শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন পুরুষে বাঁধা নারীর জীবন

তবুও ভালো লাগে যুগের সঙ্গে সঙ্গে নারী এগিয়ে যাচ্ছে তা দেখে। পুরুষের ধ্যান-ধারণায়ও আগের চেয়ে পরিবর্তন এসেছে। পুরুষশাসিত সমাজে এতেই বা কম কিসে। আগামীর নারী হয়তো আমার মতো স্বপ্নভাঙা মন নিয়ে বেঁচে থাকবে না। ওরা ঘুরে দাঁড়াবেই
জাকিয়া সুলতানা
  ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

একজন নারী জন্মের পর থাকে বাবার অধীনে। যেখানে তার চাওয়া-পাওয়ার মূল্য খুব একটা দেওয়া হয় না। শাসনে আদরে শিশুকাল-কৈশোরকাল পার হতে না হতেই চলে আসে তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। তাকে চলে যেতে হয় স্বামীর অধীনে। সেখানেও তার মতের বহির্প্রকাশ খুব একটা ঘটে না। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও স্বামীর প্রায় সব কাজকেই মাথা পেতে মেনে নিতে হয় তাকে। এক সময় সেই নারীর বয়স হয়, যিনি এ সংসারে তার সবটুকু উজাড় করে ঢেলে দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেন। বুড়ো বয়সে এসেও যে তার খুব একটা স্বাধীনতা আছে তাও নয়। দেখা যায়, নারী তার ছেলের অধীনে চলে গেলেন। ছেলে যা বলবে অনেক সময় তাই মেনে নিতে হয় তাকে। না হয় সংসারে অশান্তি। কত স্যাক্রিফাইস করবে নারী? তার জন্মটাই কি শুধু মেনে নেওয়ার জন্য? এমনই প্রশ্ন এ সমাজের হাজারো নারীর। কিন্তু এর সঠিক জবাব জানা নেই কারও। তবে যুগ পাল্টাচ্ছে। আগের চেয়ে মেয়েরা অগ্রগামী বটে, তবে আনুপাতিক হারে এখনো সমান সমান নয়।

তেমনই এক নারী মনোয়ারা বেগম। যার চাওয়া-পাওয়ার মূল্য পাননি তার আপনজনের কাছে। পরিচয় বাচ্চাদের কোচিং সেন্টারে। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। ছেলের ঘরের নাতনিকে নিয়ে এসেছেন পড়াতে। এক সময় যে সুন্দরী ছিলেন স্পষ্ট ছাপ তার পুরো শরীরে। কথাবার্তায় তার আভিজাত্যের ছাপ। কথায় কথায় অনেক কথাই হলো। জানলাম তার ভেতরের কিছু ক্ষোভ এবং দুঃখ মেশানো কথা। আর ভাবলাম এমন ঘটনা আসলে আমাদের সমাজের প্রায় প্রতিটি মেয়ের জীবনেই ঘটে।

