বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সচেতন হোন, স্তন ক্যান্সারকে না বলুন

নতুনধারা
  ১২ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

ডা. তানজিনা আল্‌-মিজান

আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা অক্টোবর মাস স্তন ক্যান্সার সচেতনতার মাস। বর্তমান এই ডিজিটাল যুগে, যেখানে ব্যস্ততা আর ছুটে চলা সারাক্ষণই মানুষকে তাড়া করে ফেরে সেখানে একান্ত নিজের জন্য কিছু সময় বের করা খুবই কঠিন। কাজেই এই মাসটির গুরুত্ব কিন্তু অনেক বেশি। কারণ গোটা বিশ্ব অক্টোবর মাসকে ব্রেস্ট বা স্তন ক্যান্সার সচেতনতার মাস হিসেবে পালন করে।

পৃথিবীর সব মরণব্যাধির মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার বেশি মারাত্মক। সারাবিশ্বে ক্যান্সারজনিত কারণে মৃতু্যর মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সারের স্থান দ্বিতীয়। প্রতি ৮ জন মহিলার মধ্যে একজনের ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে এবং আক্রান্ত প্রতি ৬ জনের মধ্যে একজন মহিলা মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়তে পারেন। ভাবতেও অবাক লাগে, প্রতি ৬ মিনিটে একজন নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রতি ১৩ মিনিটে আক্রান্ত ক্যান্সার নারীর একজন মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ব্রেস্ট ক্যান্সার শব্দ দুটো শুনলেই মনের মধ্যে একরাশ উৎকণ্ঠা ভিড় করে। তবে আধুনিক চিকিৎসার কল্যাণে এই মরণব্যাধিকে এবং এর ভীতিকে জয় করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু একটু সচেতনতার। এই একটু সচেতনতার অভাবেই স্তন ক্যান্সার বিষয়টি আমাদের সমাজে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। লজ্জা, ভয় আর সহযোগিতার অভাবে রোগীরা অনেক দেরিতে ডাক্তারের কাছে যায়। যার ফলে ক্যান্সার মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং আয়ুষ্কাল অনেক কমে আসে।

সব স্তরের নারী এবং একই সঙ্গে পুরুষকেও স্তন ক্যান্সারের বিষয়ে সচেতন করার জন্যই অক্টোবর মাসকে পুরো বিশ্বব্যাপী স্তন ক্যান্সার সচেতনতার মাস হিসেবে উদযাপন করা হয়।

ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ অনেকাংশেই জিনগত। তবে জিনের কারসাজি ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক প্রভাবও ব্রেস্ট ক্যান্সারের সম্ভাবনা অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলার জন্য দায়ী হতে পারে। এগুলোর মধ্যে ওবেসিটি, অত্যাধিক অ্যালকোহল সেবন যেমন- ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে তেমনি প্রথম সন্তান অনেক দেরিতে হলে এবং লেট ব্রেস্ট ফিডিং অথবা একেবারেই ব্রেস্ট ফিডিং না করালেও এই রোগের ঝ্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌ু্‌্‌্‌ঁকি বেড়ে যায়। অনেকক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেনরিপ্লেসমেন্ট থেরাপিও ব্রেস্ট ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হতে পারে। সাধারণত ইজঈঅ১,ও ইজঈঅ২ এই জিন দুটো ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝ্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌ু্‌্‌্‌ঁকি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়।

আমাদের দেশে সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়সের মহিলাদের এই অসুখের সম্ভাবনা বেশি। কম বয়সীদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার খুব কমন না হলেও, এই অসুখে অনেকেই আক্রান্ত হয়। আজকাল কিন্তু ২০-২৫ বছর বয়সেও ব্রেস্ট ক্যান্সার হচ্ছে। কম বয়সে এই রোগ হলে বেশির ভাগই জিনগত কারণে হয়। ব্রেস্ট ক্যান্সার অনেক ক্ষেত্রেই ধরা পড়তে খুব দেরি হয়ে যায়। সে জন্য এই অসুখ সম্পর্কে সচেতন থাকা খুব প্রয়োজন। আর এই সচেতনতার প্রথম ধাপ শুরু হয় একেবারে নিজের ঘরের ভিতর থেকে। বয়স ২০ বছর হলেই সেলফ ব্রেস্ট এগজামিনেশন করা শুরু করতে হবে। অর্থাৎ নিজেই নিজে পরীক্ষা। এজন্য পরিবারের সবারই এই বিষয়টির প্রতি ধারণা থাকতে হবে। যাতে ২০ বছরের মেয়ে থেকে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মহিলা সবাই নিরাপদ থাকতে পারেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খেয়াল করতে হবে দুটো স্তনই সমান ও স্বাভাবিক আছে কিনা? অস্বাভাবিক কোনোকিছু চোখে পড়লেই অর্থাৎ কোনো শক্ত চাকা বা গোটা দেখা যাচ্ছে কিনা বা হাত দিয়ে অনুভব করা যাচ্ছে কিনা? ব্যথাযুক্ত নাকি ব্যথাবিহীন? নিপল দিয়ে কোনো তরলজাতীয় বের হচ্ছে কিনা?

