমু না আমরা। রাজনৈতিক দলের এক কর্মী উচ্চৈঃস্বরে তার অবস্থান পরিষ্কার করল। হুঁ....! হুঁ.....! এডাই কতা। সবাই সমস্বরে উচ্চ মাত্রায় সমর্থন জানাল।

তাহলে রাফেয়াকে ফিরিয়ে আনো তোমরা।

না। ওই কাফের মুরতাদ আর এই গাঁওত ঢুকপে না। গ্রামের মানুষদের পরলৌকিক মুক্তির পথ প্রদর্শনকারী মাদ্রাসা শিক্ষায় উচ্চস্তরে অধ্যয়নরত একমাত্র যুবক মৌলভী জলোচ্ছ্বাসের মতো ফুলেফেঁপে উঠলো। বাকিরা যোগ দিয়ে জলোচ্ছ্বাসের মোহড়া আকাশ-প্রান্তরে ছড়িয়ে দিগ্বিদিক আতঙ্কিত করে তুললো।

তাহলে তোমরা এখন কী করতে চাও?

আপনারা অনুমতি দিলে আমি কিছু বলতে চাই। কবিরের বাবা দাবিকারী লোকটি মিনতিযুক্ত কণ্ঠে দু'হাত এক করে ভক্তি ঝরাতে ঝরাতে বলল।

হঁ্যা, বলেন, বলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্র বলল। কেউ বাধা দেবে না।

আমি ওর বাবা। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা দয়া করে আর রাগান্বিত হবেন না। চল বাবা।

কিঞ্চিত হেসে কিছুটা বিরক্তির ক্লেশ ঝরিয়ে মাথাটা হালকা ঝাঁকিয়ে সে বলল, দেখুন, আমি আপনাকে চিনি না, জানি না, তা ছাড়া আপনি যে আমার পিতা তা কী করে বুঝব?

হঁ্যা বুঝবে। তোমাকে সব বলব, অথবা তুমি জেনে থাকতেও পার। আগে ওথ আর আনিকা ওথের কাছে চলো।

আমাকে চিনলেন কী করে?

এই যে তোমার ছবি। আমি তাদের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। ছবিটি তার সামনে ধরলেন। উপস্থিত জনতা দেখার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ দেখেও ফেলল। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।

ঠিক আছে। আপনার কথা যদি সত্যও ধরে নিই আমি, তাহলে আপনি হচ্ছেন আমার জন্মদাতা, পিতা নন। আপনি আসুন, পিস্নজ। দু'হাত এক করে বিদায় জানালো। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন লোকটি। মুহূর্তে জল গড়িয়ে কণ্ঠ আর বক্ষদেশ ভিজে একাকার হয়ে গেল। হাউমাউ করে উঠে কবিরের দু'হাত চেপে ধরলেন তিনি।

না বাবা, তোমাকে নিয়ে যাব আমি। কেউ নেই আমার এ পৃথিবীতে। তুমিই সব। চলো।

কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল সে লোকটিকে- তারপর হাত দুটি আস্তে করে ছাড়িয়ে নিল।

সূত্র ধরে যেমন গণিত চলে, বিজ্ঞান চলে, জীবনও চলে। জীবনের সূত্র ভালোবাসা। যে সূত্রে আমার জীবন গড়া তাতে আমি সিক্ত, আমি ডুবতে চাই না। আপনি দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। বটবৃক্ষের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলো লোকটি। চক্ষুযুগল বেয়ে জল ঝরছে শ্রাবণ-ধারায়। দৃষ্টির মাঝে নিঃসঙ্গ হরিণ শাবকের প্রতিচ্ছবি।