তিনি বললেন, তার বয়স তখন ১৫ কি ১৬ হবে। বাবার কড়া শাসনে চলছে তার দিন। মাত্র এসএসসি পাস করেছেন। ফলাফলও ভালো। বাবার হুকুম ছাড়া এক পাও নড়ার সাহস তার বা তার পরিবারের কারও ছিল না। কিন্তু কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার তার খুব ইচ্ছা। চুপি চুপি তিনি এইচএসসির বই এনে পড়ছেন। কী স্বপ্ন তার, কলেজে যাবেন, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে নিজে জীবনে স্বাবলম্বী হবেন। নারী বলে নিজেকে পিছিয়ে রাখবেন না। কিন্তু সে আশায় তার গুড়েবালি। বাবার কোনো ইচ্ছাই নেই তাকে পড়ানোর। তার একই কথা, মেয়েদের এর বেশি পড়ালেখার কোনো প্রয়োজন নেই। ভালো পাত্র পেলে বিয়ে দিয়ে দেব। সচ্ছল পরিবারে জন্ম তার। অভাব-অনটন স্পর্শ করেনি তাকে কোনোদিন। আর বাবাও সেই কালের এইচএসসি পাস, তাহলে তার কেন এমন মানসিকতা? বুঝতে পারছেন না মনোয়ারা বেগম। যখন শুনলেন তাকে আর কলেজে পড়ানো হবে না, কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। প্রথমে মাকে ধরে বললেন, মা বাবাকে বুঝিয়ে বলো আমি কলেজে ভর্তি হব। আমি এখন বিয়ে করব না। আমি লেখাপড়া করতে চাই। কিন্তু মাতো বাবার হাতের পুতুল, তার কি এমন সাহস আছে বাবার কথার উপরে কথা বলার। কিছুক্ষণ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না। তারপর বুঝিয়ে বলা, বাবা যা বলেন মেনে নাও। মাকে অনুরোধ করে কাজ হলো না। পরে এক চাচাকে ধরা হলো বাবাকে বোঝানোর জন্য। না, কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। ভালো সম্বন্ধ এসেছে তা তো বাবা হাতছাড়া করবেন না কিছুতেই। একদিন ঠিকই তার বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। বিয়ের আসরে মনোয়ারা বেগম বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কি অনুনয়-বিনয়; বাবা আমাকে বিয়ে দিও না, আমি লেখাপড়া করতে চাই। বাবা আমার অনুরোধটুকু রাখো। কে শোনে কার কথা, তার একই কথা মেয়ে মানুষের পড়ালেখা করে কী হবে। মেয়েদের কাজই হলো বিয়ের পর সংসার আর ছেলেমেয়ে লালন-পালন করা। শেষ পর্যন্ত বাবার কথাই শিরোধার্য। মনোয়ারা বেগম টুকটুকে লাল শাড়ি পরে শ্বশুরবাড়ি গেলেন নিজের মনের বিরুদ্ধে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েটা তাকে সারাটি জীবন কুরে কুরে খেয়েছে। পড়ালেখা করে নিজেকে আর দশজন ছেলের মতো স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন বাবা এক নিমিষেই শেষ করে দিলেন।

তিনি নিজের স্বপ্ন তার মেয়েকে দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিলেন। তার বড় মেয়ে তার মতোই লেখাপড়ায় মনোযোগী এবং মেধাবীও ছিলেন। তা ছাড়া তার নাচ-গান ছবি আঁকাসহ সব গুণই তাকে বিধাতা দিয়ে রেখেছেন। দেখতেও মায়ের মতোই সুন্দরী। মনোয়ারা বেগমের সর্বক্ষণ চাওয়া মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তোলা, আর নিজের লালিত স্বপ্ন পূরণ করা। দেখতে দেখতে মেয়েটি এসএসসি পাস করে ফেলল। যেহেতু মফস্বল শহরে তাদের বাস, তাই সব সুযোগ-সুবিধা হাতের কাছেই ছিল। মেয়েটিও তার মায়ের কপাল নিয়েই জন্মিয়েছে। তার বাবারও তাকে কলেজে পড়ানোর কোনো ইচ্ছা নেই। যত ভালো রেজাল্টই করুক না কেন। এবার আর মনোয়ারা বেগম চুপ করে রইলেন না। প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন স্বামীর সঙ্গে। যদি মেয়েকে কলেজে ভর্তি হতে না দাও তাহলে তোমার সংসার আমি করব না, এ আমার সাফ কথা। মনোয়ারা বেগমের স্বামী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। দীর্ঘ ১৯ বছর সংসার করে যার মুখে সারাক্ষণ সংসারের মঙ্গল কামনাই শুনেছেন। তার কথার ওপর কথা কোনোদিনই বলেনি, সে কেন আজ এমন অলক্ষুণে কথা বলছে? মনোয়ারার স্বামী এবার যেন থমকে গেলেন। তাকে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে তোমার? কেন এমন অগ্নিমূর্তি? মনোয়ারা নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। হাউমাই করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমার বাবা আমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে তোমার সংসার করার জন্য পাঠিয়েছে। এই ১৯টি বছর আমি এক অজানা কষ্ট বুকে চেপে বসে আছি। কিন্তু আমার মেয়েকে আমি আমার মতো কষ্ট পেতে দেব না। আমার স্বপ্ন আমি ওকে দিয়ে পূরণ করাবো। ওকে আমি পড়াশোনা করাবোই। তা আমাকে যাই করতে হোক না কেন। মনোয়ারার কথা শুনে স্বামী বললেন, ঠিক আছে আমি ওকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছি কিন্তু ভালো বিয়ের ঘর পেলে তো হাতছাড়া করব না। যদি পড়াশোনার ইচ্ছা থাকে তো স্বামীর ঘরে গিয়ে করবে। আর আশা করি এমন আবদার তুমি আমাকে করবে না যা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়!

