শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রমা চৌধুরী একজনই হয়

বছর পঁাচ আগেও বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনতার মাঝে কতজন চিনতেন ‘সংগ্রামী-মাতা’ রমা চৌধুরীকে। তিনি আলোচনায় আসেন ২৭ জুলাই ২০১৩ সালে। চট্টগ্রামের পথে পথে খালি পায়ে বই ফেরি করে বিক্রি করেন এক মুক্তিযোদ্ধা, শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নন, স্বাধীনতাযুদ্ধে যিনি হারিয়েছে স্বজন আর নিজের জীবনের মূল্যবান অনেক কিছু...
রহিমা আক্তার মৌ
  ২২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা-ভাতাসহ নানা সুবিধা রয়েছে, সুবিধা গ্রহণের জন্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে; সেখানে সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ হয়েও মুক্তিযোদ্ধার সম্মানটুকুর বাইরে বাড়তি কোনো সুবিধা নেননি। চাননি সন্তানদের জন্যে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় কিছু হোক। চাননি প্রধানমন্ত্রী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিক, কেউ তাকে দয়া দেখাক তাও চাননি। লোভ-লালসা দখলবাজের বতর্মান সমাজের চোখে এক নজিরবিহীন উদাহরণ

‘একাত্তরের জননী’ রমা চৌধুরী। বাংলার বুকে রমা চৌধুরী একজনই হয়।

বছর পঁাচ আগেও বাংলাদেশের ১৬ কোটির জনতার মাঝে কতজন চিনতেন ‘সংগ্রামী-মাতা’ রমা চৌধুরীকে। তিনি আলোচনায় আসেন ২৭ জুলাই ২০১৩ সালে। চট্টগ্রামের পথে পথে খালি পায়ে বই ফেরি করে বিক্রি করেন এক মুক্তিযোদ্ধা, শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নন, স্বাধীনতাযুদ্ধে যিনি হারিয়েছে স্বজন আর নিজের জীবনের মূল্যবান অনেক কিছু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান গণভবনে। ৪০ মিনিটের সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী তাকে মুক্তিযুদ্ধে শহিদমাতা হিসেবে অনন্য অবদান রাখায় আথির্ক সহযোগিতার প্রস্তাব দিলে তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। জীবনে তিনি কখনো মানুষের দয়া সহানুভ‚তির জন্য কাতর হননি। এটা হয়তো রমা চৌধুরীকে দিয়েই সম্ভব।

১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার/থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রমা চৌধুরী। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ) ডিগ্রিধারী তিনি। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অজর্ন করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক উত্তালক্ষণে তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব অগণতি মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন তাদের একজন চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাসাহিত্যে মাস্টাসর্ করে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন এই নারী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনটাকে ওলটপালট করে দেয়। ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে পূণার্ঙ্গ কমর্জীবন শুরু করেন রমা চৌধুরী। পরে দীঘর্ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তিজীবনে চার ছেলের জননী তিনি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী। থাকতেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। স্বামী তখন ছিলেন ভারতে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামে শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত ছিলেন রমা চৌধুরী। একে তো শিক্ষিত, সচেতন মানুষ, তার ওপর নারী, সাথে যুক্ত হয়েছে তার হিন্দু-পরিচয়। সবমিলিয়ে পাকিস্তানি ববর্র আমিের্দর প্রধান টাগেের্ট পরিণত হন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৩ মে তিন শিশুসন্তান নিয়ে চট্টগ্রামের পোপাদিয়ায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। সেইদিন এলাকার পাকিস্তানি দালালদের সহযোগিতায় পাকসেনারা রমা চৌধুরীদের বাড়িতে হানা দেয়। নিজের মা এবং দুই শিশুসন্তানের সামনে তাকে নিমর্মভাবে নিযার্তন করা হয়। পাকসেনারা রমা চৌধুরীকে শুধু নিযার্তন করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের বাড়িও পুড়িয়ে দেয়। হানাদারদের হাত থেকে কোনোমতে মুক্ত হয়ে রমা চৌধুরী পুকুরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন পুনরায় নিযার্তনের ভয়ে। চোখের সামনে গান পাউডার দিয়ে তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকসেনারা। ঘরের মূল্যবান মালামাল, নিজের লেখা সাহিত্যকমর্ চোখের পলকেই পুড়ে যেতে থাকল। কিন্তু হানাদারের ভয়ে কেউ আগুন নেভাতে সেদিন এগিয়ে যায়নি। একপযাের্য় রমা চৌধুরী নিজেই ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেন ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ছিঁটেফোটা কিছু রক্ষা করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যথর্ হন।

ঘরবাড়িহীন বাকি আটটি মাস তাকে তিনটি শিশুসন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাতের বেলায় পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে পলিথিন বা খড়কুটো নিয়ে মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে কাটিয়েছেন। অনাহারে আর অধার্হারে শীতে দুসন্তান সাগর আর টগরের অসুখ বেঁধে যায়। বড় ছেলে সাগর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। ১৫ ডিসেম্বর থেকে খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয় সাগরের। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়, ২০ ডিসেম্বর রাতে মৃত্যুবরণ করে সাগর। একই অসুখে আক্রান্ত দ্বিতীয় সন্তান টগর। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি অধর্উন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার অনেক শ্বাসরোধ হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি মারা যায় টগর। দুই সন্তান হারিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পরেননি রমা চৌধুরী। নিকটজনের পীড়াপীড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পরা শুরু করেন। রমা চৌধুরী স্বাধীনতার পর প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তি হলে দ্বিতীয়?বার বিয়ে করেন। কিন্তু সংসার বঁাধতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন, সংসার ভাঙল। দ্বিতীয় সংসারে জন্ম নেয় ছেলে টুনু। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুঘর্টনায় মারা যায় টুনুও। হিন্দু ধমীর্য় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করেননি রমা চৌধুরী। তাই তিন সন্তানকেই দেয়া হয়েছে মাটিচাপা। এরপর গত ১৫ বছর ধরে জুতো ছাড়াই পথ চলছেন রমা চৌধুরী

