বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আমি সাহসিকা আমি স্বাধীনতা

তাসনিম মুনতাহা
  ১০ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

যখন আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাজ করেছিলাম তখন ছিলাম তারুণ্যে ভরপুর। অদম্য সাহস নিয়ে দেশের জন্য কাজ করেছি। আমি মুক্তিবাহিনীদের রান্না করে খাওয়াতাম এবং বিভিন্ন অপারেশনের খবর এনে দিতাম। আমার কারণেই মুক্তিবাহিনীরা সতকর্তার সহিত বিভিন্ন অপারেশন সাকসেসফুল করেছে। পাক-হানাদার বাহিনীদের শেষ করেছে। অনেক ঝুঁকিপূণর্ কাজে আমি সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করেছিলাম। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি আমার। ১৯৭১ সালের কোনো এক দুযোর্গময় দিনে আমি পাকিস্তানি আমিের্দর গাড়ির সামনে পড়ে যাই। সেইদিন থেকে শুরু আমার জীবনের অন্য কাহিনী। আমার ওপর চালানো হলো অমানুষিক নিযার্তন। আমি আত্মাহুতি দিয়েছি এই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। হাসিমুখে সব নিযার্তন বরণ করে নিয়েছিলাম শুধু বাংলাদেশ নামক মানচিত্রে ফুল ফোটাবো বলে। বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। যুদ্ধশেষে যখন ফিরে এলাম তখন সবাই আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। স্বামী ত্যাগ করল আমাকে। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হলাম। বাবার বাড়িতেও ঠঁাই হলো না আমার। সবাই আমাকে একঘরে করে রাখল। কেউ আমার দিকে ফিরে তাকাল না। কারও বিন্দুমাত্র সহযোগিতা, সহমমির্তা আমার কপালে জোটেনি। শুধু পেয়েছি লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর অবহেলা। কেউ আমাকে একটা কাজ পযর্ন্ত দিত না। খেয়ে না খেয়ে গ্রাম ছেড়ে বহুদূরে এসে একাকী আমি সংগ্রাম করেছি বেঁচে থাকার তাগিদে। যে যুদ্ধের জন্য আমার এত আত্মত্যাগ, আত্মাহুতি সেই ত্যাগের বিনিময়ে আমি হয়েছি প্রতারিত। হয়েছি লাঞ্ছিত আর অবহেলিত। কেন এমন হলো? এ জন্যই কি আমি স্বদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম? কি আমার অপরাধ? আমি বীরাঙ্গনা বলে সবাই আমাকে হেয় করে দেখে। এই সমাজের মানুষের চোখে আমি খুবই খারাপ একজন মানুষ। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হয় বড় বড় সম্মান। আমি কি মুক্তিযোদ্ধা নই? আমি কি দেশের জন্য কিছুই করিনি। মুক্তিযোদ্ধারা যদি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, অসুস্থ ভাতা, বয়স্ক ভাতা পেতে পারে তাহলে আমি কেন পাব না?

আমি এখন ষাটোধ্বর্ বয়োবৃদ্ধ একজন। আমার কোনো সন্তান নেই, আত্মীয়-স্বজন থেকেও নেই। সবাই আমাকে বিতাড়িত করেছে। বীরাঙ্গনা বলে কেউ আমার পরিচয় পযর্ন্ত দেয় না। আমি পড়ে আছি এক অজপাড়াগঁায়ে। আমার খবর কেউ রাখে না। শুনেছি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হচ্ছে। আমার নাম কি উঠবে এই তালিকায়? কে দেবে আমার নাম? আমি কি সারাজীবন এই অসম্মানের বোঝা বয়ে বেড়াব? এখন তো খুব দুঃখ হয় কেন আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম? যুদ্ধে না গেলে আজ আমার একটি সুন্দর পরিবার থাকত, ছেলেমেয়ে থাকত, স্বামীর সাহচযর্ থাকত। এখন আমি বয়োবৃদ্ধ আর অসুস্থ মানুষ। আমাকে দেখার কেউ নেই। চিকিৎসা করানোর সামথর্্য নেই। কোনোদিন খেয়ে আর কোনোদিন না খেয়ে আমার জীবন চলছে। এটাই কি আমার পাওনা ছিল?

মহীয়সী নারী হিসেবে বীরাঙ্গনাদের ত্যাগের যথাযথ মযার্দা না দিলে একদিন এই বাঙালি জাতিকেই তার জবাবদিহি করতে হবে। একটি সুন্দর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পাওয়ার স্বপ্নে তারা ঝঁাপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধের ময়দানে। পিছু ফিরে তাকায়নি। বীরদপের্ এগিয়ে গেছে। সেই বীর নারীদের কেন আমরা অবমাননা করছি? বীরাঙ্গনাদের ন্যূনতম সামাজিক স্বীকৃতি দেয়া হয় না। সমাজে তারা খারাপ মেয়ে মানুষ। অথচ তাদের আত্মত্যাগে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের সমাজ কেন তাদের একঘরে করে রাখে? তারা তো কোনো দোষ করেনি। দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে তারাও নিজের জীবনকে উৎসগর্ করেছে স্বাধীনতার বেদিতে যাতে দেশের মানুষ কারো কাছে মাথা নত না করে, অন্যায়ের কাছে সমপির্ত না হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<26286 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1