শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পর্কের সুতোয় বোনা জীবন

রুমানা নাওয়ার
  ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

এক একটা বাঁধন ছিঁড়ে যায়। সম্পর্কের সুতো আলগা হয়ে যায়। খুব আপন, খুব পরিচিত একটা মুখ চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ তার চোখ-মুখ মুখের বলিরেখা পলক ফেলা নিশ্বাসের প্রতিটি স্পন্দন পা ফেলা হাতের নিষেধ আবদার সব সব কতই না চেনা-জানা পরিচিত। সেই পরম প্রিয় মানুষটাই হঠাৎ করে নাই হয়ে যায় জীবন থেকে। চেনা বলয়ের গন্ডি থেকে। আপনালয় থেকে যোজন যোজন দূরে চলে যায়। চোখের ওপারে। খুঁজলেও দেখা মেলে না একটিবার। শুধু স্বপ্নে আসা-যাওয়া। অনুভবে আসা-যাওয়া। হাজার মাথা কুটেও দেখা মেলে না প্রিয় মুখটি প্রিয় মানুষটি। কি এক মনোকষ্টে দিন কাটে রাত কাটে। যার হারায় সে বোঝে।

এ চলে যাওয়ার মিছিলে কারও প্রিয় বাবা, কারও প্রিয় মা, কারও বোন, কারও ভাই। বেঁচে থাকতে যতটুকু ভালোবাসায় সিক্ত হয় প্রতিটি সম্পর্ক মৃতু্যর পর যেন আরও দ্বিগুণ আকারে বাড়ে এ ভালোবাসা, এ ছায়া, মায়া। প্রগাঢ়ভাবে হাজির হয় অতীত স্মৃতি, টুকরো টুকরো ঘটনা দুর্ঘটনা যাপিতজীবনের ছেঁড়া ছেঁড়া মুহূর্তগুলো। কি এক আকুলতা বুকের ভেতর হাহাকার প্রিয় বাবাটার জন্য। বাবার চওড়া কপাল, নামাজে সেজদা দেওয়া কালো দাগের সে কপাল। চোখ বুজলেই দেখি। ব্যাক ব্রাশ চুলের অভিজাত সে ভাব আর কারও মধ্যে দেখি না তো। দেখি না নির্ভরতার সে বিশাল দুটো হাত। আঁকড়ে ধরে না সন্তানের পড়ে যাওয়া সময়টায়। সকালটা আর বাবার দরাজ গলার কোরআন তেলাওয়াতে শুরু হয় না। ধূমায়িত চায়ের কাপটা নিয়ে মা আর দৌড়ায় না বাবার কাছে। দেরি হয়ে গেলে বাবা যে রাগ করবে। তাই মায়ের পড়িমরি অবস্থা। বাবাকে খাওয়ানোর। ফজরের আজানের সময়কার নূরানি বাতাসটা আর গায়ে লাগায় না বাবা। আগলে রাখা সন্তানদেরও ডেকে তোলে না ঘুম থেকে। পরম নিশ্চিন্তে কবর দেশে ঘুমাচ্ছে নূরানি হাওয়া গায়ে লাগিয়ে খুশবো আতর মেখে। বাবাকে না দেখে থাকা হয় বাঁচা হয় আমার আমাদের। বোনটাকে ভুলে যাই কালের পরিক্রমায়। কিন্তু মা ঠিকই কাঁদে লুকিয়ে চুকিয়ে। চোখের কোণ ভেজা দেখলেই বুঝি।

মাটাকে বাঁচানোর জন্য কোলে করে সিঁড়ি ভেঙে কেমো দিতে যেত যে ছেলেটি সেও এখন মাকে ভুলতে বসেছে। অথচ মা কে সুস্থ করে তুলতে রাতের পর রাত সেবা করেছে। মা যেন ছেড়ে না যায় খোদার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছে। সময়ের ঘেরাটোপে ছেলে বদলেছে। মায়ের দোয়া সঙ্গে নিয়ে ছেলে তরতর করে উপরের সিঁড়িতে পৌঁছলেও আর কালেভদ্রে মায়ের জন্য চোখের জল ফেলে না। সময়ই ভুলিয়ে দেয় মাকে। দায়িত্ববোধ বগলদাবা করে হাঁটতে হয় বলে মাইলের পর মাইল। প্রিয় সম্পর্কগুলো আলগা হয়ে যায়। চাওয়া পাওয়ার খেরোখাতায় লাভ লোকসানের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত প্রায় প্রত্যেকে। ঘর থেকে পর সবাই। না হয় এত মধুর সম্পর্ক কাছের মানুষও কীভাবে পর হয়ে যায়?