তার লেখা ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থের ২১১ পৃষ্ঠায় রমা চৌধুরী লিখেছেন, ‘ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তার নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়চড়া নেই। মা ছটফট করে উঠে বিলাপ ধরে কঁাদতে থাকেন, তার ভাই নাই, তার ভাই গেইয়্যে গোই (আমার ভাই নেই, আমার ভাই চলে গেছে)।’

রমা চৌধুরীর মোট প্রকাশিত বই ২০টি। লিখেছেন সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়- সমালোচনা সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্মৃতিকথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন ইতিহাস গ্রন্থ, গল্প, উপন্যাস, লোক-সংস্কৃতিবিষয়ক গ্রন্থ, প্রবন্ধ এবং ছড়া। সাহিত্যবিশ্বে এক অনন্য নজির রচনা করেছেন রমা চৌধুরী। তিনি এমনই বেড়ালপ্রেমী ছিলেন যে, নিজের ৮টি বই উৎসগর্ করেছেন তার পালিত ৮টি বেড়ালকে। কিন্তু একাত্তরে সব হারানো এই নারী যেন পথকেই তার ঠিকানা করে নিয়েছেন। চট্টগ্রামের রাস্তায় বই ফেরি করে তার জীবন চলে, মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘একাত্তরের জননী’

রমা চৌধুরীর বইসমূহÑ প্রবন্ধ সংকলন : রবীন্দ্র সাহিত্য ভৃত্য, নজরুল প্রতিভার সন্ধানে, সপ্তরশ্মি, চট্টগ্রামের লোক সাহিত্যের জীবন দশর্ন, অপ্রিয় বচন, যে ছিল মাটির কাছাকাছি, ভাব বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ, নিবাির্চত প্রবন্ধ। স্মৃতিকথা : সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, স্মৃতির বেদন অশ্রæ ঝরায়। কাব্যগ্রন্থ Ñ

স্বগের্ আমি যাব না, শহীদের জিজ্ঞাসা, ১০০১ দিন যাপনের পদ্য। পত্র সংকলনÑ নীল বেদনার খাম। উপন্যাসÑ একাত্তরের জননী, লাখ টাকা, হীরকাদুরীয়।

গল্প সংকলনÑ আগুন রাঙ্গা আগুন ঝরা, অশ্রæভেজা একটি দিন।

কোমরে পাওয়া আঘাত, গলবøাডারে পাথর, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্টসহ বেশ কিছু শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বাসায় পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভতির্ হওয়ার আগ পযর্ন্ত রমা চৌধুরী নিজের লেখা বই ফেরি করে বিক্রি করতেন। ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ রমা চৌধুরীকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভতির্ করা হয়। সেখানেই তিনি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা রমা চৌধুরীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখ সন্ধ্যার পর তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। রাতে রমা চৌধুরীকে লাইফ সাপোটর্ দেয়া হলে তার শুভানুধ্যায়ী মহলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার ভোর ৪টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রমা চৌধুরী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। সোমবার সকাল ১০টার পর রমা চৌধুরীর মরদেহ নগরীর সবর্স্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। অপরাহ্নে মরদেহ গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালীর পোপাদিয়ায় নেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় মযার্দায় তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান হয়।

২০ বছর ধরে লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন রমা চৌধুরী। যদিও তার লেখ্যবৃত্তির পেশা একেবারেই স্বনিবাির্চত ও স্বতন্ত্র। তিনি প্রথমে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তার জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। এ ছাড়া তার স্মৃতিতে একাত্তর নিয়ে অগ্রন্থিত কিছু গদ্য আছে। ২০১৫ সালের ‘অনন্যা’ ঈদসংখ্যায় নিজের জীবনে বেড়ালের ভ‚মিকা নিয়ে অসাধারণ এক গদ্য লেখেন। ২০১৪ সালে তিনি অনন্য শীষর্দশ সম্মাননা পান।

রমা চৌধুরীর দুই সন্তান মুক্তিযুদ্ধের চরম অসময়ের বলি। রমা চৌধুরীর মতো অসংখ্য মায়েদের মহান আত্মত্যাগেই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের মহান স্বাধীনতা এসেছিল। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও রমা চৌধুরীকে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হয়। বই ফেরি করে জীবন-জীবিকা নিবার্হ করতে হয়, এটা স্বাধীনতা দেশের নাগরিক হিসেবে ভাবতেই লজ্জা লাগে। অন্যদিকে অহংকার বোধ হয় এই ভেবেই, রমা চৌধুরীরা নিজের প্রিয়জন হারিয়ে জীবনের মূল্যবান সব হারিয়ে আমাদের জন্যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। কিন্তু ৪৭ বছরেও রমা চৌধুরীকে জীবনের টানাপড়েন থেকে আমরা মুক্তি দিতে পারিনি, বরং তিনিই না ফেরার দেশে চলে গিয়ে আমাদের দায়িত্ব-কতর্ব্য থেকে মুক্তি দিয়ে গেছেন।

লেখক : সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<18725 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1