শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর জৈবিক পরিবতর্ন ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ

মাহমুদা রিদিয়া রশ্মি
  ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
অলঙ্করণ : নিশা মাহজাবীন

ভ‚মিষ্ঠ পরবতীর্ ধাপগুলোতে একজন কন্যাশিশুর ক্রমবিকাশ ও রূপান্তর হয়। বহুধরনের রূপান্তরের মধ্যে জৈব বিকাশের প্রাধান্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজে স্পষ্ট দৃশ্যমান। কেবল কন্যাশিশুর দৈহিক রূপান্তরে বালিকা, কিশোরী, তরুণী ও পরিপূণর্ নারীর পরিণতিটি তৃপ্তিতে গ্রহণ করেছে পিতৃপ্রধানগণ। তাদের সুবিধামতো মাংস পিÐে গড়া একজন মানুষকে কেবল নারীতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। চাহিদামতো নারীদের বিভিন্ন ভ‚মিকায় রেখেছে। অনেকটা তরল পদাথের্র মতো। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে আজ অব্দি মন্দ-ভালো যে কোনোটাতেই নারী তার স্বাতন্ত্র্য ভুলে পুরুষের সত্তার সঙ্গে একাত্মবোধ হয়ে তাদের চাহিদার মযার্দা দিতে বাধ্য হয়েছে। বহুকাল শিকলবন্দি জীবনের অবসান ঘটিয়ে নারীদের নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা গড়বার লড়াইয়ের পেছনে পুরুষদের কিন্তু অবদান রয়েছে। তাও আবার পুরুষদের প্রয়োজনেই। পুরুষদের খোড়াক মেটাতে নারীদের কখনো বা ইতিবাচক কখনো বা নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে। পুরুষদের খোড়াকের অন্যতম হলো জৈবিক চাহিদা। এটির জন্য পুরুষ নারীকে গ্রহণ করেছে। করেনি কেবল নারীর প্রাকৃতিক পরিবতর্নকে। নারীকে তারা খারাপ/ অসুস্থ/অশুচি বলতে একচুলও ছাড় দেয়নি। শরীর ও মন পরিবতের্নর গঠনক্রিয়া ঋতুক্ষরণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একজন নারীর দেহে এটি ভাঙে ও গড়ে। সন্তান ধারণ ও প্রসব যতটা যন্ত্রণাময় ততটার চেয়েও বিরক্তিকর ঋতুক্ষরণ। কেবল নারীকে শত যন্ত্রণা সহ্য করে মনের সঙ্গে আপস করতে হয়েছে। মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়েছে।

দ্য বোভোয়ার নারীর মাসিক রক্তক্ষরণের প্রক্রিয়াটিকে দৃষ্টি ও আবেগগ্রাহ্য করে তুলেছেন একটি চিত্রকল্পে। বলেছেন (১৯৪৯,৬১): নারীর ভেতর প্রতিমাসে গড়ে ওঠে একটি দোলনা; অপেক্ষা করে একটি শিশুর জন্য কিন্তু শিশু আসে না বলে ভেঙে যায় দোলনাটি। ওই নষ্ট দোলনা নারীর ভেতর থেকে ক্ষরিত হয় বিষণœ রক্তিম ধারারূপে। নারী পুরুষেরই মতই দেহ, তবে এ সময় তার দেহ সে নয়; অন্য কিছু। নারী প্রজাতির শিকার; নারী তার জীবনের অনেকগুলো বছর বিশেষ বিশেষ সময়ে বন্দি থাকে তার অভ্যন্তরীণ ঋতুচক্রে (নারী, হুমায়ুন আজাদ)।

এ চরম সত্যকে পিতৃপ্রধানগণ সম্মান, পুরস্কার বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবতের্ দিয়েছে শাস্তি। করেনি আশীবার্দ। করেছে তিরস্কার। এমনটি হওয়ার কথা ছিল না, পিতৃজাত ঋতুস্রাবকে দূষণ মনে করবে। ভাববে তারাও দূষিত হচ্ছে। এমনটি হওয়ার ফলে নারীরা বিব্রতবোধ করে। প্রাচীনের ঋতুস্রাবের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বতর্মান সমাজে বিলুপ্তপ্রায় এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত।