আমার কথা একটু দয়া করে শুনুন আপনারা। আমি এখানে আপনাদের মঙ্গলের জন্যই এসেছি। আমি তো আমার জন্ম পরিচয় নিয়ে কিছু বলতে চাইনি, বলবও না। আমার কাজটি শেষ হওয়া মাত্রই চলে যাব। অনুগ্রহ মিলবে- এ আশায় মন বেঁধে কবির যতটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ঠিক ততটাই ফ্যাকাশে হয়ে দীর্ঘকালব্যাপী রোগে শোকে ভোগা জন্ডিস রোগীর ন্যায় বিবর্ণ হয়ে উঠলো যখন জলোচ্ছ্বাসটি তাকে ছোবল মারলো- 'না, আপনে অ্যাকুনই চ্যোলা যান এটি থ্যাকা। আমাকেরে উপকার করা লাগবে না।' এবার নামি মুরব্বীজনও আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। ঠিক এরকমভাবেই একদিন এই মৌলভীর ফয়সালা মানুষজন মেনে নিয়ে রাফেয়া বেগমকে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছিল।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনাদের কথা সব ঠিক। তারপরও দ্যাখেন, আমাদের গ্রামে উনি এসেছেন, এভাবে উনাকে চলে যেতে বলাটা কেমন দেখায় বলুন! বরং আমার মনে হয়, আমরা একবার বসি, ব্যাপারটা একটু ঘেঁটে দেখা দরকার যদি কোনো কিছু করা যায়। মোটের ওপর সে তো মানুষ, না কি! কী বলেন, ময়েজ ভাই? ইউনিয়ন পর্যায়ের একজন রাজনৈতিক দলের নেতা বলল। ময়েজ কী যেন একটু ভেবে নিয়ে বলল, টগর আর আমার দল ভিন্ন হলেও এই ব্যাপারে আমি অর সঙ্গে আছি, সে কতাডা খারাপ কয়নি।

গ্রামের সব মানুষ মোটামুটি এই দুই দলে বিভক্ত। কাজেই দলের নেতারা যখন ঠিক তখন এরাও ঠিক। তাই হুজুর আপাতত বেঠিক হয়েই নিশ্চুপ রইলো।

\হযে যার মতো ফিরে গেল ঘরে। বাবা দাবি করা লোকটি ফিরে গেলেন। কবির সেই বাড়িতেই উঠলো যেখানে আছে অর্থাৎ ওই মুরব্বী আওলাদ খানের বাড়িতে।

গন্ডগোলের শুরু ওই নাম নিয়ে- কবির ওথ। লোকজন নিয়ে যখন সে কথা বলছিল তখন যেই না পরিচয় দিতে গিয়ে নামটা বলে ফেললো অমনি চতুর গোছের দুই একজন একের পর এক প্রশ্ন তুলে তার উদ্দেশে বারোটা বাজিয়ে আনলাকি থার্টিনে এনে তুললো।

কবিরের সঙ্গে ওথ ক্যান? এডা আবার ক্যামুন ধরনের নাম? প্রথম প্রশ্ন।

কবির নিশ্চুপ।

ওডাতো খিষ্টানের মতো লাগিচ্ছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন।

কবির নিশ্চুপ।

আপনে মুসলমান না খিষ্টান, কন তো আগে? তৃতীয় প্রশ্ন।

নিশ্চুপ দেখে আবারও প্রশ্ন- কতা কন না ক্যা?

এবার তার পক্ষে আর চুপচাপ থাকা সম্ভব হলো না। পরিস্থিতি ক্রমেই ঘুরপাক খেতে খেতে ঘূর্ণিঝড়ের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

\হদেখুন, এখানে আমি কে, কী করি, সেটাই দেখার বিষয়। আপনাদের নিয়ে আমি যে কাজ করব তার সঙ্গে আমার নামের বা ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, তাই আমার মনে হয়, এ বিষয় নিয়ে কথা বলে আমরা অযথাই সময় নষ্ট করব কেন।

না। ওডাই আসল বিষয়। জাত-ধর্ম ঠিক না থাকলে, তার সাতে কাম করা পাপ। আমরা যা কচ্ছি সেডার জবাব দ্যান, না হলে আমরা চ্যোলা যামু। সবার কথা ওই একই সুরেগাথা। কোনো উপায় না দেখে সে মুখ খুললো।

আমি যার গর্ভে জন্ম নিয়েছি তিনি আমার নাম রেখেছেন কবির, আর যারা আমাকে বড় করেছেন তারা এর সঙ্গে যোগ করেছেন ওথ। এই হলো কবির ওথ।

তালে আপনার আসল বাপ-মায়ের নাম কি? চতুর্থ প্রশ্ন।

মনির হোসেন, রাফেয়া বেগম।

রাফেয়ার নাম শুনে সবার কৌতূহল আকাশচুম্বী হয়ে উঠলো। এই গাঁয়ের রাফেয়া না কি? এ প্রশ্ন সবাইকে ব্যাকুল করে তুললো।

রাফেয়ার বাড়ি কি এই গ্রামেত না কি?