বছর না ঘুরতেই মনোয়ারা বেগমের স্বপ্নের অপমৃতু্য ঘটল। উপযুক্ত সম্বন্ধ পেয়ে হাতছাড়া করলেন না তার স্বামী। জীবনে আরেকটি ধাক্কা খেলেন তিনি। আর নিজেকে মেয়ে বলে অভিশপ্ত ভাবতে লাগলেন। কিন্তু ছেলেটিকে অতিযত্নে লেখাপড়া শেখানো হলো। সে এমএ পাস করে সরকারি চাকরি করছে। তাকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, কারণ সে পুরুষ মানুষ। তার সবকিছু করার অধিকার আছে।

দেখতে দেখতে কয়েকটি বছর পার হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন মনোয়ারার স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেলেন। কয়েক বছর আগে মারা গেলেন তার জীবনের প্রথম পুরুষ বাবা, যিনি তার ইচ্ছের কোনো মূল্যায়নই করেননি। আর এখন মারা গেলেন তার জীবনের দ্বিতীয় পুরুষ স্বামী, তিনিও বাবার মতোই অবমূল্যায়ন করেছেন তার চাওয়া-পাওয়াকে। অবশেষে মনোয়ারা বেগমের শেষ জীবনে এসে তার দেখভালের ভার পড়ল ছেলের হাতে। এখনো তিনি স্বাধীন নন। চাওয়া-পাওয়ার মূল্য ছেলের কাছেও তার নেই। ছেলেটিকে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারলেন না। মায়ের পছন্দকে অবজ্ঞা করে নিজেই বিয়ে করে নিয়ে এলেন নিজের পছন্দের পাত্রীকে। এবার আর তার কিছুই করার নেই। কারণ তিনি আজ বয়স্ক, অসহায়। ছেলের কাছেই তার শেষ ঠিকানা। তাই তিনি নিজের জীবনের তিন পর্বে শিখেছেন, আসলে মেয়েদের স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই। ওরা আসলেই প্রজন্মের পর প্রজন্মে একেকজন পুরুষের হাতের পুতুল। তাই শেষ জীবনে এসে আর কোনো স্বপ্ন দেখেন না তিনি। সব স্বপ্নই তার দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। তবে আক্ষেপ করে বলেন, আমার স্বপ্ন অবশ্যই পূরণ হতো যদি প্রথমেই বাবার অবাধ্য সন্তান হতাম। কারণ এ সমাজে যে সব পুরুষ সমান তা বিশ্বাস করি না। তাই বাবার ইজ্জতের দিকে না তাকিয়ে যদি নিজের জেদের কাছে অটল থাকতাম হয়তো সফল হতাম, যদি স্বামীর আদর্শ স্ত্রী না হয়ে সংসার ত্যাগ করতাম হয়তো সফল হতাম, যদি ছেলেটিকে আদর না করে শুধু শাসনের ভেতর রাখতাম হয়তো সফল হতাম। অথচ একজন নারীর জীবনে এ তিনজন পুরুষই তার সবচেয়ে কাছের এবং এ তিনজনের কাছেই নারী থাকে সবচেয়ে নিরাপত্তায়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি, এ অতি আপন তিনজন পুরুষের কাছেই নারী হয় সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়িত।

তবুও ভালো লাগে যুগের সঙ্গে সঙ্গে নারী এগিয়ে যাচ্ছে তা দেখে। পুরুষের ধ্যান-ধারণায়ও আগের চেয়ে পরিবর্তন এসেছে। পুরুষশাসিত সমাজে এতেই বা কম কিসে। আগামীর নারী হয়তো আমার মতো স্বপ্নভাঙা মন নিয়ে বেঁচে থাকবে না। ওরা ঘুরে দাঁড়াবেই- সেই প্রত্যাশাই আমার।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<74753 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1