শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হার মানার পাত্রী নন রুবিনা

নাটোর মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর রুবিনাকে দিয়েছে জয়িতা পদক, ইউনিলিভার 'তোমার স্বপ্ন কর সত্যি' ক্যাটাগরিতে দুই লাখ টাকার প্রাইজমানি। আর সবচেয়ে সম্মানজনক হিসেবে ২০১৮-তে ঢাকার খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের আয়োজনে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের কাছ থেকে 'কৃষি উন্নয়নে নারী' পদক পেয়েছেন রুবিনা
নতুনধারা
  ০৫ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

হাঁস-মুরগি, মাছ আর কৃষি উদ্যান তৈরি করে সফলতা পেয়েছেন নাটোরের শিক্ষিত ও মার্জিত নারী উদ্যোক্তা রুবিনা। মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের সফলতায় তার মিলেছে একাধিক স্বীকৃতি। রুবিনা এখন নারী উদ্যোক্তার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করছেন।

অভাব-অনটনের সংসারে বাবার মৃতু্য আর বিয়ের পর নিজের সংসার ভেঙে গেলেও ভেঙে পড়েননি রুবাইয়া রহমান রুবিনা। নাটোর সদরের চাঁদপুর গ্রামে বাবার অবর্তমানে মা আর ছোট ভাই-বোনের সংসারের হাল ধরেন রুবিনা। সেলাই করে সংগৃহীত অর্থ এবং অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের ঋণে বাড়ির আঙিনায় শুরু করেন ৫০০ বাচ্চা নিয়ে ব্রয়লার মুরগির খামার। সেখানেও দুর্ভাগ্য। মুরগি বিক্রি করে মিলেছে লোকসান।

কিন্তু হার মানার পাত্রী নন রুবিনা। তার ভাষায়, ব্যবসায়ের লোকসানের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মুনাফা। নতুন উদ্যোমে শুরু করেন খামারের কার্যক্রম। শুধু মুরগির খামারই নয়, বাড়ি সংলগ্ন নিজেদের পুকুরে শুরু করেন মাছ চাষ, সঙ্গে ৩০০ হাঁসের সমন্বয়ে খামার।

অসুস্থতা নিয়েও অফুরান জীবনীশক্তির অধিকারী রুবিনা। প্রায় একই সঙ্গে মাছ আর হাঁস-মুরগির খামারের পাশাপাশি কৃষিও শুরু করেন তিনি। পর্যায়ক্রমে জমি ইজারা নিয়ে ফলের ছয়টি বাগান তৈরি করেছেন রুবিনা। এসব বাগানে ফলছে আম, লেবু, পেয়ারা, কলা, কুল আর পেঁপে; রয়েছে মরিচ। আমের তালিকায় আছে অপ্রচলিত ও আদরনীয় গৌরমতি, ব্যানানা ম্যাঙ্গোর মত আম। নাটোর হর্টিকালচার সেন্টার ড্রাগন ফলের ৪০টি খুঁটিতে ১২০টি ড্রাগনের প্রদর্শনী খামার স্থাপন করে দিয়েছে রুবিনাকে। ফুল আসা ড্রাগনের বাগানে চলতি বছরেই ফল পাওয়া যাবে। ড্রাগনের বাগানে সাথী ফসল হিসেবে রুবিনা চাষ করেছেন মৌসুমী সবজি।

সব উপকরণের কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে রুবিনা প্রমাণ করেছেন- কোনো কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। মুরগির বিষ্ঠা দিয়ে তৈরি করছেন উৎকৃষ্ট জৈব সার-রিং কম্পোস্ট- প্রতি মাসে যার বিক্রয় মূল্য অন্তত তিন হাজার টাকা। পাশেই উৎপাদন করছেন আর একটি জৈব সার- ভার্মি কম্পোস্ট। বাড়ির শোভা বাড়িয়ে রেখেছে একঝাঁক কবুতর। এর বাণিজ্যিক মূল্যও কম নয়।

রুবিনার বিশাল এই কর্মযজ্ঞে সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছেন ছোট ভাই রুবেল আর পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স শেষ বর্ষে পড়ুয়া ছোট বোন রিমি। সঙ্গে দুজন নিয়মিত কর্ম শ্রমিকসহ প্রতিদিন আরও গড়ে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করে।

