শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারীশ্রমিক

মাজহারুল ইসলাম
  ১৩ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০
অথৈর্নতিক মন্দার সময় নারীদের কাজের সুযোগ সংকুচিত হয়ে যায়, এমনকি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়

দরিদ্র মানুষের কাছে তার পরিবেশ, পারিপাশ্বির্কতা, সামাজিক অবস্থান সব কিছুই বৈরী। তাকে প্রতিদিন শত প্রতিবন্ধকতা ও বাধাবিপত্তির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। অভাবের কারণে আমাদের দেশের প্রথাগত পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনও দরিদ্র মানুষের কাছে শিথিল হয়ে যায়। এই প্রতিক‚লতা ও অনিশ্চয়তা অথৈর্নতিক অবস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে কোনো বড় ধরনের অথৈর্নতিক মন্দায় কিংবা প্রাকৃতিক বিপযের্য় শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাভোগীরা ঠিকই নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তারা প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে আরও বেশি সুযোগ গ্রহণ করে কিন্তু দরিদ্র মানুষ অথৈর্নতিক প্রতিক‚লতায় আরও বেশি নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। অথৈর্নতিকভাবে অসচ্ছল এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর একটি অন্যতম ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী। আবার এদের মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থায় রয়েছে নারীশ্রমজীবীরা। সাধারণভাবে এরা পুরুষের তুলনায় মজুরি কম পায়। আবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী হওয়ার কারণে সাংসারিক কাজের দায়ভার এককভাবে তার ওপরই বতার্য়। এদের কাজের সুযোগও থাকে অনেক কম। ফলে অথৈর্নতিক মন্দার সময় তাদের কাজের সুযোগ আরও সংকুচিত হয় এমনকি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

এ বিষয়টি আরো মূতর্মান হয়ে উঠেছে তথাকথিত বিশ্বায়ন বা মুক্তবাজার অথর্নীতির যুগে। এর ফলে বাংলাদেশের মতো ঋণগ্রস্ত দেশের অথর্নীতি বিশেষ করে শিল্প খাতে স্বয়ং সম্পূণর্তা অজের্নর প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্প-বাণিজ্য, কল-কারখানা, ব্যবসা, সেবা ইত্যাদি খাতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়া এবং প্রতিযোগিতা ও উন্নত সেবার নামে এসব জনগুরুত্বপূণর্ সেবাগুলোর বাণিজ্যিকীকরণ দরিদ্র জনসাধারণের জীবন ও জীবিকার মূল ভিত্তিকে নষ্ট করে দিয়ে করপোরেট বা আন্তঃরাষ্ট্রীয় পুঁজির কাছে আত্মসমপের্ণর ফলে জনদুভোর্গ ও দারিদ্র্যায়ন প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

আবার সরকারি পযাের্য় সামাজিক নিরাপত্তা কমর্সূচির অপ্রতুলতা এবং দারিদ্র্য বিমোচনের দীঘর্স্থায়ী ও পরিকল্পিত কমর্সূচির অভাব দারিদ্র্যায়ন প্রক্রিয়াকে দ্রæততর করতে ভ‚মিকা রাখছে। এ দেশে অন্তত বলা যায়, এ দারিদ্র্যায়ন ঠেকাতে বিভিন্ন এনজিও দেশের আনাচে-কানাচে পযর্ন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ দিয়ে এনজিওদের অথির্বত্ত বাড়লেও দরিদ্রের হার কমছে না। মনে রাখা প্রয়োজন, এনজিওদের ঘূণার্য়মান তহবিলের মালিকানায় দরিদ্র মানুষের কোনো অংশীদারিত্ব নেই। মজার ব্যাপার হলো দরিদ্র মানুষের সঞ্চয়ের টাকা দিয়েও এনজিওরা দরিদ্র মানুষকে ঋণ দিয়ে ‘সেবা’ করছে। দরিদ্র মানুষের নানাবিধ কারণে টাকার প্রয়োজন যা তাদের কাছে নেই। আর এই ‘প্রয়োজন’ মেটানোর মহান উদ্দেশ্য নিয়ে তারা দরিদ্র মানুষের উন্নতির জন্য ‘পাশে’ দঁাড়িয়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠার আগে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষের শ্রমের বিনিয়োগ ঘটেছিল উৎপাদন ও জীবন অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে। ক্রমেই শিল্পকেন্দ্রিক অথর্নীতির গতিবৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশের শ্রম কাঠামো ও সামাজিক স্তরবিন্যাসে বড় ধরনের পরিবতর্ন নিয়ে আসে যা প্রচলিত শ্রমবিভাজনের ধারাকে বদলে দিয়ে তৈরি করে নতুন মেরুকরণ; নগর হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক অথৈর্নতিক ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আশ্রয়।

