মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
বেগম মুশতারী শফী

প্রজন্মের পথ চলার আদশর্

রহিমা আক্তার মৌ
  ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

শহীদজায়া ও শহীদভগ্নি বেগম মুশতারী শফী বতর্মানে চট্টগ্রাম উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি। একাধারে তিনি সাহিত্যিক, সম্পাদক, বেতার ব্যক্তিত্ব, উদ্যোক্তা, নারীনেত্রী, সমাজ সংগঠক এবং সবোর্পরি সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। গেল বছর অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪২৪-এর মুকুট ছিল বেগম মুশতারী শফীর।

তিনি ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পিতার কমর্স্থল পশ্চিমবঙ্গে ভারতের মালদহ জেলার কালিয়াচক থানায় জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরে, আর নানাবাড়ি খুলনায়। জন্মের ৩ মাস পর মা মারা যান। ৯ বছর বয়সে বাবাও চলে যান না ফেরার দেশে। যার ফলে অনেকটা ছিন্নমূল জীবন শুরু হয় তার। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারেননি তিনি।

মায়ের মৃত্যুর পর অনেকটা জোর করেই মুশতারী শফীর দাদি তার আব্বাকে দ্বিতীয় বিয়ে করান। মুশতারী শফীরা তিন বোন এক ভাই ছিলেন। বাবার কমর্স্থল ছিল ঢাকায়। দুইবোনের বিয়ের পর মুশতারী শফীকে পুরনো ঢাকার নারীশিক্ষা মন্দিরে ভতির্ করে দেয়া হয়। এরপর কামরুন্নেসা স্কুলে টেনে ওঠার পরপরই ১৯৫৩ সালের শেষের দিকে বিয়ে হয় ডা. শফীর সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই তিনি চট্টগ্রামে বসবাস করছেন।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সবসময়ই যুক্ত ছিলেন ডা. শফীর পরিবারটি। প্রায় সবাই ছিলেন ডা. শফীর বন্ধুস্থানীয়। বাম নেতাদের অনেকেই তাদের বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও পরিবারটির একটি ভ‚মিকা ছিল। বেতার কেন্দ্রের সূত্রপাত হয়েছিল ‘মুশতারী লজ’ নামের বাড়ি থেকেই।

ষাটের দশকের প্রথমভাগে নারীমুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে নিজ উদ্যোগে ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন। সংঘের মুখপত্র ‘মাসিক বান্ধবী’ ১৯৬৪ সাল থেকে এক নাগাড়ে নিয়মিত ১১ বছর সম্পাদনা করেন। এমনকি চালু করেন নারী পরিচালিত ছাপাখানা, ‘মেয়েদের প্রেস’, যা আজকের দিনের বিবেচনাতেও ছিল একটি অত্যন্ত বৈপ্লবিক কাজ। কম্পোজ করা থেকে শুরু করে, মেশিন চালানো, বঁাধাই সব কাজই একসময় ‘বান্ধবী’রাই করতে লাগল। মেয়েদের গান, গিটার, তবলা, সেলাই, এমনকি চামড়া কেটে ডাইস করে ব্যাগ তৈরি করাসহ নানা রকমের কুটির শিল্পের কাজ শেখানো হতো বান্ধবী সংগঠন থেকে। ‘বান্ধবী পুরস্কারও’ প্রবতর্ন করা হয়েছিল। পর পর তিন বছর সে পুরস্কার দেয়া হয়। দশর্নীর বিনিময়ে নাটকের আয়োজনও প্রথম করেছিল ‘বান্ধবী’। একাত্তরে বান্ধবী সংঘের পক্ষ থেকে বড় বড় তিনটা নারী সম্মেলন করা হয়। সেই সময় গ্রাম থেকে বোরখা পরে মহিলারা এসে সমাবেশে যোগ দিতেন। মুশতারী শফীর বাড়ির নিচের গ্যারাজের জায়গাতে ছাপাখানা বসানো হয়েছিল। ’৬৮, ’৬৯-এ রাজনৈতিক পোস্টার, লিফলেট এসব ছাপানোর কাজ করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে তিনি নিজেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

