শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সভ্যতা সৃষ্টির কারিগর

নতুনধারা
  ২০ মে ২০১৯, ০০:০০

মনিরা মিতা

জীবনের ব্যথা বয়ে বেড়ানোর জন্যই জীবন। বড়ই নিঃশব্দ জীবন। অথচ নিঃশব্দের আড়ালে গুমড়ে মরে বিষণ্নমুখ যা অনিদ্রায় অনাহারে কাঠ হয়ে গেছে। অন্ধকার মুখ, ধোঁয়ায় ধূসর সারা দেহে দারিদ্র্যতার ঝাঁঝালো গন্ধ। তন্দ্রাচ্ছন্ন ঢুলুঢুলু চোখের চাহনী নিয়ে ভোর না হতেই ছুটে চলা। কাঁপা-কাঁপি, কর্কশ, লম্বা হুইসেল শ্রমজীবীদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে স্বপ্ন-সাধ, আশা-ভালোবাসা, জীবন থেকে যন্ত্রদানব প্রতিটা দিন কেড়ে নিচ্ছে জীবনের সতেজতা। মাংসপেশী ও শিরা উপশিরা থেকে যতদূর পারা যায়, যন্ত্র তার আহারের রস চুষে নিচ্ছে। জীবন এগিয়ে যাচ্ছে মৃতু্যর গহ্বরের দিকে তবুও অদূরাগত প্রভাতের কালচে আলোয় কর্দমাক্ত সঙ্কীর্ণ পথে তরল বিবর্ণ চোখের অর্থহীন দৃষ্টি নিয়ে প্রতিটি প্রাণ গোধূলির ঈষৎ আলোর সন্ধানে এগিয়ে চলছে। তাদের জীবন থেকে দিবসের রৌদ্রের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন যন্ত্রদানবের নিদারুণ আহ্বানে নতমস্তকে অসংখ্য নর-নারী ম্স্নানবদনে ঘর ছেড়ে দলে দলে বেরিয়ে পড়ে। ছুটি বলে শব্দটি জীবনে আসে খুব কম, কখনও যদি আসে তুবও সেখানে চিন্তার সীমানা কারখানা আর যন্ত্রপাতিকে ছাড়িয়ে যায় না। সারাটা জীবন নির্দয় অনিবার্যতার মতো অন্ধকারে কারখানার চিমনিগুলো সরলভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। এর থেকে মুক্তির চিন্তা মানে শুধু জীবনের বোঝার মাত্রা বাড়ান। এমনিভাবে জীবনযাপন করে ৫০/৬০ বছর বয়সে একজন শ্রমজীবী পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করে।

না, এটা কোনো গল্প না, এটা আঠারো শতকের প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের ইতিহাস। আঠারো শতকে যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নতিতে বিজ্ঞানীরা এমন সব যন্ত্র আর কল-কারখানা নির্মাণ করলেন যে, প্রকৃতি চলে এলো মানুষের নিয়ন্ত্রণে। মানুষ হয়ে গেল যন্ত্র নির্ভর। মানবসভ্যতার এই পরিবর্তন পরিচিতি পেল শিল্পবিপস্নব নামে। বিশাল বিশাল সব কারখানায় লাখ লাখ মানুষ কাজ করতে লাগেন।

কল-কারখানায় মানুষ যন্ত্রের মতো কাজ করতে শুরু করল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দিয়ে দিনে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করাতো তবে পারিশ্রমিক দিত যৎসামান্য। এসব সহ্য করতে করতে এক সময় শুরু হলো শ্রমিক বিদ্রোহ। মালিকপক্ষ বিদ্রোহী শ্রমিকদের ওপর শুরু করল অত্যাচার। অসংখ্য শ্রমিক প্রাণ দিয়েছে শ্রমিক বিদ্রোহে। তাদের দাবি ছিল আট ঘণ্টা কাজের, ন্যায্য মুজুরির দাবি, মালিকরা শ্রমিকদের দাবি উপেক্ষা করায় ১৮৮৬ সালের ১ মে মার্কিন মুলুকে অর্থাৎ আমেরিকায় ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল শ্রমজীবী মানুষ।

১ মে ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরে সাড়ে ৩ লাখ শ্রমিক মিশিগান এভিনিউতে মিছিলে যোগদানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, মালিকাপক্ষ ভয় পেয়ে পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দিল শ্রমিকদের বিরুদ্ধে, পুলিশের নির্যাতনে ৬ শ্রমিক নিহত হলো, আহত হলো অসংখ্য। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ সভা থেকে পুলিশ বাহিনীর দিকে ছুড়ে মারা বোমার বিস্ফোরণ হলো অজুহাত, পুলিশের গুলিতে নিহত হলো ৪ হাজার শ্রমিক। গ্রেপ্তার হলো ১৬ জন। ১৮৮৭ সালের ২১ জুন তাদের বিচার শুরু হয়। অবশ্য বিচার না বলে প্রহসনই বলা ভালো। ৩ জনকে যাবজ্জীবন, ৬ জনকে দেয়া হয় ফাঁসি। ফাঁসির মঞ্চে এগুতে এগুতে তারা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে রচিত গণসংগীত ও বিপস্নবী গান গেয়ে যান।

ফাঁসিতে ঝোলানোর ঠিক পূর্বমুহূর্তে স্পাইস নামের এক শ্রমিক বলেন 'এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের নীরবতা (মৃতু্য) তোমরা যে কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চাও, তার চেয়েও শক্তিশালী হবে।' বৃথা যায়নি, সংশপ্তর স্পাইসের সেই গর্জন, ১৯৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের একটি সম্মেলন। তাতে শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘণ্টা ও সপ্তাহে ১ দিন ছুটির বিধি রেখে তৈরি হলো প্রথম শ্রম আইন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর থেকেই ১ মে সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিকতা ছাড়িয়ে যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো সত্যিই কি বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ! আছে কি তাদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা !

মে দিবস পালন তখনই সার্থক হবে যখন দেশের শ্রমজীবী মানুষ ন্যায্য মুজুরি ও নিরাপদ কর্মস্থলের নিশ্চয়তা পাবেন। দেশীয় ও বৈশ্বক প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের ওপর যে শোষণ ও বঞ্চনা চলছে, হোক তার অবসান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50170 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1