আন্তজাির্তক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ১৯৯৩ সালে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে : অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে উৎপাদন প্রক্রিয়া অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে এমনভাবে চলে যেখানে সাংগঠনিক কাঠামোর বাহুল্য নেই বললেই চলে, আর সেই সঙ্গে শ্রম ও পটুজির দ্বৈরথ খুঁজে পাওয়া ভার এবং শ্রমিকের নিয়োগ বহুলাংশে কোনো চুক্তির মাধ্যমে বা আনুষ্ঠানিকভাবে হয় না। বরং ব্যক্তিগত বা পরিবার কিংবা সামাজিক সম্পকর্ বলয়ের ভিত্তিতে এ ধরনের শ্রম ও শ্রমিকের অবস্থান।

পারিবারিক উদ্যোগের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের যে স্থাবর সম্পত্তি তা উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত, কোনো প্রতিষ্ঠানের নয় এখানে যে কোনো ধরনের বিনিয়োগ কিংবা লেনদেন সবই উদ্যোক্তার নামে হয়ে থাকে। কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কিংবা উদ্যোক্তার আয়-ব্যয়ের পৃথকীকরণ দুরূহ ব্যাপার। সুতরাং (জাতিসংঘের জাতীয় আয় নিরুপণের প্রক্রিয়া ব্যবহৃত) কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা আমরা সোজা ভাষায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত বলতে যা বুঝি, খানাভিত্তিক বা কোনো ধরনের নিবন্ধন ছাড়াই খানা দ্বারা পরিচালিত এক বা একাধিক উদ্যোগ; এগুলো স্বনিয়োজিত উদ্যোগ হিসেবে এককভাবে কিংবা যৌথভাবে একই পরিবারের সদস্য কিংবা একাধিক পরিবারের সদস্য দ্বারা পরিচালিত হয়; এ উদ্যোগে নিয়োগ সবসময় খÐকালীন হয়ে থাকে এবং এর শ্রমিক দেশের শ্রম আইনের এবং বিদ্যমান ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা আইনের বাইরে কমর্রত শ্রমজীবী মানুষ।

নারীর অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ খাতের নারী শ্রমিকদের জন্য জেন্ডারবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। স্বনিয়োজিত নারীদের জন্য তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত করা ও কঁাচামাল সংগ্রহের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন যাতে তারা মুক্তবাজার অথর্নীতির এই যুগে ব্যবসা করে টিকে থাকতে পারে। শহরের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারীশ্রমিকের জন্য বিশেষ করে হকারদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বল্পমূল্যে স্থায়ী জায়গা নিদির্ষ্ট করা প্রয়োজন। যাতে তারা অবাধে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। স্বনিয়োজিত নারীদের জন্য স্বল্পকালীন কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন যাতে তারা পুঁজি সংগ্রহের ঝুঁকি ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। তাদের সমবায়ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে যাতে তারা সম্মিলিতভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে।

শ্রমিকদের রেজিস্ট্রেশন ও আইডি কাডের্র আওতায় আনা প্রয়োজন যাতে তারা রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আসতে পারে। তাছাড়া, নারীশ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নিধার্রণ করা এবং নগরকেন্দ্রিক শ্রমিকদের স্বল্প আয়ের বাসস্থান, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব ধরনের নগর সেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক সংগঠিত হয়ে নিজস্ব সংগঠন তৈরি এবং সরকারি ও বেসকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেটওয়াকর্ তৈরি করা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় যেমনÑ স্বাস্থ্যগত ও পেনশন বীমা, দরিদ্রের ব্যাংক চালু করা যেতে পারে। ট্রেড ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের জন্য সুনিদির্ষ্ট এজেন্ডা থাকতে হবে এবং এ খাতের উন্নয়নের জন্য জাতীয় বাজেটে প্রতি বছর বরাদ্দ করা উচিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<7700 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1