এক সাক্ষাৎকারে চট্টগ্রামের মেয়েদের অবস্থা ও কাজ নিয়ে তিনি বলেন-

‘চট্টগ্রামে এসে দেখলাম, যেই চট্টগ্রাম অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, যেই চট্টগ্রামের মেয়েরা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছে, সেই চট্টগ্রামের মেয়েরা, বিশেষত রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়েরা খুবই পশ্চাৎপদ। মেয়েদের একমাত্র সংগঠন ছিল আপওয়া— ‘অল পাকিস্তান ওইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’। তো, আমি ওখানকার সদস্য হলাম। চট্টগ্রামে তখন একটা বিরাট সাংস্কৃতিক কমর্কাÐ গড়ে উঠেছিল রেলওয়েকে কেন্দ্র করে। সেই সময় রেলওয়ের চেয়ারম্যান ছিলেন আর এন বাগচি। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে শিল্পী সংঘ প্রতিষ্ঠিত হলো। মাহবুবুল আলম চৌধুরী, সুচরিত চৌধুরী এরা ডাক্তার শফীর বন্ধু হয়েছিলেন। তো আপওয়াতে বাঙালিদের কথার তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। পহেলা বৈশাখও পালিত হতো না। আমরা ধীরে ধীরে কৌশলে পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্রজয়ন্তী এসব দিবস পালন করতে লাগলাম। এক সময় ওদের সঙ্গে বিরোধ এতটাই বেড়ে গেল যে, আমরা আপওয়া থেকে বেরিয়ে আসলাম। বেরিয়ে আমরা ‘বান্ধবী সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করলাম।

ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত বেগম পত্রিকা, শিশু সওগাত আসত মুশতারী শফীদের বাড়িতে। ওগুলো পড়তে পড়তেই সেই ছোটবেলাতেই ইচ্ছে হয় পত্রিকা বের করার। ১৯৬১ সালের দিকে ঢাকায় বেগম ক্লাবের একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন তিনি। সেখানে নূরজাহান বেগম, নাসিরউদ্দিন সাহেবসহ আরো অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। নিজেদের সাহিত্য আড্ডায় যে লেখাগুলো আসত সেগুলো দিয়েই পত্রিকা করার কথা মাথায় আসে মুশতারী শফীর। পূণের্ন্দু দস্তিদার, বেলাল মোহাম্মদসহ কয়েকজনকে পরিকল্পনার কথা জানান। সবাই উৎসাহ দেন আর পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব দেন উনাকেই। পত্রিকা প্রকাশের জন্য আথির্ক সহযোগিতা করেন ডা. শফী, এ কে খান, নাসিরউদ্দিন সাহেব আর ইস্পাহানিসহ অনেকেই। বাকিতে পত্রিকা ছেপে দিতে রাজি হয় সিগনেট প্রেস। আর বিজ্ঞাপনের জন্য কলেজের ছাত্রীদের কমিশনের ভিত্তিতে কাজে লাগাতেন তারা।