পঞ্চম প্রশ্ন।

হঁ্যা। এবার সবার মাঝে এক চরম বিস্ময় ঝড় তুললো। সবাই সবার দিকে চাইছে এক অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে। শুরু হলো ফিসফিসানি। চললোও কিছুক্ষণ। কবির নিস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ- তার পরিচয় খনন দেখে নয়, তাদের নৈতিকতা স্খলনে।

এবার আবারও প্রশ্ন-

ষষ্ঠ প্রশ্ন।

আমরা যেডা জানি সেডা হচ্ছে, রাফেয়ার বর্তমান স্বামী হিন্দু, আগেরডার নাম মনির হোসেন আছলো না, তালে এই মনির হোসেন কে? খুলা কন তো।

বিরক্ত হলেও কণ্ঠে শীতলতা এনে মৃদু সুরে বলল, দয়া করে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না। আপনাদের খেয়াল রাখতে হবে, আপনাদের জানার অধিকার কতটুকু।

আচ্ছা তালে এডা কন, আপনাক যারা মানুষ করিছে তারা খিষ্টান?

হঁ্যা।

তালে আপনে কুন ধর্ম পালন করেন?

তারা আমাকে কোনো ধর্মই পালন করতে শেখাননি।

নাউযুবিলস্নাহ্‌..........! নাউযুবিলস্নাহ্‌............! এরকুম মানুষের সাতে চলাফিরা করা পাপ, কঠিন গুনা! আমরা কেউ এটি থাকমু না, চলো সবাই।

সবাই উঠে পড়ল। কবিরের নিষ্পাপ অনুরোধ তাদের ক্ষান্ত করতে পারল না। একপর্যায়ে নেতা গোছের দুয়েকজনের হাত পর্যন্ত চেপে ধরলো, তবুও কাজ হলো না।

রাতের প্রথম প্রহরেই আজ উঠেছে চাঁদ। অষ্টাদশী ললনার মতো তার শরীরে জোয়ারের টান। দেখেই বুঝা যায়, মাঝরাতে হবে ভরা জোছনার খেলা। আকাশে কোথাও মেঘের দেখা পাওয়া ভারী দুষ্কর। সারা আকাশজুড়ে হাট বসেছে নক্ষত্র-তারার। নিচে দূরে দিগন্তের কোল ছুঁয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে অগণিত গাছের সারি, যেন সমান্তরাল পিচঢালা পথ ছুটে গেছে কোনো এক অজানা প্রান্তরে। খানবাড়ীর উঠোনের কিনার ঘেঁষে নেমে গেছে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। সহজ-সরল-হালকা তালে ফুরফুরে মেজাজে চষে বেড়াচ্ছে বাতাস। জোছনামাখা লকলকে শীষগুলো বাতাসের সঙ্গে খুনসুটিতে মত্ত। শিকারের খোঁজে নিশাচর পাখিগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে। তাদের ঘ্রাণ বুঝি সত্যিকারের সিদ্ধি হয়ে ঢুকে পড়েছে শিকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে- তাই তো তারা লুকাচ্ছে গর্তের ভেতরে, ক্ষেতের মাঝে। ওদিকে খানিক্ষণ বাদে বাদে হেঁকে উঠছে শেয়ালের দল। দূরে কোথাও কোনো বন থেকে ভেসে আসছে অজানা ভঙ্গিমায় ঈগলের ডাক। খুব মধুর, অতি মধুর এক প্রকৃতির নির্যাস ধুয়েমুছে একাকার করে চারপাশের সমস্ত প্রাণীকুলকে জানাচ্ছে সাদর সম্ভাষণ। এসো তুমি এসো আমার প্রাণের মাঝে, ব্যাকুল করে তোলো আমায় মিলনের কলতানে- এরকমই যেন আহ্বান।

উঠানের কিনারে বসেছে আওলাদ খান আর কবির।

আওলাদ সাহেব জানতে চান, কী ঘটে গেছে কবিরের অতীত জীবনে। কবিরকে বিষণ্ন মনে হচ্ছে না? কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে এমনও না। খুব স্বাভাবিক সতেজ ফুরফুরে দেখাচ্ছে।

কী করতে আসলাম এ গ্রামে আর কী হচ্ছে! জীবনটা কেমন জটিল!

