ছোটবেলা থেকে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের কথা শুনলেও সামনাসামনি দেখা আজ থেকে ২৪ বছর আগে আমার প্রথম সন্তানের জন্ম। বসবাস সাভার এলাকায়। নবজাতকের জন্মের খবর ওদের কাছে পৌঁছে যায় বিনা তারের টেলিফোনের মতো। কয়েকদিন এদিক-ওদিক ঘুরছে দেখে প্রতিবেশীরা আমায় ভয় দেখায়। বলে, 'ওরা এসে এই করবে ওই করবে।' সত্যিই এলো। আমি ওদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলি, ওরা রৌদ্রকে দেখে। ওরা টাকা ও চাল চায়, আমি দিলেই ওরা গানবাজনা করে চলে যায়। অভ্রের জন্মের সময় ঢাকার তেজগাঁওয়ে বসবাস, ওরা টের পায়নি সাক্ষাৎও হয়নি। তবে প্রায় এলাকায় দেখা হয়। ওদের কয়েকজনের সঙ্গে ভালোই কথা হয়। মাসে একবার সামান্য টাকা দিই। এক মাসে দুবার চাইলে বলি, 'মাস কিন্তু শেষ হয়নি' ওরা চলে যায়। রাস্তায় দেখা হলে খোঁজখবরও নেয়া হয়।
আমরা প্রায়ই বাজার, মার্কেট ও শপিংমলে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের দেখতে পাই। তারা দোকানপাট থেকে টাকা উঠায় এই দিয়ে তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটায়। আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে তৃতীয় লিঙ্গের মধ্যে দুটো ধরন দেখা যেত। কেউ নারীরূপী আর কেউ পুরুষ। বর্তমানে তেমন কোনো পুরুষ হিজড়াদের দেখাই যায় না। সব হিজড়ারাই সাজসজ্জা নারীরূপে চলাফেরা করে। পুরুষ হয়ে জন্মেও পারিপার্শ্বিক মানসিক এবং হরমোনের নানা জটিলতায় কারও শরীরে মিশ্র, অ-কোষের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। মান সক্রিয় নারীস্বত্বা নিয়ে তারা বেঁচে থাকেন এক অমানুষিক যন্ত্রণায়। অন্যদের কাছে নিজেদের আকর্ষণীয় করার লোভ নিয়ে ও দৃষ্টিনন্দন করার জন্য নিজেদের 'নারী' সাব্যস্ত করার জন্য ব্যবহার করেন মেয়েলি সাজসজ্জা। এমনকি গ্রহণ করেন হরমোন ট্যাবলেট। এর ফলে বাহ্যিকভাবে তাদের শারীরিক পরিবর্তন ঘটে।
বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গদের সঠিক সংখ্যা আনা না গেলেও বিভিন্ন সংস্থাগুলোর হিসেবে দেশে ২০ থেকে ২৫ হাজার তৃতীয় লিঙ্গের কথা বলা হয়। তবে বাংলা পিডিয়ার হিসাব অনেক উপরে। তাদের হিসাবে বাংলাদেশে ১ লাখ ৫০ হাজারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের বসবাস। আবার মানবাধিকার সংস্থার এক তথ্য মোতাবেক সারা দেশে ৫০ হাজার তৃতীয় লিঙ্গ রয়েছে। অবশ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তৃতীয় লিঙ্গদের একত্রিত করে আলাদা সমাজ গড়ে জেলার উদ্দেশ্যে দেশে অনেক সংগঠন কাজ করছে।
২০০৫ সালে মাত্র ১০-১২ জন হিজড়াকে নিয়ে ঢাকার শ্যামপুরে গড়ে তোলেন 'সুস্থজীবন' নামে হিজড়া সংগঠন যার নির্বাহী পরিচালক লায়লা হিজড়া, বর্তমানে সেই সংগঠনের সদস্য ১৫০-এর উপরে। এর মধ্যে ঢাকায় তৃতীয় লিঙ্গের সংখ্যা ২৫ হাজারের অধিক। দেশের যে কোনো অঞ্চলে হিজড়া শিশু জন্ম গ্রহণ করছে শুনলে হিজড়া সংগঠনের সদস্যরা সে সব শিশুকে তাদের কাছে নিয়ে আসে। তবে অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা পরিবারের লোকজনই এই শিশুদের তৃতীয় লিঙ্গের সংগঠনে দিয়ে যায়। এসব তৃতীয় লিঙ্গদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন- হিজড়া, চিংড়ি, নপুংশক, ক্লিব, পোতা।
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ওরা দেশের নাগরিক হিসেবে অধিকার পায় না। তৃতীয় লিঙ্গের সবচেয়ে বড় সমস্যা বসবাস ও আবাসনের। দেশের বিভিন্ন স্থানের তৃতীয় লিঙ্গরা প্রায়ই রাজধানীতে এসে চলাফেরা করে। তারা লুকানো জনগোষ্ঠী হলেও তাদের কাজকর্ম সমাজে প্রভাব ফেলে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী আছে ১১ হাজারের মতো। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পাচ্ছে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা বৃত্তি। (প্রাথমিকে জনপ্রতি মাসিক ৭০০, মাধ্যমিকে ৮০০, উচ্চমাধ্যমিকে ১০০০ ও উচ্চতর ১২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে।
