মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
জয়ীতা রওশনা মাহমুদ

গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নারী শিক্ষায় নিবেদিত প্রাণ

সিংড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ ও সহায়তায় উন্নত জাতের গমবীজ সংগ্রহ করে আবাদ করে বীজ হিসেবে কাটাই, মাড়াই, ঝাড়াই ও ড্রামে সংরক্ষণ করে বিক্রি করেন। ১৯৮৭-৮৮ সালে ক্রয় করা ধান দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি করেন। আয় থেকে স্বামীর পড়ার খরচ জুগিয়েছেন। স্ত্রীর আয়ে পড়েছেন স্বামী লতিফ আল মাহমুদ। এক দশকের উদয়-অস্তে নিরলস পরিশ্রমী রওশনা মাহমুদ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। গ্রামের মানুষ তাকে শূন্য থেকে স্বাবলম্বী নারী হিসেবে চিনে।
নতুনধারা
  ১৯ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

মোহাম্মদ অংকন

রওশনা মাহমুদ অর্থনৈতিকভাবে শূন্য থেকে স্বাবলম্বী, নারীশিক্ষা ও নারী উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ এক কর্মী। তার সাফল্যের পেছনে রয়েছে দৃঢ় মনোবল ও কঠোর পরিশ্রম। তার সঙ্গে একান্ত আলাপে ওঠে আসে তার সংগ্রামী ও পরিশ্রমী জীবনের নানা গল্প।

সময়কাল ১৯৭৫ সাল। বয়স আনুমানিক ১৩-১৪ বছর। এ সময় পিতামাতার স্নেহ, আদর সোহাগে বড় হওয়ার কথা। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে পিতামাতা দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা হয়ে যান। শুরু হয় পিতৃমাতৃহীন হয়ে মনঃকষ্ট ভোগ করার যাতনা। দিন কাটলেও রাত কাটতে চায় না। পিতামাতার জন্য মন কাঁদে সবসময়। কত রাত কেটে যায় অঝোরে কেঁদে কেঁদে তার হিসাব রওশনা মাহমুদ রাখতে পারেনি।

পারিবারিক কষ্টকে বুকে পুষে এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। হাত খরচের টাকা কে দিবে তাকে? এই ভাবনা থেকে শুরু করেন হাঁস, মুরগি পালন। বছর শেষে হাঁস, মুরগির সংখ্যা বেড়ে যায়। বিক্রি করে টাকা জমে। টাকা হাতে না রেখে কিনেন একটি ছাগল ও দুই জোড়া কবুতর। বছর পেরিয়ে ছাগল ও কবুতরের বাচ্চা বিক্রি করে নিজের খরচ বাদে বেশ কিছু টাকা হাতে জমে রওশনা মাহমুদের।

অগ্রহায়ণের এক বিকেলে প্রতিবেশী বলে, 'কিছু টাকা ধার দাও। হাটে ধান বেচে দেব।' রওশনা মাহমুদ বলেন, 'ধান বিক্রি করে টাকা দিবেন, আমিই ধান কিনে নেব।' যে কথা সেই কাজ। ধানের রং লালচে, কালচে। কিন্তু ভেতরে চালের রং ভালো আছে। রওশনা মাহমুদ সিদ্ধান্ত নেন, ধান কিনে এনে ভিজিয়ে সিদ্ধ করে চাল বানানো হবে। ৩ মণ ধান থেকে ২ মণ চাল হয়। চৈত্র মাসে বিক্রি করলে দ্গিুণ লাভ হবে। প্রথমে ৩ মণ পরবর্তী মৌসুমে ৫ মণ ধান কিনে চাল বানান তিনি। খারাপ ধান কিনে চাউল বানানোর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার যাত্রা শুরু হয় গ্রাম্য এই নারীর।

ধান থেকে চাল বানানোর পাশাপাশি রওশনা মাহমুদ চিনা কিনে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে চিনার বীজ বিক্রি করে বেশ টাকা আয় করেন। ১৯৭৯ সালে রওশনা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। স্বামীর সহায়তায় ১০০-১৫০ মণ পর্যন্ত ধান কিনে চাল বানিয়ে গোলাজাত করে বিক্রি শুরু করেন রওশনা মাহমুদ।

সিংড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ ও সহায়তায় উন্নত জাতের গমবীজ সংগ্রহ করে আবাদ করে বীজ হিসেবে কাটাই, মাড়াই, ঝাড়াই ও ড্রামে সংরক্ষণ করে বিক্রি করেন। ১৯৮৭-৮৮ সালে ক্রয় করা ধান দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি করেন। আয় থেকে স্বামীর পড়ার খরচ জুগিয়েছেন। স্ত্রীর আয়ে পড়েছেন স্বামী লতিফ আল মাহমুদ।

