শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ভাষা আন্দোলনে নারী

মহল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল অভাবিত। সে সময়ে মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে ছাত্রছাত্রীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নাজুক। তবুও 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে পুরুষের পাশে কীভাবে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নারীরা তার কিছু প্রমাণ ছিল তখনকার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে আর ভাষা সৈনিকদের স্মৃতিচারণের দলিলে ও বইতে।
রহিমা আক্তার মৌ
  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

যে কোনো আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ কতটা ছিল তা বর্তমান সময়ের ছাত্রছাত্রীদের জানা প্রয়োজন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল অভাবিত। সে সময়ে মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে ছাত্রছাত্রীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নাজুক। তবুও 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে পুরুষের পাশে কীভাবে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নারীরা তার কিছু প্রমাণ ছিল তখনকার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে আর ভাষা সৈনিকদের স্মৃতিচারণের দলিলে ও বইতে। এখনকার মতো তখন মেয়েদের লেখাপড়া, চলাফেরা এত সহজ ছিল না। সে সময় সচ্ছলও আধুনিক বাবা-মা তাদের মেধাবী কন্যাকে সমাজের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতেন ঠিকই। পাশাপাশি তাদের পারিবারিক কঠোর অনুশাসন ও মূল্যবোধের ছবক মেনে চলতে হতো।

১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভায় ছাত্রীদের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, 'বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে।'

আন্দোলনের শুরুর দিকে একজন ছাত্রীর মুখে এমন সাহসী উচ্চারণ কর্মীদের মনে উদ্দীপনা জোগাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে ভাষার দাবিতে মিছিলে সামনের কাতারে ছিল নারীরা। সে সময় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, আমানুল হক ও অন্যদের তোলা ছবিই তার প্রমাণপত্র। তবুও ছাত্রীদের গ্রেপ্তার ও তাদের কারাবাসবিষয়ক ঘটনাটি প্রায় নেপথ্যে রয়ে গেছে। ভাষাকে নিয়ে যে আন্দোলন ১৯৪৭ সালে শুরু হয় তার ক্লাইমেক্স ছিল বায়ান্নর একুশে ফেব্রম্নয়ারি। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের অবাধ অংশগ্রহণ এতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল যে সমাজব্যবস্থাও সেখানে ছিল নতজানু। সে সময় ছাত্রীদের বেশ কয়জন প্রতিনিধি ছাত্রদের সর্বদলীয় ভাষা কমিটিতে যোগ দেয়। এই প্রতিনিধিরা কলেজ ও স্কুলের ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করে মিছিলে নিয়ে আসত।

২১ ফেব্রম্নয়ারি পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার মূল কাজটা রওশন আরা বাচ্চুসহ আরও কয়েকজন ছাত্রীর দ্বারাই হয়। কারণ সেদিন তারা ১০ জন করে বের হওয়া প্রথম দুটি দলের অনেকেই গ্রেপ্তার হন। ছাত্ররা ব্যারিকেডের ওপর ও নিচ দিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। পরে তৃতীয় দলে বেরিয়ে ব্যারিকেড ধরে টানাটানির কাজ শুরু করেন ছাত্রীরাই। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী আহত হন। আহতদের চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীরা। আহতদের চিকিৎসা সাহায্যের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েরা চাঁদা তুলে আনে।

ব্যারিকেড ভেঙে বেরিয়ে আসার দলের মধ্যে রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর, বোরখা শামসুন, সুফিয়া ইব্রাহীম, সুরাইয়া ডলি ও সুরাইয়া হাকিম ছিলেন। ছাত্ররা মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে, যার বিয়োগান্তু পরিণতি বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার প্রমুখের সরকারি গুলিতে নিহত হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাতে লুকিয়ে ভাষার দাবির বিভিন্ন স্স্নোগান সংবলিত পোস্টার আঁকত। পুলিশের তাড়া খাওয়া ছাত্রদের নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখত। আন্দোলনের খরচ চালানোর জন্য অন্দরমহলের অনেক গৃহিণী তাদের অলঙ্কার খুলে দেন। ১৯৪৮ সালের কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর 'উর্দু এবং উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্টভাষা' এই ভাষণের পর থেকে ১৯৫২-র ২১ ফেব্রম্নযারি পর্যন্ত। ১৯৫২-র ২১ তারিখ ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও ছাত্রদের শাহাদাতবরণ ইত্যাদি ছিল যুবসমাজের অনন্য চেতনার পরিচায়ক।

ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীদের অনবদ্য ভূমিকা ছিল তা জানা যায় অনেক দলিলের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের কথা, অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে বাংলাভাষার দাবিকে চাঙ্গা করতে গঠিত হয় 'তমুদ্দিন মজলিস'। আবুল কাশেমের স্ত্রী রাহেলা, বোন রহিমা এবং রাহেলার ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া আন্দেলনকারীদের আজিমপুরের বাসায় দীর্ঘদিন রান্না করে খাইয়েছেন। শুধু তাই নয়- বায়ান্নর ২৩ তারিখ রাত ৪টার দিকে আবুল কাশেমের বাসা ঘিরে ফেলে পুলিশ। ভিতরে আবুল কাশেম ও আব্দুল গফুরসহ অন্যরা ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র 'সৈনিক' পত্রিকা প্রকাশের কাজে ব্যস্ত। পুলিশ দরজায় বারবার আঘাত করলে মিসেস রাহেলা কাশেম, ফ্যামিলি বাসায় রাতে পুলিশ প্রবেশের চেষ্টার বিরুদ্ধে পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘ তর্কবিতর্ক জুড়ে দেন। এ সুযোগে আবুল কাশেমসহ অন্যরা পেছনের দেয়াল টপকে পালাতে সক্ষম হন। এরপর পুলিশ ভিতরে ঢুকে কাউকে দেখতে না পেয়ে চলে যায়। ভাষা আন্দোলন শুরুর দিকে অন্দরমহলে নারীর এই অবদান আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলো এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কারণ সেই রাতে আবুল কাশেমসহ অন্যরা গ্রেপ্তার হয়ে গেলে প্রচারপত্র হয়তো থেমে যেত।

শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ায় অনেক নারীকে জেলও খাটতে হয়েছে। কেউ হারিয়েছেন সংসার। কেউ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হয়েছেন বহিষ্কৃত। ঢাকার বাইরে নারীরা ভাষা আন্দোলনে একাত্ম হতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের মমতাজ বেগমের কথা সবার জানা- কারা নির্যাতনের একপর্যায়ে সরকারের চাপে স্বামী তাকে তালাক দেন। মমতাজ বেগমের ছাত্রী ইলা বকশী, বেনু ধর ও শাবানীর মতো কিশোরীকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

ভাষা আন্দোলন মূলত ছিল একটি সার্বজনীন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ফসল, যার ভিত্তি ছিল বাংলাভাষা ও এই ভূখন্ড। এ প্রসঙ্গে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে ঢাকায় পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী দিবসে সভাপতির ভাষণে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুলস্নাহ বলেছিলেন, 'আমরা হিন্দু না মুসলমান না এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য আমরা বাঙালি। এটা কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন, তা মালা-তিলক-টিকি কিংবা লুঙ্গি-টুপি-দাড়িতে ঢাকার জোর নেই।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<89480 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1