জাতীয় সংসদীয় নির্বাচনে সংসদের ৩৫০ আসনের মধ্যে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। ৩০০ আসনে সরাসরি ভোট হলেও সংরক্ষিত আসন বণ্টন হয় ভোটে জয়ী দলগুলোর আসন সংখ্যার অনুপাতে।
৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ অনুষ্ঠিত হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদীয় নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনের প্রতিযোগিতার জন্য তৃতীয় লিঙ্গের আটজন ফরম তুলেছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম থেকে আসা তৃতীয় লিঙ্গের ফাল্গুনী ও অঙ্কিতা জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে প্রতিযোগিতার জন্য ফরম তুলেছেন। ফাল্গুনী বৈষম্য দূরীকরণ ও মাল্টিপারপাস দুটি এনজিও পরিচালনা করেন চট্টগ্রামে। ফরম তুলতে এসে ফাল্গুনী বলেন, 'আমরাও এ দেশের মানুষ, আমাদেরও অধিকার রয়েছে। সংসদে আমাদের ব্যথা-বেদনা, আবেদনগুলো বলার লোক নেই। এজন্য তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি সংসদে পাঠানো দরকার বলে মনে করি। অধিকার আদায়ের জন্য আমরা জাতীয় সংসদে যেতে চাচ্ছি।'
বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গরা নিজেদের যোগ্যতা ঠিক দেখিয়েছে। ওরা সুযোগ পেলে ভিক্ষাবৃত্তি বা অন্যায় পথ থেকে ঠিক সরে আসবে। নিয়ম হয়, কিন্তু বাস্তবায়নের পথ অনেক দূরেই পড়ে থাকে। আশা করি এই দূরত্ব অচিরেই কমে আসবে। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছেন দেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের জনপ্রতিনিধি ৩৭ বছর বয়সি সাদিয়া আখতার পিংকী। ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বড় হন পিংকী। ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছেন। গত ৩ বছর ধরে কোটচাঁদপুর উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পঞ্চম ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কোটচাঁদপুর থেকে ১২ হাজার ৮৮০ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রুবিনা খাতুন পেয়েছেন ১২ হাজার ১৩৯ ভোট। তৃতীয় লিঙ্গ নয় নারী পরিচয়েই থাকতে চান বলে জানিয়েছেন সাদিয়া আখতার পিংকী।
টাকা চেয়ে বা জোর করে আদায় করে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখা যায় তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের। এমনকি চাঁদাবাজি ও যৌনাচার করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ফলে তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের প্রতি সাধারণ মানুষের অবহেলা ও বৈষম্যও লক্ষণীয়। সে সব চিন্তা করে ২০১৩ সালে হিজড়াদের 'তৃতীয় লিঙ্গ' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। শুধু স্বীকৃতি নয়- বাস্তবায়নে নীতি ও আইন প্রণয়ন চায় ওরা। পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যে নেতিবাচক মনোভাব তার পরিবর্তনও চায় ওরা। ক্রমে পরিবর্তন হচ্ছে ওদের কাজের।
সংবিধান অনুযায়ী দেশের সব মানুষ সমান। তবে বাস্তবতা প্রতিবন্ধকতামূলক। ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে তৃতীয় লিঙ্গের সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে ভুল ধারণা, তা দূর করতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গের নিয়ে মানুষের মধ্যে যে মানসিক দৈন্য, তা কমাতে আইন করতে হবে। এই জনগোষ্ঠীর প্রাপ্যতা থেকে তাদের যারা বঞ্চিত করবে, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দলিত, হরিজন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষসহ অনগ্রসর মানুষের বৈষম্য বিলোপে আইন করার অঙ্গীকার করেছে সরকার। এই আইন দ্রম্নত করতে হবে।
লেখক- সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।