মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও শ্রমজীবী নারী

নারীর অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ খাতের নারী শ্রমিকদের জন্য জেন্ডারবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। স্বনিয়োজিত নারীদের জন্য তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত করা ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন- যাতে তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির এ যুগে ব্যবসা করে টিকে থাকতে পারে। শহরের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারী শ্রমিকের জন্য বিশেষ করে হকারদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বল্পমূল্যে স্থায়ী জায়গা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। যাতে তারা অবাধে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে
নতুনধারা
  ০৫ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

মনিকা দাশ

অভাবের কারণে আমাদের দেশের প্রথাগত পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনও দরিদ্র মানুষের কাছে শিথিল হয়ে যায়। দরিদ্র মানুষের কাছে তার পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, সামাজিক অবস্থান সব কিছুই বৈরী। তাকে প্রতিদিন শত প্রতিবন্ধকতা ও বাধাবিপত্তির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। এই প্রতিকূলতা ও অনিশ্চয়তা অর্থনৈতিক অবস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে কোনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দায় কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাভোগীরা ঠিকই নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আরও বেশি সুযোগ গ্রহণ করে কিন্তু দরিদ্র মানুষ অর্থনৈতিক প্রতিকূলতায় আরও বেশি নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর একটি অন্যতম ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী। আবার এদের মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থায় রয়েছে নারী শ্রমজীবীরা। সাধারণভাবে এরা পুরুষের তুলনায় মজুরি কম পায়। আবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী হওয়ার কারণে সাংসারিক কাজের দায়ভার এককভাবে তার ওপরই বর্তায়। এদের কাজের সুযোগও থাকে অনেক কম। ফলে অর্থনৈতিক মন্দার সময় তাদের কাজের সুযোগ আরও সংকুচিত হয় এমনকি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

এ বিষয়টি আরো মূর্তমান হয়ে উঠেছে তথাকথিত বিশ্বায়ন বা মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে। এর ফলে বাংলাদেশের মতো ঋণগ্রস্ত দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে শিল্প খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্প-বাণিজ্য, কল-কারখানা, ব্যবসা, সেবা ইত্যাদি খাতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়া এবং প্রতিযোগিতা ও উন্নতসেবার নামে এসব জনগুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলোর বাণিজ্যিকীকরণ দরিদ্র জনসাধারণের জীবন ও জীবিকার মূল ভিত্তিকে নষ্ট করে দিয়ে করপোরেট বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় পুঁজির কাছে আত্মসমর্পণের ফলে জনদুর্ভোগ ও দারিদ্র্যায়ন প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

আবার সরকারি পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অপ্রতুলতা এবং দারিদ্র্য বিমোচনের দীর্ঘস্থায়ী ও পরিকল্পিত কর্মসূচির অভাব দারিদ্র্যায়ন প্রক্রিয়াকে দ্রম্নততর করতে ভূমিকা রাখছে। এ দেশে অন্তত বলা যায়, এ দারিদ্র্যায়ন ঠেকাতে বিভিন্ন এনজিও দেশের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ দিয়ে এনজিওর অর্থবিত্ত বাড়লেও দরিদ্রের হার কমছে না। মনে রাখা প্রয়োজন, এনজিওর ঘূর্ণায়মান তহবিলের মালিকানায় দরিদ্র মানুষের কোনো অংশীদারিত্ব নেই। মজার ব্যাপার হলো দরিদ্র মানুষের সঞ্চয়ের টাকা দিয়েও এনজিওরা দরিদ্র মানুষকে ঋণ দিয়ে 'সেবা' করছে। দরিদ্র মানুষের নানাবিধ কারণে টাকার প্রয়োজন- যা তাদের কাছে নেই। আর এই 'প্রয়োজন' মেটানোর মহান উদ্দেশ্য নিয়ে তারা দরিদ্র মানুষের উন্নতির জন্য 'পাশে' দাঁড়িয়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠার আগে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষের শ্রমের বিনিয়োগ ঘটেছিল উৎপাদন ও জীবন অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে। ক্রমেই শিল্পকেন্দ্রিক অর্থনীতির গতিবৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশের শ্রম কাঠামো ও সামাজিক স্তরবিন্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে- যা প্রচলিত শ্রমবিভাজনের ধারাকে বদলে দিয়ে তৈরি করে নতুন মেরুকরণ; নগর হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আশ্রয়।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ১৯৯৩ সালে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে : অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে উৎপাদন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে এমনভাবে চলে যেখানে সাংগঠনিক কাঠামোর বাহুল্য নেই বললেই চলে, আর সেই সঙ্গে শ্রম ও পুঁজির দ্বৈরথ খুঁজে পাওয়া ভার এবং শ্রমিকের নিয়োগ বহুলাংশে কোনো চুক্তির মাধ্যমে বা আনুষ্ঠানিকভাবে হয় না। বরং ব্যক্তিগত বা পরিবার কিংবা সামাজিক সম্পর্ক বলয়ের ভিত্তিতে এ ধরনের শ্রম ও শ্রমিকের অবস্থান।

