বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণ প্রতিরোধ সোচ্চার হতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে

আমাদের এই মুহূর্তে উচিত ধর্ষণ প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়ার। ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা তৈরি করার মাধ্যমে ধর্ষণের সংখ্যা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব। পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। পারিবারিকভাবে জাগরণ সৃষ্টি করা চাই। ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে উসকে বা প্রশ্রয় দেয় এমন সমাজকে ধর্ষণবিরোধী, ধর্ষণ প্রতিরোধী সমাজে রূপান্তর করতে হবে। নারীকে 'মানুষ' হিসেবে ভাবার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুলস্নাহ
  ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিলেন ঢাবির এক ছাত্রী। ভুল করে কুর্মিটোলা হাসপাতাল এলাকায় নেমে পড়েন তিনি। হেঁটে শেওড়াপাড়া যাওয়ার পথে তাকে ফলো করে ধর্ষক। সড়ক থেকে তুলে নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণ করে তাকে। অচেতন হয়ে পড়ে ছাত্রীটি। ঘণ্টা তিনেক বাদে জ্ঞান ফেরে তার। স্থানীয়দের সহায়তায় হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। ফরেনসিক পরীক্ষায় তার ধর্ষণের আলামত মিলেছে। এ ঘটনায় পরদিন শাহবাগ ও ক্যান্টনমেন্ট থানায় দুটি মামলা হয়। এদিকে সহপাঠী ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর প্রকাশের পর রোববার রাত থেকে ধর্ষকের গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছে ঢাবির শিক্ষার্থীরা।

ধর্ষণের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে রাজধানীসহ সারা দেশে। নারী নির্যাতন নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের ৭ শতাংশ নারী জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৮০টি। এর মধ্যে ১৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। আর আত্মহত্যা করেছে ৫ জন। অন্যদিকে শিশু ধর্ষণের হার প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে ৩ গুণ বেশি। জার্মানির মতো উন্নত দেশেও নারীরা যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। জার্মানিতে ধর্ষিত নারীদের মেডিকেল টেস্টের ব্যবস্থা করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন- 'ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন। ভিকটিমরা ধর্ষক সম্পর্কে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে ভয় পান। কুণ্ঠাবোধ করেন। অনেক সময় তারা ধর্ষণের কথাই চেপে যান।'

বেশির ভাগ যৌন অপরাধ ঘটে বাড়িতেই। ভারতের পুলিশের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তাই আদালতের নির্দেশে চালানো এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত আট মাসে ধর্ষণের সংখ্যা ২২৭৮টি। অবাক করা বিষয় হলো- ১৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোক এবং পরিচিতজন। বিচারের ব্যবস্থা থাকার পরও ধর্ষণ নামের এই প্রাচীন অপরাধটি থামানো যাচ্ছে না। ২০১৩ সালে দিলিস্নতে গণধর্ষণের ঘটনার পর ভারতের আইন সংশোধন করে কঠোর করা হলেও পরে ধর্ষণের ঘটনা কমেনি। আর বাংলাদেশের জাতীয় আইনজীবী সমিতির হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু নারীকে সতর্ক থাকতে বললে হবে না, পুরুষকেও 'ধর্ষণ করবে না'-এ বার্তা বারবার দিতে হবে। ধর্ষণ 'প্রাকৃতিক ব্যাপার।' এই ভুল ধারণা ভেঙে একে 'অপরাধ' ও নারীর প্রতি 'সহিংসতা' হিসেবে দেখতে হবে। ধর্ষণ মানে ধর্ষণ, প্রেম-বন্ধুত্বের নামে একে 'বৈধতা' দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। চোখের সামনে ধর্ষণ হচ্ছে, অথচ নির্বিকার, নিষ্ক্রিয় থাকার কাপুরুষতা পরিহার করতে হবে। সামাজিক বা আইনগত হয়রানি, অসম্মানের ভয়ে ধর্ষণের ঘটনা লুকিয়ে রাখা যাবে না।

ধর্ষণ এড়াতে নারীকে আরও সোচ্চার হতে হবে। আত্মরক্ষার কৌশল শেখা, প্রয়োজনে বাইরে বা রাস্তায় হাঁটার সময় নির্জন, পরিত্যক্ত এলাকা এড়িয়ে চলা, সঙ্গে মোবাইল-ফোন রাখা, আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী মনোভাব রাখা জরুরি। ফোনে 'কোড ওয়ার্ড' রাখা, যাতে বিপদের সময় সাংকেতিকভাবে পরিবারের লোকদের জানাতে পারেন। কেউ অনুসরণ করছে মনে করলে পাশের বাড়িতে ঢুকে যাওয়া। যদি একান্তেই আক্রমণের মুখে পড়ে যান, স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিজের অবস্থান পরিষ্কার করুন। এটি ধর্ষণ, স্মরণ করিয়ে দিন। কোনো অজুহাত দাঁড় করানো যেতে পারে (পিরিয়ড চলছে বা যৌনবাহিত রোগ রয়েছে)। অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চিৎকার করা। নখ দিয়ে খামচে ধরা। চুল ধরে হঁ্যাচকা টান দেওয়া। কামড় দেওয়া। লাথি বা ধাক্কা দেওয়া। কোনোভাবে নিজেকে মুক্ত করে দৌড়ে পালানো। সরাসরি পুলিশের কাছে যাওয়া। ব্যক্তিকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে ঠিক, তবে ধর্ষণ প্রতিরোধে মূল দায়িত্ব নিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। আমেরিকায় সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) কেন্দ্রীয়ভাবে 'রেপ প্রিভেনশন অ্যান্ড এডুকেশন' (আরপিই) প্রোগ্রাম চালু করেছে। এ ধরনের প্রোগ্রাম আমাদেরও নিতে হবে। যেখানে পৃথিবীব্যাপী পরীক্ষিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কার্যকর 'প্রতিরোধ' প্রোগ্রামগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইউরোপীয় বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতনবিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে। তা ছাড়া ধর্ষণসংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে পৃথক একটি বিভাগ। যেখানে ২৪ ঘণ্টা টেলিফোন করা যায়। ধর্ষণের শিকার যে কেউ সেখানে যে কোনো সময় সেবা পেতে পারেন। ধর্ষণ প্রতিরোধে আমাদেরও এমন স্বতন্ত্র বিভাগ গড়ে তোলা জরুরি। সর্বোপরি রেপ শিল্ড ল' অনুসরণ করতে হবে। যাতে ভিকটিমকে অনাবশ্যক প্রশ্ন না করা হয়। ব্যক্তিগত বিষয় বেশি প্রকাশ্যে আনা না হয়। তার অতীত যৌনতাকে উদাহরণ হিসেবে টানা না হয়। অধিকতর প্রমাণের বিধান রহিত করতে হবে। মেডিকেল পরীক্ষায় মানসম্মত প্রটোকল মেনে চলতে হবে। অভিজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। সবকিছুর ডকুমেন্ট রাখতে হবে। কোনো চাপ, দুর্নীতির যেন অবকাশ না থাকে, তাই ধর্ষকের পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত রেজিস্ট্রি করে তা সব জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে। ইন্টারনেটে তা প্রাপ্তির সুযোগ থাকতে হবে। কঠোর শাস্তির জন্য আইনি সংস্কার আনতে হবে। এ ছাড়া নূ্যনতম সাজার উলেস্নখ থাকতে হবে। বিচার দ্রম্নত ও শাস্তি দৃশ্যমান করতে হবে।

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান; ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, আল জামিআতুল ইসলামিয়া ইসলামপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84779 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1