রুবিনার কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতি দিয়েছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর। তাদের আঙিনায় আইপিএম স্কুল পরিচালনা করে এলাকার ২৫ পরিবারের ৫০ সদস্যকে হাঁস-মুরগি পালন, গরু মোটাতাজাকরণ, সবজি চাষ, বসতবাড়ির বাগান ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা দিয়েছে নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। রুবিনার নেতৃত্বে গঠিত চাঁদপুর নারী উন্নয়ন সমবায় সমিতির ৫০ সদস্য প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেকেই সমবায় বিভাগ থেকে মাত্র দুই শতাংশ সার্ভিস চার্জে গাভী পালনের ঋণ পাচ্ছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করে। ১০০ সদস্যের অন্যরা পর্যায়ক্রমে ঋণের অপেক্ষায় আছেন। রুবিনার গাভী খামার খুব শিগগিরই উৎপাদনে আসবে। সবার উৎপাদন নিয়ে এই এলাকায় গড়ে তুলতে চান মিল্ক ভিটা বা প্রাণের দুগ্ধ ক্রয় কেন্দ্র।

রুবিনাকে সভানেত্রী করে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের নিবন্ধনে গঠিত ইয়ুথ উইম্যান ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি সেলাই কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। রুবিনাকে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে সমাজসেবা ও প্রাণী সম্পদ বিভাগ।

নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের অধীন 'বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রুবিনাকে কমিউনিটি হর্টিকালচার প্রভাইডার মনোনীত করা হয়েছে। মাসে তিন হাজার টাকা সম্মানী ভাতায় কৃষিতে উদ্যোক্তা সৃষ্টির কাজ করছেন রুবিনা। এলাকার আট শতাধিক ব্যক্তিকে হর্টিকালচার সেন্টারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়াও প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রশিক্ষণ শেষে হর্টিকালচার সেন্টারের গাছ, সার আর উপকরণ সহায়তায় গড়ে উঠেছে ৫০টি ফলের বাগান আর ৩৫টি বাড়ির বাগান। ইতোমধ্যে তার হাতে তৈরি নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে সফল হয়েছেন হেনা বেগম, শাকিলাসহ বেশ কজন। হেনা বেগম বলেন, আমাদের নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে রুবিনা।

রুবিনা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে গত বছর নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কসহ গ্রামীণ সড়কের দুই কিলোমিটারে তালের গাছ লাগিয়েছেন। এবার নারকেলের চারা রোপণের পরিকল্পনা করেছেন।

নাটোর মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর রুবিনাকে দিয়েছে জয়িতা পদক, ইউনিলিভার 'তোমার স্বপ্ন কর সত্যি' ক্যাটাগরিতে দুই লাখ টাকার প্রাইজমানি। আর সবচেয়ে সম্মানজনক হিসেবে ২০১৮-তে ঢাকার খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের আয়োজনে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের কাছ থেকে 'কৃষি উন্নয়নে নারী' পদক পেয়েছেন রুবিনা।

রুবিনা বলেন, আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। আমার পথ চলা স্বার্থক হবে যদি আমি সমাজের অবহেলিত নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সফল হই। আমাদের এলাকায় কৃষির মাধ্যমে সবুজ বিপস্নব এবং গাভীর মাধ্যমে শ্বেত বিপস্নব ঘটাতে চাই। ইনশালস্নাহ আমি সফল হবো।

নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক স ম মেফতাহুল বারি বলেন, রুবিনাকে কমিউনিটি হর্টিকালচার প্রভাইডার মনোনীত করার পর সে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তা বিশেষত নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে ইতোমধ্যে সে সফলতা পেয়েছে।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক এসএস কামরুজ্জামান বলেন, রুবিনার মেধা আর কৃষি বিভাগের প্রয়োজনীয় সমর্থন ও সহযোগিতায় রুবিনা এখন সফল উদ্যোক্তা। সারা দেশে রুবিনার মতো উদ্যোক্তা তৈরি হলে দেশ হবে সমৃদ্ধ।

য় নন্দিনী ডেস্ক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<69596 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1