পারিবারিক উদ্যোগের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের যে স্থাবর সম্পত্তি তা উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত, কোনো প্রতিষ্ঠানের নয়, এখানে যে কোনো ধরনের বিনিয়োগ কিংবা লেনদেন সবই উদ্যোক্তার নামে হয়ে থাকে। কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কিংবা উদ্যোক্তার আয়-ব্যয়ের পৃথকীকরণ দুরূহ ব্যাপার। সুতরাং (জাতিসংঘের জাতীয় আয় নিরুপণের প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত) কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা আমরা সোজা ভাষায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত বলতে যা বুঝি, খানাভিত্তিক বা কোনো ধরনের নিবন্ধন ছাড়াই খানা দ্বারা পরিচালিত এক বা একাধিক উদ্যোগ; এগুলো স্বনিয়োজিত উদ্যোগ হিসেবে এককভাবে কিংবা যৌথভাবে একই পরিবারের সদস্য কিংবা একাধিক পরিবারের সদস্য দ্বারা পরিচালিত হয়; এ উদ্যোগে নিয়োগ সবসময় খন্ডকালীন হয়ে থাকে এবং এর শ্রমিক দেশের শ্রম আইনের এবং বিদ্যমান ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা আইনের বাইরে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষ।

\হনারীর অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ খাতের নারী শ্রমিকদের জন্য জেন্ডারবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। স্বনিয়োজিত নারীদের জন্য তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত করা ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন- যাতে তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে ব্যবসা করে টিকে থাকতে পারে। শহরের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারী শ্রমিকের জন্য বিশেষ করে হকারদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বল্পমূল্যে স্থায়ী জায়গা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। যাতে তারা অবাধে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। স্বনিয়োজিত নারীদের জন্য স্বল্পকালীন কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন যাতে তারা পুঁজি সংগ্রহের ঝুঁকি ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। তাদের সমবায়ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে- যাতে তারা সম্মিলিতভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে।

শ্রমিকদের রেজিস্ট্রেশন ও আইডি কার্ডের আওতায় আনা প্রয়োজন যাতে তারা রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আসতে পারে। তা ছাড়া, নারী শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের নূ্যনতম মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা এবং নগরকেন্দ্রিক শ্রমিকদের স্বল্প আয়ের বাসস্থান, পানি, বিদু্যৎ, গ্যাসসহ সব ধরনের নগর সেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক সংগঠিত হয়ে নিজস্ব সংগঠন তৈরি এবং সরকারি ও বেসকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেটওয়ার্ক তৈরি করা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় যেমন- স্বাস্থ্যগত ও পেনশন বিমা, দরিদ্রের ব্যাংক চালু করা যেতে পারে। ট্রেড ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের জন্য সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা থাকতে হবে এবং এ খাতের উন্নয়নের জন্য জাতীয় বাজেটে প্রতি বছর বরাদ্দ করা উচিত।

\হলেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<61256 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1