জীবনে কণ্টক আছে বলেই তো তা জীবন বাবা। যে জীবনে জটিলতা নেই তা জীবন নয়, তা শরীর-মন-প্রাণের সমন্বয়ে একটা অবয়ব মাত্র। সত্যিকার অর্থে, এরকম জীবন কখনো হয় না। জীবন মানেই সমস্যা। তবে একেক জীবনে সমস্যার ধরন একেক রকম।

আমার জন্ম পরিচয় নিয়ে মানুষের মাঝে হয় তো কৌতূহল কিংবা কী বলব, মানে নিন্দা হাস্যরসের ব্যাপক জোয়ার বইছে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। জীবন তা হবে কেন? জন্ম পরিচয় তো প্রত্যেক জীবনেই আছে, আমারও আছে। আমার তো তবুও জন্মদাত্রী আছে, অনেকে আছে- যারা বাবা-মার নাম বলতে পারবে না, নাম কেন, কিছুই বলতে পারবে না। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? তারা কী করছে এটাই বড় কথা, মানে কর্মটা। তাদের জন্ম পরিচয় নিয়ে তাদের কষ্ট থাকতে পারে, তারা এটা নিয়ে কিছু করতে চাইলে করতে পারে, কিন্তু মানুষের ভাবনা আসে কোথা থেকে? তাদের মাথাব্যথা কেন? হঁ্যা, এভাবে কেউ যেন না জন্মায়, কেউ যেন এভাবে বেড়ে না উঠে- এটা আমিও চাই। এটা নিয়ে মানুষ ভাবতে পারে। কিছু করতে পারে। এতটুকুই তাদের অধিকার।

আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। এটাও চাই যে, তুমি কাজটা শেষ করে তারপর এ গ্রাম থেকে যাবে। আর এ জন্যই তোমার সম্পর্কে জানা প্রয়োজন, মানে তোমার অবস্থানের ব্যাপারে কিছু করা যায় কি না। এমনি তো আর থেকে লাভ নেই, যদি কাজ না করতে পার, নাকি?

আপনি জানতে না চাইলেও আমি আপনাকে বলতাম যেহেতু ঘটনাটি ধরা পড়েছে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একদিন বাবা-মা ডেকে কাছে বসালেন। কবির আজ তোমাকে আমরা একটা ঘটনা বলব। সত্য ঘটনা। তোমার জীবনের। আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে, শোনার পর তুমি কী সিদ্ধান্ত নেবে, মানে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে কি না। বলার আগেই কষ্টে আমাদের বুকটা ভারী হয়ে আসছে। তবুও তোমাকে বলতে হবে। নইলে আমরা অপরাধী হয়ে থাকব। তুমি আমাদের সন্তান নও। তোমাকে শুধু বড় করেছি আমরা। তোমার জন্মদাত্রী ভিন্ন মানুষ। তুমি জন্ম নিয়েছিলে রাফেয়া বেগম নামে এ নারীর গর্ভে। তোমার বাবার নাম মনির হোসেন। তারা বিয়ে করেছিল না। তাদের মাঝে প্রেম ছিল। তোমার বাবা বিয়ে করার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিল তোমার মাকে। তুমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তারা বিয়ে করার কথা ছিল। তারপর তোমার জন্মের পর তোমার মা যখন বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করল, একদিন সে উধাও হয়ে গেল। তারা আমাদের বাসাতেই ভাড়া থাকত। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে তারা ভাড়া নিয়েছিল, তুমি গর্ভে আসার পরে। তোমার বাবার বাড়ি কুমিলস্না। বিয়ের প্রমাণ না থাকায় তোমার মা তার বাড়িতে যাওয়ার সাহস করেনি। আবার বাবার বাড়িও যেতে পারেনি। তারা কখনোই মেনে নেবেন না, এ ধারণা তার মাঝে বদ্ধমূল ছিল। খুব অসহায় হয়ে পড়ল। আমাদের কাছে ঘটনাটি খুলে বলার পর আমরা আইনের আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দিলাম। কিন্তু সে সাহস পায়নি। তোমার বাবার বাড়ি পর্যন্ত আমরা লোক পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তখন সে নিরুদ্দেশ। আবার তোমার মা'র পক্ষে একা থাকাও সম্ভবপর ছিল না। ছাত্রী মানুষ। নিজে চলাই মুশকিল, তার ওপর তুমি! সবকিছু মিলিয়ে কেলেঙ্কারি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে দু-দুবার। আমরা ফিরাতে সমর্থ হয়েছি। ঠিক সেই সময় আমরা তাকে বললাম, আমরা তোমাকে নিতে চাই, যদি আপত্তি না থাকে। আমরা তো নিঃসন্তান। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। এর বিনিময়ে তুমি কী চাও বলো? সে খুব কাঁদছিল তখন। আমি কিছুই চাই না। শুধু একটা বিষয়ে অনুরোধ করব। ওর নাম আপনারা রাখেন, যা মন চায়। কবির নামটাও সঙ্গে রাখবেন, নামটা খুব পছন্দের আমার। আমরা মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিলাম। পরে তারা কবিরের সঙ্গে ওথ জুড়ে দিয়ে আমার নাম রেখেছেন কবির ওথ। জন্মদাত্রী সেই যে গেল, আর কখনো আসেনি। এখন এই লোকটি আমার জন্মদাতা কি না জানি না। বাবা-মার সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারব। এই আমার অতীত।

