শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারী সাহসিকা

ডা. তানজিনা আল্‌-মিজান
  ১১ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ দুইটি অবিচ্ছেদ্য শব্দ। বাঙালি জাতির হৃদয়ের গভীরের একটি শব্দ 'মুক্তিযুদ্ধ'। এই মুক্তিযুদ্ধ আসলে কি? পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে ও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশ মাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য জাতির অধিকার আদায়, সর্বপরি একটি পতাকার জন্য এ দেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল আর ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা- একেই বলে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে কোনো দলের বা গ্রম্নপের একক অবদান আছে এটা বলা যাবে না। কারণ কেবল প্রত্যক্ষ যুদ্ধই নয়, পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা ও সব শ্রেণিকে উদ্বুদ্ধ করা, বোমা তৈরিসহ গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ, সংবাদ আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অর্থ, ওষুধ, খাদ্য বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকার্য খাদ্য ও আশ্রয়দান প্রভৃতি সমস্ত কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনের জন্য অবশ্য করণীয় ছিল। উলিস্নখিত কর্মকান্ডের যে কোনো একটি বাধাগ্রস্ত হলে যুদ্ধে জয়লাভ করা কঠিন হয়ে পড়ত- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

\হতবে এ কথা ঠিক, এসব কাজে যারা সরাসরি অস্ত্র ধরেছিলেন তাদের প্রাণ হারানোর আশঙ্কা ছিল সর্বাপেক্ষা বেশি। কিন্তু এটিও অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে যে কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাওয়াই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। আর সে ক্ষেত্রে নারীর শারীরিক নির্যাতনের ব্যাপারটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সব ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী সশস্ত্র যুদ্ধসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছিল তাদের অবদানও সমান গৌরবের। পাকিস্তানিদের হাতে প্রায় তিন লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিল। আর নির্যাতনের শিকার হয়েছিল দুই লাখ নারী। সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কিশোরী, তরুণী, প্রৌঢ়া এমনকি প্রবীণ অবিবাহিতা নারী ও বিবাহিত নারী কিভাবে তাদের ক্ষত-বিক্ষত জীবন পার করেছেন তা কল্পনার অতীত। বর্বতার শিকার এই নারীদের কয়েকজন অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। কেউ কেউ এসএসসি পাস থেকে শুরু করে এমএ পাস এমনকি এমবিবিএস ডাক্তারও ছিলেন। যারা বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্যও নেই। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এসব নারীর মধ্যে স্বল্পসংখ্যক শ্রমজীবী নার্স, সমাজসেবী, গৃহকর্মী, চাকরিজীবী, অধিকাংশই গৃহিণী। এসব নারীর দুই একজন অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের ভেতরে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভারতে স্থাপিত হাসপাতালে নার্স হিসেবে, চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করেছেন কয়েকজন। দেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পৌঁছে দেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করেছেন অনেকে। এই নারীরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।

জাতির মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে পরিমাপ করা যাবে না। এই বিশালতায় যেসব নারী বিভিন্ন অবস্থানে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যমন্ডিত করেছেন তাদের অনেকের নাম এখনো অজানা। তবে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীরা সারা দেশেই তৎপর ছিলেন। তারা বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত হওয়ার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছেন। মমতাজ বেগম, কাজী রোকেয়া সুলতানা, বেবী মওদুদ, রানী খান, রোকেয়া কবীর, মনিরা আক্তার প্রমুখ নারী জনমত গঠনের পাশাপাশি ফিজিক্যাল ফিটনেস, মার্চ পাস্ট, অস্ত্র চালনা, ফাস্ট এইড, ট্রেঞ্চ করা এবং আত্মরক্ষার নানা কৌশল- এসব ব্যাপারে ট্রেনিং নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষা দিতেন। বদরুন্নেসা আহমেদ পুনর্বাসন কার্যকলাপ ও মহিলা সংগঠন মুজিবনগরের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন একাত্তরে।

বেগম নুরজাহান খুরশীদ বিভিন্ন সেক্টরগুলোর কর্মকান্ড পরিদর্শন ও রিপোর্ট আদান-প্রদানের কাজ করলেও পরবতী সময়ে কূটনীতিকের দায়িত্বও পালন করেন।

সাজেদা চৌধুরী- তার বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। সেই সঙ্গে সচেতন করতেন কোন কোন বিষয়ে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।

প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে মহিলা মুক্তিফৌজের হাল ধরেছিলেন। এই মহিলা কমিটি মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এই কমিটিতে প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ ছাড়াও গীতারানী নাথ, নিবেদিতা দাস, সুধারানী কর মঞ্জুদেবী, সুষমা দাস ও রমা রানী দাস এদের নাম উলেস্নখযোগ্য। কাজের সুবিধার্থে প্রশিক্ষণ সেবা ধাত্রী বিদ্যা, প্রাথমিক চিকিৎসা, কুটির শিল্প, মুদ্রণ ও রামকৃঞ্চ মিশন এ রকম কয়েকটি সাব-ইউনিটে বিভক্ত হয়ে কাজ করেছেন নারীরা। তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণ সেবার দায়িত্বে কানন দেবী, উপাসনা রায়, সুধারানী কর, পূর্ণিমা রানী দাস ও নিপা রানী মুজমদারের নাম উলেস্নখযোগ্য। প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ, সুক্লা রানী দে, হেমলতা দেব ছাড়াও আরো অনেকে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।

নাজিয়া ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া রনাঙ্গনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। সেলিনা বানু সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা ও শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে তৎপর ছিলেন। এসব কাজে বেগম মুস্তারী সাফী, মতিয়া চৌধুরী, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, রীনা খান প্রমুখের নামও উলেস্নখযোগ্য।

বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং সক্ষম নর-নারীদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে তোলার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শাহনাজ বেগমের কণ্ঠে- সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা, কল্যাণী ঘোষের পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, এ রকম আরো অজস্র গানের সুর শুনে মানুষ শিহরীত হয়েছে আর ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশরক্ষার সংগ্রামে। প্রাণ বিষণ্ন হতে পারে একথা জেনেও যেসব স্ত্রী, মাতা, ভগ্নি কন্যারা তাদের প্রাণপ্রিয় স্বামী, পুত্র, ভাই ও বাবাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন তাদের এই মহানুভবতার উৎসও অবশ্যই দেশপ্রেম। এ ক্ষেত্রে শেখ ফজিলাতুন্নেসার নাম সর্বাগ্রে। এ ছাড়াও জাহানারা ইমাম ও বেগম সুফিয়া কামালসহ আরো হাজারো নাম না জানা নারী যোদ্ধারা ছিলেন।

বেগম নুরজাহান মুরশিদ, আমেনা আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী ও মালেকা বেগম প্রমুখ এসব নারী পেশাদার কূটনীতিক না হলেও দেশের প্রয়োজনে তাদের সেই চরম মুহূর্তে এরকম গুরু দায়িত্বে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে সর্বমোট ৬৭৬ জন বীর যোদ্ধাকে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজন নারীও রয়েছেন। একজন হলেন ডা. সেতারা বেগম ও অন্যজন তারা ভানু বিবি (তারামন বিবি) যাদের "বীর প্রতীক" খেতাব দেয়া হয়। বাঙালির এ যাবতকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও গৌরবজনক জাতীয় আন্দোলন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীরাও যে পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় যাবতীয় ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অনস্বীকার্য।

বর্তমান সময়ের মতো একাত্তরে আমাদের দেশে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা এতো বেশি ছিল না। তা সত্ত্ব্বেও নারীদের স্বক্রিয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ- তাদের চিরাচরিত রূপকেই প্রকাশ করে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<40361 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1