১৯৬৭ সালের শেষের দিকে। ’৬৮, ’৬৯-এ রাজনৈতিক ঘনঘটার সময় পোস্টার, লিফলেট এসব ছাপানোর ধুম পড়ে যায়। এদিকে প্রেস চালাচ্ছেন, অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক কমর্কাÐেও অংশ নেন। ১৯৭১ সালের মাচর্ সংখ্যা বের করার পর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুশতারী শফীর স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফী ও তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছোট ভাই এহসান শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে তার সক্রিয় ভ‚মিকা ছিল। যুদ্ধ শুরু হলে ২৭ মাচর্ মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করার লক্ষ্যে ট্রাকভতির্ গোলাবারুদ নিজগৃহে ‘মুশতারী লজ’-এ গোপনে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করেন তিনি। এরপর যুদ্ধচলাকালে তার বাড়ি, বান্ধবীর অফিসসহ সবকিছু লুট হয়ে যায়। আগস্ট মাসে কলকাতায় গিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’ শব্দসৈনিক ও নাট্যশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন উম্মে কুলসুম নামে। এ ছাড়াও আকাশবাণীতে ডালিয়া মোহাম্মদ ছদ্মনামে ‘জানেন ওদের মতলব কী?’ শিরোনামে স্বরচিত কথিকা ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্প প্রচার শুরু করেন। তখনই পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রে ‘নিজস্ব লেখক শিল্পী’-পদে চাকরিতে যোগদান করেন মুশতারী শফী। সামাজিক কমর্কাÐের সঙ্গে চালিয়ে যান নিজের কমর্স্থলের কাজও। ১৯৯৫ সালে চিফ স্ক্রিপ্ট রাইটার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এ সময় বেতারে প্রচারিত নাটকের সংখ্যা মোট ১৭টি যার মধ্যে মৌলিক রচনা ৯টি। এ ছাড়াও বেতারে শিশু-কিশোর অনুষ্ঠান, মহিলাবিষয়ক অনুষ্ঠান, কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান ও জনসংখ্যা কাযর্ক্রম অনুষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদে নিয়মিত পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেন। পাশাপাশি বেতার নাটকেও তিনি অংশগ্রহণ করেন।

বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখেছেন তিনি। তার লেখার মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর গল্পগ্রন্থ, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই। গল্প, উপন্যাস ছোটদের জন্য লিখলেও নিজের লেখালেখির মূলক্ষেত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে বেছে নেন বেগম মুশতারী শফী। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’। বইটির ইংরেজি অনুবাদও বের হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরেকটি গবেষণাধমীর্ বই ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, এতে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের খ্যাত, অখ্যাত নারীদের বীরোচিত ভ‚মিকার কথা আলোচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি কিছু ছোটগল্প লিখেছিলেন আকাশবাণী বেতার কেন্দ্রের জন্য। সেগুলোও একপযাের্য় ‘দুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ’ নামে বই আকারে বের হয়। এ ছাড়া ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ ও ‘একুশের গল্প’ নামে আরো দুটো ছোটগল্পের সংকলন রয়েছে তার। ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি জাহানারা ইমামকে’ এবং ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ বইগুলোর উপজীব্য মুক্তিযুদ্ধ। শেষের বইটিতে তিনি একাত্তরে স্বামী ও ভাইকে হারানোর স্মৃতি তুলে ধরেছেন। সব মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা কুড়িটি হবে।

১৯৯২ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল- নিমূর্ল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’Ñ চট্টগ্রাম জেলা শাখার আহŸায়ক হন মুশতারী শফী। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলায় ঘাতক নিমূর্ল আন্দোলন বেগবান হয়। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল-নিমূর্ল কমিটি কেন্দ্রের আহŸায়ক পদ গ্রহণ করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জাহানারা ইমামের মৃত্যুতে ঝিমিয়ে পড়া আন্দোলন পুনরায় গতিলাভ করে। এ সময় তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির এই আন্দোলনে প্রবাসী বাঙালিদের সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন দেশ সফর করেন। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফঁাসি নিয়ে পাকিস্তান পালামেের্ন্ট ধৃষ্টতাপূণর্ শোক প্রস্তাব পাস করায় বাংলাদেশিদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহŸান জানিয়েছেন শহীদ জায়া ও লেখিকা বেগম মুশতারী শফী।

সময়ের অগ্রপথিক, দূরদশীর্ মুশতারী শফী সেই ষাট দশকের শুরুতেই মফস্বল চট্টগ্রামে নারীদের সংগঠন করেন। সেখান থেকে আজ তিনি চট্টগ্রাম উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি। এর মাঝে এতগুলো বছর সংগ্রাম, নেতৃত্ব, প্রতিবাদ সব কিছুতেই তাকে দেখা গিয়েছে। এমন একজন সংগ্রামী নারীর আদশর্ আমাদের ও আমাদের পরের প্রজন্মের পথ চলার জন্য উপহার হয়ে থাকবে, আদশর্ হয়ে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<31975 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1