হুমায়ুন আজাদ তার নারী গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, কোনো কোনো সমাজে মেয়ের প্রথম ঋতু দেখার সময় উৎসব করা হতো। আঠারো শতকের কবি নসরুল্লাহ খোন্দকার জানিয়েছেন চট্টগ্রামে ঋতুস্রাবকে বলা হতো ‘পুষ্পদেখা’ এবং সেখানে কন্যা বা বধূর প্রথম রজঃস্বলা হলে বাজনা বাজিয়ে এবং সহেলা ও নৃত্যাদির অনুষ্ঠান করে উৎসব করা হতো; তবে রজঃস্বলা নারীকে মুসলিম ঘরেও অপবিত্র মনে করা হতো। এমনটি হওয়ার ছিল না যে, পিতৃতন্ত্রের তিরস্কারে ঋতুস্রাব গোপন নিষিদ্ধে পরিণত হবে। বরং তা প্রকাশ্যে মযার্দা দেয়ার কথা ছিল। আদিম মানুষরা নারীর পুনরাবৃত্তকে দেখেছে ঘৃণার চোখে। বিভিন্ন ধমের্ নারীর মাসিক চক্রকে অপবিত্র বলা হয়েছে। রক্তক্ষরণ একধরনের শান্তি সেটার পরিবতের্ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটি একধরনের ভয়। তাই সমাজে ঋতুমতী নারীকে নিদের্শ করা হয়েছে অশুচি। এই কুসংস্কার বিশ^সংসারে বহুল প্রচলিত। ভারত ও নেপালে এখনো প্রচলিত যে রজঃস্বলা নারী কোনো সবজি, ফল বা খাবার জাতীয় কিছু স্পশর্ করলে সেটি পচে যাবে (নাইট, ১৯৯১)। দুঃখজনক হলেও এটিই সত্য বতর্মান বিশে^র কোনো কোনো সমাজে রজঃস্বলা নারীকে একঘর করে রাখা হয়।

মেসোপটেমিয়ায় প্রচলিত বিশ^াস ছিল যে, দেবী নিনহুরসাগ ‘মানবিক মৃত্তিকায়’ তার জীবনের রক্ত সঞ্চালিত করেছেন। বস্তুত ‘অ্যাডাম’ বা ‘আদম’ নামটি এসেছে স্ত্রীবাচক ‘আদামা’ থেকে যার অথর্ ‘রক্তাক্ত মৃত্তিকা’। পÐিতরা একটু ঘুরিয়ে বলেছেন ‘লালমাটি’। ঋতুমতী নারীরা পুরুষের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা থেকে নীরব ও বিরত থাকে শুধুমাত্র লজ্জা, নিষিদ্ধকরণ ও কুসংস্কারে। ছোটবেলার কিছু ঘটনা বুঝিয়ে দেয় বতর্মান সমাজে রজঃস্বলা কতটা নিষিদ্ধ। খেলতে গিয়ে হঁাটু বা রান্নায় হাত পাকাতে গিয়ে আঙুল কেটেছে। লাল রক্ত বের হয়েছে। বাবাকে বলা নিষেধ। প্রথম যেদিন অপ্রত্যাশিত স্থান থেকে রক্তের সূত্রপাত সেদিন মা-খালাদের বারণ। নিষেধ। তাদের বলতে শোনা যায় শরীর খারাপ হয়েছে, নামাজ নিষেধ। পুজোর ঘরে প্রবেশ নিষেধ। অপবিত্র। অশুচি। অথচ মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায়Ñ সুস্থ বলেই মাসিক হয়েছে। দূষিত রক্ত বের হয়েছে। কিন্তু সমাজের চোখে এটাই খারাপ। ফলে ঋতুচক্রের সময় নারীর আপত্তিকর দেহ তাকে মানসিক ও নৈতিকভাবে হীনম্মন্যতায় ফেলে।