মৃতু্যর পর আমরা প্রতিটি সম্পর্কের মূল্য বুঝি, খুঁজি। জীবনজুড়ে কতখানি জায়গা দখল করেছিল টের পাই। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। মন পোড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষটির জন্য। চোখ নোনা জলের বান ডাকে। বুকটা হাহাকার করে প্রতিটা ক্ষণ। কি যেন নেই কি যেন নেই- এ হাহাকার হৃদয়জুড়ে।

যে চলে যায় তাড়াতাড়ি জীবনের পাততাড়ি গুটিয়ে সে হয়তো বেঁচে যায়; কিন্তু যে থেকে যায় তার কি জ্বালা বিরহ একমাত্র সে বোঝে। সে কষ্টের ভাগীদার কেউ হয় না। কাউকে দেয়া যায় না ছিঁটেফোঁটা কষ্ট। আসা-যাওয়ার খেলায় মানবজীবন। কতেকের আগমনী কান্না আর কতেকের বিদায়। মেনে নেয় মানিয়ে নেয় আমি আপনি আমরা সবাই। হয়তো কিছুদিন একটু তাল ছেঁড়া ছন্দপতন হয়। কিন্তু ক্ষণিক পরে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে সবে। বুক জ্বলুনি ভাবটা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। মহান আলস্নাহই ভুলিয়ে দেয়। না হয় স্বাভাবিক জীবনধারণ করতে পারত কি কোনো মানুষ? চলে যাওয়ার মিছিলে বাড়ছে প্রিয় মুখগুলো প্রতিদিন। খুবই আপন খুবই কাছের ঘনিষ্ঠ থেকে শুরু করে অল্প পরিচিত দূরের সম্পর্কের মানুষটার জন্যও মন কাঁদে। ভাই-বোন, মামা-চাচা, বন্ধু-জেঠি গ্রাম মহলস্নার কত লোকই আছে তার মধ্যে। হুটহাট চলে যায় কোনো আপনজন আবার কেউ জানান দিয়ে বিদায় নেয়। সবই কষ্টদায়ক।

অসম বয়সি রিজিয়া বুবু আরেফা বুবু কত আপন ছিল বাড়ির প্রত্যেকের। দুজন নাইওর যেত বাপের বাড়িতে প্রায়ই একই সময়। নাওয়া-খাওয়া-দাওয়া-ঘুমানো-পান খাওয়া সব একসঙ্গে তাদের। মায়ের পেটের বোনও এরকম হয় না। সারারাত গল্পে কাটাতো। নিজের সংসার বউ ছেলেমেয়ের অভাব-অভিযোগ সুখের-দুঃখের গল্প দুজনের। তারা দুজনেই পরপর চলে গেলেন না বলে-কয়ে না ফেরার দেশে। আহারে রিজিয়া আরেফা বুবুরা ভালো থেকো তোমরাও ওপারে। গল্প করো বেহেশতে ও আমাদের সামনের দীঘিটায় ঘাটে বসে। যদি সেখানটায়, থাকে। পানের পিক ঠোঁটে এনে সুখের গল্প করোগো বুবুরা। আমরা এখান থেকে ঠিকই দেখবো।

যে বিছানায় শুয়ে রাত পার করত লোকটা সে বিছানাটা গুমরে কাঁদে মানুষটার জন্য। যে কলতলায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুচি-শুভ্র হতো। সে কলতলা জলের অভাবে শুকিয়ে তৃষ্ণার্ত হয়। যে মসজিদটায় আজানের সঙ্গে যে মানুষটা কাজ ফেলে দৌড়াতো জামাতে সামিল হওয়ার জন্য। সে মুয়াজ্জিন ঘাড় ফিরে বারবার অপেক্ষায় খোঁজে প্রিয় মুসলিস্নকে। যে মেয়ে বাবার দোল খাওয়ার জন্য ইজিচেয়ার নিয়ে আসে সারামাসের সঞ্চয় থেকে। বাবা যে তার এত তাড়াতাড়ি জীবনের পাততাড়ি গুটিয়ে চেয়ারে দোল না খেয়ে চলে যাবে। সে কি জানতো কখনো। অথবা যে ছেলেটি বাবাকে আশ্রয় মনে করে তিনবেলা পেট পুরে খেয়েছে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। সেও মাথায় হাত দিয়ে বজ্রাহতের মতো নির্বাক। যে অর্ধাঙ্গিনীকে চোখের আড়াল হতে দেয়নি বড় কোনো কারণ ছাড়া। সে প্রিয় মানুষটাকে ছেড়ে কীভাবে তিনি ঘুমাবেন। একা শীতল বিছানায়। এত ভালোবাসা এত মায়ায়ও কেন আটকানো গেল না। এ বিলাপে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার আকুতিতে বুকফাটা আর্তনাদ বিধাতার বরাবরে। কেন এমন হয়? প্রিয় মানুষটাকেই যখন লুকিয়ে ফেলা। তবে বুকটায় কেন এত মায়া দিলি। /হৃদয়টা পুড়ে খাক হওয়ার যন্ত্রণা দিলি। /চোখে অশ্রম্নবানের বন্যা দিলি?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84782 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1