বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাল-সবুজের পতাকা হাতে 'ফ্ল্যাগ গার্ল' নাজমুন নাহার

নতুনধারা
  ০৮ জুলাই ২০১৯, ০০:০০
বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে একাই ছুটে বেড়ানো বাংলাদেশের সাহসী কন্যা নাজমুন নাহার

রুমান হাফিজ

'এই পৃথিবীর অজানাকে জানার স্বপ্ন দেখেছি আমি, পৃথিবীর মাঝে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতি আর মানুষের ভিন্ন জীবনযাত্রা আমাকে দারুণভাবে টেনেছে! সেই ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব টান অনুভব করি রক্তের ভেতরে কেমন হবে ওই অজানা দেশের সবকিছু। অদেখাকে দেখার নেশায় অজানাকে জানার নেশায় ছোটবেলা থেকেই সর্বত্র আমার এই ছুটে চলা। বাবাও আমাকে বেশ উৎসাহ দিয়েছিলেন। আর এখন তো মনে হয় আমার জন্মই হয়েছে পৃথিবী দেখার জন্য।' এভাবেই বলছিলেন লাল সবুজের পতাকা হাতে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে একাই ছুটে বেড়ানো বাংলাদেশের সাহসী কন্যা নাজমুন নাহার। যিনি ইতোমধ্যেই লাখো তরুণের স্বপ্নের দিশারী হয়ে উঠেছেন। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক নতুন পথ সৃষ্টি করে দিয়ে যাচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রেমে পড়েছিলেন। সে থেকে ভ্রমণই তার নেশা। উৎসাহ দিয়েছিলেন তার বাবা। বাবার অনুপ্রেরণায় ডানা মেলেছেন শৈশবেই। উড়ছেন এখনও। বিশ্বরূপ দেখতে গিয়ে মানুষের মাঝে পরিচয় করে দিয়েছেন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে। দেশ-দেশান্তরে শিশুদের মাঝে পৌঁছে দিয়েছেন জীবন দর্শনের শান্তির বার্তা।

শিগগিরই কানাডায় ১৩০তম দেশ ভ্রমণের ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী নাজমুন নাহার! লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর মাধ্যমে নায়াগ্রা জলপ্রপাত হবে তার ১৩০তম দেশের সাক্ষী! প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এটি হবে তার বিশ্ব ভ্রমণের ঐতিহাসিক রেকর্ড।

প্রথম শুরুটা হয়েছিল ২০০০ সালে ভারতের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ৮০টি দেশের গার্লস গাইড আর স্কাউট সম্মেলন। সেখানে দেশের হয়ে পতাকা ওড়ানোর দায়িত্ব পড়ল তার কাঁধে। অদ্ভুত ভালোলাগার একটা শিহরণ বয়ে গেল শরীরে। নিজের দেশের পতাকা অন্য দেশের মাটিতে ওড়ানোর সুখ পেলেন মনে প্রাণে। সেই থেকে স্বপ্নের শুরু। আর স্বপ্নের পূর্ণতায় এখন পর্যন্ত ১২৯টি দেশ ঘুরেছেন। সম্প্রতি জুন-জুলাই মাসে তিনি সফর করেন কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও চায়না।

জাম্বিয়া সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন 'ফ্ল্যাগ গার্ল' উপাধি। পৃথিবীর হাজার সাতেক শহর ঘুরেছেন এ পর্যন্ত। যত না দেখেছেন তার চেয়ে শিখেছেন অনেক বেশি। বতসোয়ানার ফ্রান্সিস টাউন যাওয়ার কালে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। পেয়েছেন অসংখ্য স্মৃতিপত্র, স্মারক অনেক জিনিসও। সবচেয়ে বেশি যা পেয়েছেন তা হলো- পৃথিবী জুড়েই আছে তার বন্ধুবান্ধব।

ছোটবেলায় বাবা উপহার হিসেবে সবসময়ই বই দিতেন। এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করলেন বইয়ের পোকা হিসেবে। মূলত বইয়ের জগতের মধ্য দিয়েই বিশ্বভ্রমণের প্রতি আকর্ষণের জন্ম। দাদা মৌলভী আহমদ উলস্নাহ ছিলেন একজন ইসলামিক স্কলার, তিনি আরবের অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সেটা ১৯২৬-১৯৩১ সালের ঘটনা। সেই গল্পও তাকে টেনেছে ছোটবেলায়।