এক দশকের উদয়-অস্তে নিরলস পরিশ্রমী রওশনা মাহমুদ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। গ্রামের মানুষ তাকে শূন্য থেকে স্বাবলম্বী নারী হিসেবে চিনে। আমি শুনে বিস্মিত হয়েছি সেদিন, সবাই বসবাসের ঘর করে। আর রওশনা ব্যবসার প্রয়োজনে বসবাসের ঘরের আগে গোলাঘর নির্মাণ করেন। গোলাঘরটি এখনও আছে। অতঃপর রওশনা বাড়ি নির্মাণের ভিটে কিনেন। গ্রামে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইটের ঘর, পাকা উঠোন, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, গোসলখানা, ট্যাংকি থেকে পানি সরবরাহ সুবিধা সংবলিত বাড়ি নির্মাণ করেন। সামাজিক সচেতনার জন্য দেয়ালে লেখা হয় ছড়ায় ছন্দে ফলদ, ভেষজ, তাল, সুপারি গাছ লাগান, বিষমুক্ত শাক-সবজি চাষ, পরিবার পরিকল্পনা, শিশুর টীকাদান, ৫-৬ বছর বয়সী শিশু স্কুলগামীকরণ, ঝরেপড়া প্রতিরোধ, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, হাঁস, মুরগি, গরু-ছাগলের টীকাদানসহ নানা বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনামূলক স্স্নোগান। পথচারীরা রওশনা মাহমুদের বাড়ির এমন দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করেন।

নিজের ভাগ্য উন্নয়নের পর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রওশনা মাহমুদ সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের মাতৃকেন্দ্র কর্মসূচিতে কালীনগর মাতৃকেন্দ্রের সম্পাদিকা হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮৮ সাল থেকে ৫ বছর সম্পাদিকা কাজে সম্পৃক্ত থেকে পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন স্বাস্থ্য, কিশোরী স্বাস্থ্য, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সিংড়া কার্যালয় থেকে তার বাড়িতে স্যাটেলাইট ক্লিনিক পরিচালিত হয়, অসংখ্য মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে উপকৃত হন।

২০০০ সালে এই স্যাটেলাইট ক্লিনিকের পথ বেয়ে স্থাপিত হয় 'কালীনগর কমিউনিটি ক্লিনিক'। কমিউনিটি ক্লিনিকের জমি রেজি. সংক্রান্ত কাজে তিনি অর্থায়ন করেন। শিক্ষা বিস্তারে রওশনা মাহমুদ অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯৯ সালে রওশনা মাহমুদ নারীকে স্বাবলম্বী করার দৃঢ় প্রত্যয় ও সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদ-আল জব্বার ও জীবন কুমার চৌধুরীর সহায়তায় কালীনগর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে মহিলা প্রার্থী থেকে নিয়োগ পান। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নারীর নিয়োগের দৃষ্টান্ত তার গ্রামে ছাড়া অন্য গ্রামে দ্বিতীয়টি নাটোর জেলায় পেয়েছেন বলে জানা নেই।

নিজের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি রওশনা মাহমুদ কাজ করেছেন গ্রামের অনগ্রসর নারীদের ভাগ্য উন্নয়নের ও শিক্ষা বিস্তারে। গ্রামীণ মহিলাদের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের জন্য কাঁধে তুলে নেন সামান্য সম্মানীর বিনিময়ে সমাজসেবা দপ্তরের কালীনগর মাতৃকেন্দ্রের সম্পাদিকার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি মেয়েদের অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে সরঞ্জাম সংগ্রহ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিতরণ করেছেন।

সিংড়া উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির আওতায় নিজের গ্রামে সমিতি গড়ে তুলে ম্যানেজারি করেছেন। ম্যানেজারির দায়িত্ব পালনকালে রওশনা মাহমুদ সমিতির সদস্যাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সঞ্চয় সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় সমিতিতে জমা দিয়ে এসেছেন। এ কাজে তিনি মাত্র ১৫ টাকা যাতায়াত ভাতা পেয়েছেন। এই টাকায় তার গ্রাম কালীনগর থেকে সিংড়ায় নৌকা ভাড়া বাবদ লেগেছে। সকালে বাড়ি থেকে খেয়ে গিয়েছেন আবার বিকেলে বাড়ি এসে খেয়েছেন। এভাবেই নারীর ভাগ্য উন্নয়নের নিবেদিত প্রাণ রওশনা মাহমুদ নিরলসভাবে কাজ করেছেন নীরবে নিভৃতে। কাউকে তার কাজ কর্মের কথা বলতে চাননি। প্রচার বিমুখ, নিভৃতচারিণী সিংড়া এলাকার চলনবিলাঞ্চলের কালীনগর গ্রামের রওশনা মাহমুদ জানালেন তিনি অসচ্ছল ছিলেন। যেভাবে সচ্ছল হয়েছেন, গ্রামের সবাই তার মতো সচ্ছল হোক এটাই চান তিনি।

একইভাবে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে কালীনগর কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনে জমি রেজিস্ট্রিকরণে রওশনা মাহমুদ বিনিয়োগ করেছেন। এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল হলে দূর-দূরান্তের কলেজের পরিবর্তে নিকটবর্তী কলেজে ভর্তি, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে, প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নারীর নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন থাকার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরামর্শ দেন। গ্রামের মহিলারা যে কোনো পরামর্শের জন্য রওশনা মাহমুদের কাছে ছুটে আসেন। রওশনা মাহমুদ নারী জাগরণের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়ার আদর্শের সৈনিক। ২০১৮ সালে পেয়েছেন 'জয়ীতা অন্বেষণ' পুরস্কার। এভাবেই আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান বলেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

\হলেখক: কলামিস্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<62866 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1