স্তন ক্যান্সারের প্রথম লক্ষণই ব্যথাবিহীন চাকা বা লাম্প। সব ব্রেস্ট লাম্পই কিন্তু ক্যান্সার নয়। যদি সেলফ এগজামিনেশনের সময় কোনো শক্ত গোটা বা লাম্প অনুভূত হয় আর সেটা যদি ব্যথামুক্ত হয় তাহলে কোনো দেরি না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতেই হবে। প্রাথমিক অবস্থায় এটাই মূল লক্ষণ। এর মধ্যে নিপল ভেতরে ঢুকে যাওয়া, ব্রেস্টের উপরের চামড়ার রং পরিবর্তন, চামড়া কুঁচকে যাওয়া, নিপল দিয়ে কোনো তরল নিঃসরণ হওয়া এবং সেই সঙ্গে বগলে চাকা বা ব্যথাও কিন্তু ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণগুলো। তবে ক্যান্সার যদি গুরুতর আকার ধারণ করে এবং দেরিতে ডায়াগনসিস হয় তাহলে কিন্তু শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে। এবং সেই ছড়িয়ে পড়া জায়গাতেও লক্ষণ দেখা দেবে।

কাজেই ২৫ বছর বয়স হলেই বছরে একবার কোনো লক্ষণ ছাড়াই পরীক্ষা করাতে পারলে খুব ভালো। যাদের পরিবারে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ইতিহাস আছে তাদের কিন্তু আগে থেকেই চেকআপ করাতে হবে। পরিবারের যিনি সবচেয়ে কম বয়সে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন তার চেয়ে কম করে হলেও ১০ বছর আগে থেকেই শুরু করতে হবে চেকআপ। যাদের পারিবারিক ইতিহাস নাই তাদের বয়স ৪০ পার হলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বছরে একবার হলেও ম্যামোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফি করতে হবে। কোনো লক্ষণ ধরা পড়লে ডাক্তারের উপদেশ মতো এমআরআই, সিটি স্ক্যান এবং বায়োপসি করারও প্রয়োজন পড়তে পারে। টিউমারের সাইজের উপরে এর চিকিৎসা নির্ভর করে। এখানে সার্জারি করে রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি দেয়া হয়। কখনো কখনো সার্জারির আগেই কেমোথেরাপি দিয়ে টিউমারের সাইজ ছোট করে নেয়া হয় এবং পরে সার্জারি করে আবার রেডিও ও কেমোথেরাপি দেয়া হয়। পুরো চিকিৎসাই অসুখের স্টেজিংয়ের উপরে নির্ভর করে।

ব্রেস্ট ক্যান্সার আলাদা করে প্রতিরোধ করা যায় না যেহেতু এই রোগের কারণ অনেকাংশেই জিনগত। তবে ভালো স্বাস্থ্য ধরে রাখা অর্থাৎ সুস্থ জীবনযাপন করা খুবই জরুরি। ওবেসিটি কমাতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, সঠিক সময় সন্তান ধারণ এবং একেবারে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং যাকে বলে সেটাই করাতে হবে। অ্যালকোহল পরিহার করতে হবে অবশ্যই। খুব প্রয়োজন না হলে হরমোন রিপেস্নসমেন্ট থেরাপিনা করাই ভালো। এই নিয়মগুলো মেনে চললে আর নিয়মিত সেলফ ব্রেস্ট এগজামিনেশন করলে ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে অনেকাংশেই দূরে থাকা সম্ভব হবে আশা করা যায়। আর কোনো সন্দেহ মনে হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রথম ধাপে ধরা পড়লে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সেরে ওঠা সম্ভব। এরপর পরবর্তী স্টেজ অনুযায়ী রোগীর সেরে ওঠা নির্ভর করে। চিকিৎসার পরও ব্রেস্ট ক্যান্সার ফিরে আসতে পারে। তাই রোগীকে নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে।

আমাদের শরীর কিন্তু আমাদের কাছে সঠিক সময় সুচিকিৎসার অধিকার রাখে এবং তার দাবিদার। তাই সব লজ্জা, ভয়ভীতি এবং সব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে কোনো কিছুকে গোপন না করে নিজের শরীরের জন্য যা কিছু ভালো সেগুলো করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করা যাবে না। এই ভয়াবহ রোগ থেকে বাঁচতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। তাই আসুন আমরা নিজে সচেতন হই এবং আমরা অন্তত ১০ জনকে সচেতন করে তুলি। তবেই আমরা পাবো একটি সুখী ও সুস্থ জীবন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<70671 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1