তারপরের গল্প শুধুই ছুটে চলার। সুউচ্চ পর্বত পেরিয়ে সাগর, মরুভূমি, গ্রাম, শহর, নগর সব চষে বেড়াচ্ছেন। পুরো পৃথিবীতেই পা ফেলার স্বপ্ন তার।

বেড়ে ওঠার মজার স্মৃতিতে হারিয়ে গেলেন নাজমুন। বললেন, 'আমার বেড়ে ওঠা লক্ষ্ণীপুরে। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি, ক্লাসে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমানত উলস্নাহ স্যার আমাকে বাংলাদেশের এবং পৃথিবীর বিভিন্ন মানচিত্র খন্ড খন্ড দিয়ে জোড়া লাগাতে বলতেন। আমি খুব দ্রম্নত বাংলাদেশের মানচিত্র এবং পৃথিবীর মানচিত্র ঠিকমতো জোডা লাগিয়েছি। সেদিন স্যার আমাকে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণা আর স্যারদের আশীর্বাদ পেয়েই আমার পথচলা। পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই আমার এই স্বপ্ন দেখা। ডানপিটে থাকলেও প্রচুর বই পড়তাম। পড়েই এক সময় লক্ষ্য স্থির করি, আমি বিশ্বভ্রমণ করব। এটি ছিল মনের বাসনা। অন্যরা জানতেন না।'

এত যে দেশ ঘুরলেন টাকার উৎস? উত্তরে স্বভাবসুলভ হাসিতে বললেন, 'সবচেয়ে বেশি মুখোমুখি হতে হয়েছে এই প্রশ্নের। উত্তরটা অনেক সহজ। কাজ করে করে টাকা জমাই। সেই টাকা হিসাব করে খরচ করেই আমি ভ্রমণে বের হই।' বসবাস করছেন সুইডেনে। পড়াশোনার সুবাদে পাড়ি জমানো। তারপর থিতু হওয়া। সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ শুরু করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। ভ্রমণের জন্য টাকা জমানোর চিন্তাটা তখন থেকেই। গ্রীষ্মের ছুটি শেষে বেশ অঙ্কের একটা টাকা জমত সেই টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। এ ছাড়া খরচ কমানোর জন্য এবং একটি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত দেখার জন্য আমি পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই ভ্রমণ করেছি সড়কপথে।

নাজমুন নাহার সম্প্রতি ঘুরে আসা দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে যেমনটা বলছিলেন, সব দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা খুব চমৎকার আবার কিছু তিক্ততাও থাকে। তিনি কম্বোডিয়া থেকে লাউস ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত এক শহর থেকে আরেক শহরে সড়কপথে টানা ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে খুবই ভালো লেগেছে লাউসের মেকং নদীর ফোর থাউজেন্ড আইল্যান্ড, ভিয়েতনামের হালং বে, কম্বোডিয়ার আঙ্কোরওয়াট, চায়নার কুনমিংয়ের স্টোন ফরেস্ট।

১০০তম দেশ হিসেবে পা ফেলেছেন জিম্বাবুয়েতে। সেখানে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের কাছে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল পুরো বাংলাদেশ আছে তার সঙ্গে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কথা মনে পড়ছিল বেশি। যারা একটি পতাকা দিয়ে গেছেন। সেই পতাকাকেই উড়িয়েছেন বিশ্বের ১০০টি দেশে। এ অর্জন যেন তার একার নয়। এ অর্জনের ভাগতো সব মুক্তিযোদ্ধার, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানোর শহীদের। ১৬ কোটি মানুষের। নাজমুন নাহারের লক্ষ্য আরো বিশাল। আশা তার বাকি দেশগুলোও ঘুরে দেখার। বিশ্বের সব দেশে পড়বে তার পা। সেই লক্ষ্যে ছুটে চলেছেন সর্বক্ষণ। বাংলাদেশের এই ভ্রমণকন্যাকে থামানোর সাধ্য আছে কার?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<57166 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1