ঋতুস্রাবের সময় নারী পুরো প্রটেকশনে থাকলে কখনই অশুচি হওয়ার নয়, বরং তা হাইজিন ও সায়ান্স। প্রটেকশনে থাকলে রোগ জীবাণু ছড়াবে না এ বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে গণমাধ্যম গুরুত¦পূণর্ ভ‚মিকা পালন করতে গিয়েও পদে পদে নারীদের হীন করেছে। টিভিতে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিজ্ঞাপনে নীল তরল পদাথের্র যেটা দেখাচ্ছে সেটা নাকি পিরিয়ডস। তাহলে কী রক্তের রং নীল হয়। এতদিন বই পুস্তকে যেটা পঠিত হয়েছে সেটা কী তাহলে ভুল? ধমনীতে কী তাহলে বøুøু বøাড দৌড়ায়। কোন মাপের স্যানিটারি পরতে হবে, কোনটার আবজর্ব করার ক্ষমতা বেশি, সব বিজ্ঞাপনে দেখাচ্ছে কিন্তু প্যাডের গুণবিচারে এটা নীল তরল। তাহলে কী রক্তের রং লাল দেখালে যৌনতা প্রকাশ পাবে বলে এত লুকোচুরি। এটি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হলেও প্রগতিশীল গণমাধ্যমও সেখান থেকে বের হতে পারেনি। প্রাচীন প্রথাকে অঁাকড়ে রেখে নারীদের পেছনে রাখার জন্য যারা এসব বিজ্ঞাপন বানায় তারাও কিন্তু সমাজেরই অংশ।

কেউ নারী হয়ে জন্মায় না বরং ক্রমান্বয়ে নারীতে পরিণিত হয়। পরিণত নারী হওয়ার জন্য সে সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক বিশ^াসগুলোতে ধারণ করে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ঋতুমতি নারীর শারীরিক, মানসিক ও আবেগের ওপর প্রভাব পড়ে। ফলে নারীরা হীনম্মন্যতায় ভোগে। এ সময় পরিবারের অনুপ্রেরণা না পেয়ে মানসিক স্থায়িত্ব হারানোর সম্ভাবনা থাকে। তারা এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে না পারায় অনেকটা অন্তমুখী আচরণ করে। তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দেখা যায়।

কখনই নারীরা ভাবেনি রজচক্রবিষয়ক খোলামেলা আলোচনার অধিকার রয়েছে। রজচক্র নারী অধিকারের ইস্যু বিধায় এটি নারীবাদ আন্দোলনে দঁাড়ানো উচিত। ঋতুস্রাব একজন নারীর সম্মান ও মযার্দার সঙ্গে বেঁচে থাকার মতো অধিকার। মানবাধিকারের সাবর্জনীন ঘোষণাপত্র-১৯৪৮ (৩) অনুযায়ী প্রতেকের জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য রজচক্রও অধিকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত থাকতে পারত কিন্তু সমাজ সেটিকে অধিকারের পযাের্য় ফেলেনি।

ঋতুস্রাববিষয়ক বিভিন্ন প্রথা ও কুসংস্কারে বিশে^র যে কোনো নারী ও কিশোরীরা যৌন নিযার্তন, ধষর্ণ ও ধষর্ণ পরবতীর্ হত্যার শিকার হতে পারে বলে গবেষকদের ধারণা। ভারতে অস¦াস্থ্যকর মাসিক ব্যবস্থাপনায় নারীরা বন্ধ্যাত্ব ও ক্যান্সারসহ এইচআইভি/এইডস ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে (গাজর্, গয়েল এবং গুপ্তা, ২০১১)। এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা বলে দেয় একজন ঋতুমতি নারীর স্বাস্থ্যকর পরিবেশে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবতের্নর জন্য ট্যাবুস ভেঙে বেশি বেশি প্রচারণা দরকার।

লেখক : এম.ফিল শিক্ষাথীর্, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<27405 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1