শামসুর রাহমান ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের অভু্যত্থান, স্বাধীনতা বা সমসাময়িক বিভিন্ন অনিয়ম, অনাচার বা অপ্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ছড়া-কবিতায় তুলে ধরেছেন। কোথাও কোথাও প্রতিবাদও করেছেন। তিনি প্রথম জীবনে সাংবাদিক ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ আর চেতনায় প্রবাহিত ছিলেন শামসুর রাহমান। তিনি সময় ও কালকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগের প্রতি বাঁক বদলে তিনি কবিতা লিখেছেন, কিছু ছড়াও লিখেছেন সমাজের কিছু অসংগতি তুলে ধরে। এ কারণেই তিনি পাঠকসমাজে চিরস্থায়ী আসন গড়েছেন। অনেকে প্রবল প্রতিভা নিয়ে কবিতা লিখেও সময় ও কালকে এড়িয়ে যেতে চাওয়ায় হারিয়ে গেছেন, প্রস্ফুটিত হয়েছেন প্রথমদিকে, তবে টিকে থাকতে পারেননি। এমনকি তিরিশের পঞ্চপান্ডব (জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী) পরাধীন দেশে বাস করেও তেমন কিছু লেখেননি। অনেক ক্ষেত্রে তারা সময়কে এড়িয়ে গেছেন।
কবি শামসুর রাহমানের আধুনিক কবিতার সঙ্গে পরিচয় ও আন্তর্জাতিক-আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে মূলত ১৯৪৯ সালে। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ১৯৪৯ মুদ্রিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। শামসুর রাহমান বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছদ্যনাম নিয়েছেন তিনি যেগুলো হচ্ছে: সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক। পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় (দেশ) মজলুম আদিব (যার অর্থ নির্যাতিত কবি) নামে কবিতা ছাপা হয়। তিনি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রূপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন 'হাতির শুঁড়' নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা 'টেলেমেকাস' (১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে)। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসংগীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে আরো স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন।
বাংলা ভাষার ওপর বারবার হামলা করেছ বিদেশি শত্রম্নরা। বাংলা ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছে সময়ে সময়ে। পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান যার প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালের আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন- যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমানও। কবি ক্ষুব্ধ হয়ে লেখেন-
'নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছ আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্রতি প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলিশৈশবে 'পাখী সব করে রব' ব'লে মদনমোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,
অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তা নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে।
আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ'ড়ে পলে পলে,
তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে
আমারই বন্দরে'- (বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা/সংক্ষেপিত)
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহিদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন 'আসাদের শার্ট' কবিতাটি।
'গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
বোন তার ভাইয়ের অম্স্নান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূক্ষ্নতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।
ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেনু্যর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা'।
চারিদিকে লাশ, রক্ত। তার 'বারবার ফিরে আসে' কবিতায় দৃপ্ত উচ্চারণ-
'বারবার ফিরে আসে রক্তাপস্নুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকান্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপস্নুত শার্ট।
বিষম দামাল দিনগুলো ফিরে আসে বারবার,
বারবার কলেস্নালিত আমাদের শহর ও গ্রাম।
'আবার আসবো ফিরে' ব'লে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রম্নত গোটাতে গোটাতে
স্স্নোগানের নিভাঁজ উলস্নাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ পস্নাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হ'য়ে যায়।
একটি বধূর
সংসার উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্তান হ'য়ে যায়,
একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝ'রে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে।'
১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃতু্যতে কাতর কবি লেখেন 'আসুন আমরা আজ ও একজন জেলে' নামক কবিতা। শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে 'শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা', দ্বিতীয় বছরে 'স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা', তৃতীয় বছরে 'সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা' এবং চতুর্থ বছরে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা' লেখেন। ১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন 'গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা'।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শামসুর রাহমান সপরিবারে তাদের পৈতৃক বাড়ি নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে চলে যান। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বেদনামথিত হয়ে লেখেন 'স্বাধীনতা তুমি' ও 'তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা'সহ বেশকিছু কবিতা। তার 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতাটি অমর হয়ে আছে।
'স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহু গ্রন্থিল পেশি।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ-খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।'
(স্বাধীনতা তুমি, সংক্ষেপিত)
ছড়ায় শামসুর রাহমান রাজনীতি, অর্থনীতি এবং দেশের সামাজিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। ছড়াতেও সময় বা কালকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ছড়া 'ফাও' এ বিষয় তুলে ধরেছেন পানির অব্যবস্থাপনা নিয়ে-
'ফাও পেতে চাও ফাও?
ওয়াসার কাছে চাও।
পানির সঙ্গে পাবে
গুবরে পোকার ছা-ও'
সমাজের না খেয়ে থাকা মানুষকে নিয়েও লিখেছেন। সাধারণ ও গরীব শ্রেণি-পেশার দুর্ভোগের কথা লিখেছেন ছড়া- কবিতায়। এরকমই এক ছড়া-
'সবাই করে আহা উহু,
কার কাহিনি কে শোনে?
চায়ের চিনি উধাও হলো,
চাল মেলে না রেশনে।
সর্ষে তেলের ঘ্রাণ পাওয়া ভার,
নেইকো ঘরে জ্বালানি।
পণ্যগুলো হচ্ছে লোপাট,
ধন্য চোরাচালানি।'
'সম্পর্ক' ছড়ায়। সমাজের অন্ধকার জগতে থাকা ও সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধ লিখলেন-
'রাতারাতি লাল হয়ে যায়
কালোবাজারি
গুনলে পরে হবে ওরা
কয়েক হাজারই।
আইন বলে, হঁ্যা গো, কাজটা
ওদের সাজারই।
কিন্তু ওদের সাজা দিলে
রুই কাতলা সবাই মিলে
রেগেমেগে করবে মিটিং
করবে মুখ ব্যাজার-ই।'