এখন তুমি কি ওথদের সঙ্গেই থাকতে চাইছো?

অবশ্যই। যেদিন তারা আমার অসল পরিচয় জানালেন, আমি এতটুকুও বিস্মিত হইনি, সামান্যতমও হতাশ কিংবা খারাপ লাগেনি। আমার কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না। কিন্তু আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল যখন বাবা-মা বললেন, তুমি এখন কী করবে ভেবে দ্যাখো। তুমি চাইলে তোমার বাবা-মার কাছে চলে যেতে পার। আমি লক্ষ্য করলাম, তাদের দুচোখ লাল হয়ে উঠেছে, ভেতরটা জলকণায় ভর্তি। আমি তাদের জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, আমাকে তাড়িয়ে দিও না। তোমরাই আমার বাবা-মা। তোমাদের ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। তারা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, তোকে আমরা তাড়িয়ে দিতে পারিরে পাগল! তুই থাকতে চাইলে পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই তোকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে। তুই আমাদের শুধু সন্তান না, আমাদের প্রাণ। তোকে ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না। চোখের দুই কোণ আঙুল দিয়ে মুছলো কবির। কবির খেয়াল করেনি, আওলাদ সাহেবের চোখ অনেক আগেই ভিজে উঠেছে। তিনিও চোখ মুছলেন।

জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক সফল- এ নীতি বোধ আমাদের মাঝে নেই বলেই আমাদের জীবনে এত দুর্ভোগ। মানুষ কর্মের মাঝেই বেঁচে থাকে- এ এক বিরাট সত্য। কর্ম যেখানে অনুজ্জ্বল, পরিচয় সেখানে আত্মঘাতী।

বাবা-মা যেদিন আমার পরিচয় তুলে ধরলেন সেদিন তারা এই কথাগুলোই আমাকে বলেছিলেন। ও হঁ্যা, আরেকটা বিষয়, এ গ্রামে আমি বেছে বেছে কেন আসলাম, এ প্রশ্ন আপনার মনে আসতে পারে। এটাও পরিষ্কার করা উচিত। আমি ইচ্ছে করেই এখানে এসেছি। বাবা-মার কাছ থেকে ঠিকানা জেনেছি। কেন জানেন, শুধু রাফেয়া বেগম নামের মানুষটাকে আড়াল থেকে এক নজর দেখবো বলে। আচ্ছা উনাকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়েছে কেন?

\হসে হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করেছিল, এটা ছিল তার অপরাধ। এর একটা সুরাহা হতো, কিন্তু তারা কেউই যখন ধর্মের ধার ধারলো না, তখন মুসলমান-হিন্দু উভয়েই এক জোট হয়ে তাদের বের করে দিল। নেতৃত্ব দিয়েছিল, ওই যে দেখলে, ওই যুবক মৌলভী। আমি চেষ্টা করেছি, শেষ পর্যন্ত ঠেকাতে পারিনি। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি। কেঁদেওছি, নিভৃতে। আপন জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাওয়া চিরতরে, এ যাতনা কতো বড়ো তা আমি বুঝি। মুক্তিযুদ্ধে যখন গেলাম, তখন সেই যাওয়াটা ছিল চিরতরে, কেননা, ধরেই নিয়েছিলাম আর ফিরব না। তখন এ গ্রামের দিকে বারবার ফিরে চাইছিলাম। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল কষ্টের দাপটে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল বৃষ্টি ঝরার মতো। সহযোদ্ধাদের অনেকেই মারা গেল। আমি বেঁচে গেলাম। গ্রামে যখন ফিরলাম, ওই একইভাবে, আনন্দের জোয়ারে দু'চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল বৃষ্টি ধারার মতো। যে দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন সেই দেশ এখনো পেলাম না। বলতে পারো, কবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে?

