মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সহিংসতা দূর করবে সামাজিক সচেতনতা

কন্যাশিশুসহ নারীর প্রতি সহিংসতা কোনোভাবেই কমছে না বরং বাড়ছে। প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ দিবসে ১৬ দিনের কর্মতৎপরতা শুরু হয় এবং শেষ হয় ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে। জাতিসংঘের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই প্রচারাভিযানে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশও অংশগ্রহণ করে।
নতুনধারা
  ২৩ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

শাহীন চৌধুরী ডলি

নারীর প্রতি সহিংসতা যুগে যুগে চলে আসছে। সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগেও নারীদের প্রতি সহিংস আচরণ করা হতো। কন্যাশিশুদের জীবন্ত কবর দেয়া হতো। নারী কেবল ভোগের পণ্য ছিল। বিভিন্ন সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ও মাত্রা ভিন্ন হয়।

নারীর প্রতি সহিংসতা হিসেবে যে কোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত আচরণ নারীর প্রতি সহিংসতা। জাতিসংঘের ডেকলারেশন অন দা ডেকলারেশন অফ ভায়োলেন্স এগেইনেস্ট উইমেন থেকে বলা হয়, 'সহিংসতা হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে নারী ও পুরুষের মধ্যকার ঐতিহাসিক অসম ক্ষমতা সম্পর্কের প্রকাশ।' 'নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে প্রধান সামাজিক কৌশলগুলোর মধ্যে একটি যার দ্বারা নারীদের পুরুষের তুলনায় অধীনস্ত অবস্থানে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়।'

'নারীরা আজ অগ্রসর, চায় সমতা জীবনভর'- কিন্তু অগ্রসর হয়েও নারীরা পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সকল ক্ষেত্রে তাদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা নিপীড়িত, নির্যাতিত হচ্ছে। নারীকে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি নানা ধরনের মানসিক নিগ্রহের শিকার হতে হয়। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি কার্যক্রমে বিভিন্ন পক্ষকে বেশি করে যুক্ত করে একে জোরদার করার বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু আইন ও নীতি থাকাই যথেষ্ট নয়- তা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন।

জেন্ডার-ইকুয়ালিটি কোথাও নেই। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলি, আমাদের সমাজে শিশুকাল থেকেই মেয়েদের মেয়ে এবং ছেলেদের ছেলে হয়ে উঠতে শেখানো হয়। সমাজে শেখানো হয়, ছেলেরা কাঁদবে না, ছেলেরা লজ্জা পাবে না। কান্না মেয়েদের মানায়, লজ্জাই নারীর ভূষণ। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে একদম স্কুলপর্যায়ের পাঠক্রম থেকে নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তা অনেকটা সুফল বয়ে আনবে। যে সব নারী সহিংসতার শিকার তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইনি সেবাদান নিশ্চিত করতে হবে। নারীর চলাফেরা এবং কর্মক্ষেত্রে তার নিরাপত্তার উন্নয়ন জরুরি। নারীর প্রতি চলমান সহিংসতা, নির্যাতন রোধে যে সব চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে সরকারের কাছে তার সবিশেষ গুরুত্ব পাওয়া উচিত।

বর্তমান বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এই উপাত্ত ভয়াবহ। আসলে বিশ্বজুড়েই নারীর সহিংসতা ঘটছে। উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে এর মাত্রা প্রকট। নারীর প্রতি সহিংসতা নারীর মর্যাদাকে হেয় করে। নারী নিজেকে ছোট ভাবতে থাকে এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। দেশের উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান অনস্বীকার্য। নারীর প্রতি চলমান নির্যাতন,সহিংসতা চলতে থাকলে জাতি হিসেবে আমরা কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। নারীর প্রতি নির্যাতন, সহিংসতা বন্ধ করা না গেলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন আশা করা যায় না। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ শুধু নারী ও মেয়েজাতির কল্যাণের জন্য প্রয়োজন ভাবলে কম ভাবা হবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের জন্যও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। নারী-পুরুষের সমতার বিষয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংস্থা ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর উইমেন্স অ্যান্ড চিল্ড্রেনস ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজে। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ (সিডও) সনদে সই ও অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বাজেট নারীবান্ধব হয়। জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন নারী। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সূচকে অবস্থান অষ্টম। এতসব অর্জন সত্ত্বেও মোট নারী জনসংখ্যার মাত্র ৩৬% নারী কর্মশক্তিতে নিয়োজিত। ৭০%-এর বেশি নারী বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে। নারীকে হয়রানি করার জন্য হয়রানিমূলক কাথা, গালি, তিরস্কার করা যায় যা নারীর জন্য চরম অবমাননাকর। নেতিবাচক নানা শব্দ বা গালি প্রয়োগের মাধ্যমে নিগ্রহ করা হয়। ঝগড়া-বিবাদে নারী বিভিন্ন প্রকার সহিংসতার শিকার হয়। ভাষার মাধ্যমে নারীকে হেয় করার যে ধারা তার ফলে নারীর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমে যায়। নারীর মনে সমাজে তার অবস্থান নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়।

সমাজে ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারী নির্যাতনের মতন ক্ষতিকর এবং বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণ অহরহ ঘটছেই। সীমিত বিচারব্যবস্থা, নারীবান্ধব অবকাঠামোর অভাব, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, বিচারের জটিল প্রক্রিয়া, ব্যয়বহুলতা প্রভৃতি কারণে নির্যাতনের শিকার নারীরা বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে সুফল পেতে হলে বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সবার সামগ্রিক উদ্যোগ ও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের প্রতিরোধ কাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে গণ্য করা উচিত। প্রতিটি আইনের পেছনে দর্পণ আছে। সব আইন সম্পর্কেই জানতে হবে। আজকের পৃথিবী অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। নারী নির্যাতন রোধে আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত থাকার বিকল্প নেই। পারিবারিক আইন, পারিবারিক আদালত সম্পর্কে জানতে হবে। বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। নারীপাচার প্রতিরোধ ও দমন করতে হবে। যে কোনো বয়সের নারী ঘরে বাইরে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, যৌন নিপীড়ন রোধে আমাদের সবাকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি মহামান্য হাইকোর্টের যে উত্ত্যক্তকরণ ও ফতোয়া বন্ধ করার জন্য ২০১১ সালে রুল প্রদান করা হয়েছে তা প্রণয়নে এগিয়ে আসতে হবে। ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কার্যক্রমে গতি আনতে হবে।

প্রতিটি কন্যাশিশু এবং নারীকে মূল্যায়ন করার মাধ্যমে পরিবারে ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শুধু একজন সুস্থ মা-ই একজন সুস্থ ভবিষ্যৎ নাগরিকের জন্ম দিতে পারে কথাটি মনে রাখা আবশ্যক। নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং সমাজের সব ক্ষেত্রে বেশি বেশি সক্রিয় অংশগ্রহণে ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীকে সর্বপ্রথমে শিক্ষিত হতে হবে, বিভিন্ন শারীরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নিজেকে তৎপর হতে হবে। নিজের অধিকার আদায়ে নারীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই। অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়। নারীর প্রতি চলমান নিপীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে জেগে উঠুক সব নারী-পুরুষ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<76633 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1