সেই দেশ হবে, অবশ্যই হবে- একটা নৈতিক, মানবিক, যৌক্তিক, অসাম্প্রদায়িক দেশ অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হবে। সব দুর্নীতির নিপাত হবে, সবার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। আমি স্বপ্ন দেখি। আমার বুকে আশার কোনো ঘাটতি নেই। যে জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে পারে, যে জাতি স্বাধীনতার জন্য নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ-হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে পারে সেই জাতি হেরে যেতে পারে না। আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি সেই ঠিকানায়। একটা ব্যাপার দেখে আমি খুবই আনন্দিত, গর্বিত। আমাদের যে মূল শক্তি অর্থাৎ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভাষা ও সংস্কৃতি- এই চারটিতে তরুণরা জেগে উঠছে। তারা ধারণ, লালন করতে শুরু করেছে। এরাই গড়ে তুলবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ।

তাই যেন হয় বাবা, তাই যেন হয়।

কথায় কথায় রাত ভারী হয়ে এলো। মাঝ পথ থেকে রাত কিছুটা দূরে। আওলাদ সাহেব বয়সী মানুষ। দীর্ঘ এই রাতের ক্লান্তিতে তিনি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে গেছেন ঘুমাতে। কবিরের দৃষ্টি এখন দিগন্তপ্রসারী। উপরে ঝলমলে চাঁদ, সুদৃশ্য আকাশ, নিচে বিস্তৃত মনোরম জমিন। এমন একটি দৃশ্যপটের মাঝে নিজেকে আটকে রাখা তার দীর্ঘদিনের কল্পনা। কল্পনা বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ায়- এ বিশ্বাস ছিল এতদিন পুঁথিগত বিদ্যার মাঝে, আজ তা বাস্তবতার চরম রূপ নিয়ে ধরা দিল। সে এখন উৎফুলস্ন, নন্দিত। সব ক্লান্তি, সব ক্লেশ, সব যাতনা এখন তার মনের অতলে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে প্রকৃতির এই মধুরতার সঙ্গে পালস্না দিয়ে টিকতে না পেরে। সে সিগারেট ধরিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে টানছে আর প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ শোষণ করে নিচ্ছে মনের দুয়ার খুলে।

এমন একটি নিরঙ্কুশ চিত্তবিনোদনের চরম মূহূর্তে এসে উপস্থিত হলো ময়েজ আর টগর। উভয়েই লম্বা একটা সালাম দিয়ে বসে পড়ল। কবিরও হাসিমুখে তাদের গ্রহণ করল। অ্যাকা অ্যাকা কী করিচ্ছেন ভাই? ময়েজের জিজ্ঞাসা।

এই বসে বসে সৌন্দর্য উপভোগ করছি।

ভালো ভালো, বেশ ভালো। আপনে সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকেন, আমরা আর আপনাক বিরক্ত না করি। কথাটা বলেই ফেলি, কী বলেন ময়েজ ভাই?

হুঁ....হুঁ....।

শোনেন ভাইজান, আমরা দুইজন এই গ্রামের নেতা, রাজনৈতিক দলের নেতা। আমাদের ওপর কথা বলার কেউ নেই। তাই বলি কী, আপনে যে কাজ করতে আসছেন সেটা করেন, কেউ বিরক্ত করবে না। সহযোগিতা লাগলে সবাই করবে। আপনে খালি আমাদের দুইজনকে কিছু টাকা দ্যান। এই ধরেন, হাজার বিশেক। সব ব্যবস্থা আমরা করে দেব।

কবির হেসে উঠলো। কিছুটা শব্দ করেই হাসলো।

হাসিচ্ছেন ক্যান? ময়েজ জানতে চাইলো।

বিশ হাজার টাকা বড় কথা নয়। আপনারা আমাকে ভুল বুঝেছেন- তাই হাসছি। আমি ওই মানুষ নই। কোনো অনৈতিক কাজে আমি টাকা দেই না। আপনাদের প্রয়োজন হলে টাকা নিয়ে যান, পরে কোনোদিন শোধ করে দেবেন। আর যদি না পারেন, দেবেন না। এখানেও শর্ত আছে, টাকা ধার নেবেন বলে আমার কাজে সহযোগিতা করবেন, লোকজনদের চাপ দিয়ে নিয়ে আসবেন, তা হবে না।

তালে আপনে ট্যাকা দেবেন না? ময়েজের কণ্ঠে কিছুটা ক্ষিপ্রতা।

আমি তো না বলিনি।

দ্যাখেন, আপনার ভালো হবে। হিসাব করে দ্যাখেন। টগর বলল।

যতক্ষণ পর্যন্ত আমি নিজের ভালোটা বুঝতে পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি নিজের সিদ্ধান্তেই অটল থাকি।

ঠিক আছে। কাজ করা হোবে না আপনার। না ক্যোরাই চ্যোলা যাওয়া ল্যাগবে। ময়েজের কণ্ঠ জুড়ে হুমকি।

আপনার ভালোটা আপনে বুঝলেন না। যাই, কী আর করার! মিট মিট করে হাসতে হাসতে টগর বলুল।

ওরা চলে গেল। কবির মৃদু হেসে আবারও ডুব দিল প্রকৃতির লীলার্ঘ সরোবরে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়া কবির ওথ তার পছন্দের পেশা সাংবাদিকতায় নিয়োজিত। তার স্বপ্ন ছিল সাংবাদিকতা করা, করছে। সাধারণ মানুষরা কতটুকু সচেতন তাদের অধিকারের ব্যাপারে অর্থাৎ তাদের কী কী অধিকার আছে, কতটা আছে- এ বিষয়গুলো সম্পর্কে তারা কতটা সচেতন, তার ওপর একটা সমীক্ষা চালাতে চায় সে। বিশেষ করে গ্রামের সাধারণ মানুষের নিয়ে সে করবে কাজটি। তারপর সেটি তুলে ধরবে পত্রিকায়।

তার সমীক্ষাযোগ্য বিষয়টির শিরোনাম- অধিকার ও সচেতনতা।

ময়েজ, টগর আর মৌলভী মিলে গোটা গ্রামের লোকজনদের সাবধান করে দিল, কেউ যেন কবিরের প্রশ্নে মুখ না খুলে। কবির কয়েকদিন ধরে বিষয়টি সবাইকে বুঝিয়ে বলল কিন্তু কোনো ফল এলো না। আওলাদ সাহেবও চেষ্টা করলেন, না, কাজ হলো না। শেষমেশ আর কী করার। চলে যেতে হবে তাকে। যা ভাবা তাই। কবির ব্যাগপত্র গুছিয়ে ঢাকার পথ ধরলো। গ্রাম পার হয়ে নৌকায় উঠার উদ্দেশ্যে যখন সে নদীর পাড়ে এসে পৌঁছল, তখন একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে। বিকেল ফুরাতে আর অল্প কিছুক্ষণ বাকি। যৌবন হারিয়ে সূর্য নেমে এসেছে বার্ধক্যে। তার লাল আবেশ রাঙানো চারপাশটা যেন লিওনার্দোর মোনালিসার দুঠোঁট। সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ যেমন কুঁড়ি থেকে বের হয়ে মুখখানি তুলে ধরে ভ্রমরের দিকে, তেমনি উচ্ছল যৌবনের খোলস থেকে বের হয়ে মেয়েটি তার প্রজ্বলিত মুখখানি তুলে ধরলো কবিরের মুখের দিকে।

আপনি!

আপনাকে আমি একটা গল্প শোনাতে চাই। জন্ম-পরিচয়হীন এক ছেলেকে একটা মেয়ে ভালোবাসে। সে তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু মেয়েটির পরিবার কখনই তা মেনে নেবে না। এমনকি সমাজের কেউই নয়। ছেলেটি হাত বাড়ালে মেয়েটি সেই হাত ধরে চলে যাবে, কিন্তু সে পালিয়ে যেতে চায় না। ছেলেটি কি পারবে গ্রামের সবার সামনে থেকে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে? ইতোমধ্যেই মেয়েটি সব বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করার প্রতিজ্ঞা করেছে।

গল্পটি শেষ করেই মেয়েটি পা বাড়ালো। ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে গ্রামের দিকে।

কবির বেশ খানিকক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে স্মিত হেসে ঘুরে পা চালাতে লাগলো গ্রামের দিকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84623 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1