বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর বেড়ে ওঠা এবং সামাজিক মনস্তত্ত¡

ফাহিমা খান
  ২৭ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০
সৃষ্টির ধারাবাহিকতাকে ধারণ করে পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখে যে নারী তার সাবির্ক পরিস্থিতি, তার বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া খুবই ভয়াবহ ছবি : ইন্টারনেট

পুরুষপ্রধান এ সমাজে কন্যাশিশুর জন্ম প্রায় অনাকাক্সিক্ষত। কন্যাশিশুর এ অবস্থার পেছনে কাজ করে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক মনস্তত্ত¡। পরিবার ও সমাজে এমন একটা বোধ গড়ে উঠেছে যেÑ ১. কন্যাশিশুরা পরিবারের প্রধান উপাজর্নকারী নয়; ২. প্রধান অথর্ উপাজর্নকারী নয় বলেই তার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি বিষয়ে ব্যয় করা অযৌক্তিক; ৩. কন্যাশিশু মানেই বোঝা, কারণ তার বিয়ের সময় বিপুল ব্যয়; ৪. ভবিষ্যতে ছেলেশিশুরাই পিতামাতার ভরণ-পোষণ করে; ৫. কন্যাশিশুদের মেধা কম।

সামাজিক মনস্তত্ত¡ হচ্ছে জনমনে প্রতিদিন উদিত তাৎক্ষণিক ধ্যান-ধারণা, মতামত, আবেগ ও খেয়াল যার মধ্যদিয়ে প্রতিফলিত হয় সমাজে জনগণের অবস্থান এবং যা তাদের সামাজিক ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনে চালিত করে। শ্রেণিবিভক্ত শোষণমূলক প্রতিটি সমাজে প্রতিটি শ্রেণি, গোষ্ঠী বা স্তরের একটি নিদির্ষ্ট অবস্থান ও নিদির্ষ্ট স্বাথর্ থাকে, পাশাপাশি থাকে ধ্যান-ধারণা, মতামত ও ভাবাবেগ। এগুলোই তার সামাজিক মনস্তত্ত¡। পুঁজিবাদী সমাজে মালিক আর শ্রমজীবীর মনস্তত্ত¡ এক নয়, এক নয় পুরুষ ও নারীর মনস্তত্ত¡।

সভ্যতার শুরু থেকেই নারী এক অবহেলিত প্রাণী হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। এ কারণেই অনেকে বলে থাকেন পৃথিবী যখন অসভ্য ছিল নারীর তখন সুখ ছিল, ক্ষমতা ছিল, পরিচয় ছিল। সে-ই ছিল পরিবার ও সমাজের মধ্যমণি। যখন থেকে সভ্যতার শুরু হলো নারী তখন থেকেই ধীরে ধীরে নিক্ষিপ্ত হলো পরিবার ও সমাজের অঁাস্তাকুড়ে।

আজ যে কন্যাশিশু আগামীকাল তাকেই নানা সামাজিক প্রথার ও দৃষ্টিভঙ্গির বন্ধনে জড়িয়ে নারী হিসেবে সমাজে উপস্থাপন করা হয়। এসব প্রথা ও দৃষ্টিভঙ্গি আবহমান কাল থেকে আমাদের সমাজ ধারণ করে আসছে, লালন-পালন করে আসছে। সমাজের এসব প্রথা কন্যাশিশুকে শুধু অবদমিতই করে না, তাকে পারিবারিক, মানসিক এবং শারীরিকভাবেও দুবর্ল করে তোলে। যুগ যুগ ধরে এর খেসারত দিতে হচ্ছে নারীকেই। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ধমর্ভীরু। ধমর্ মানুষের অন্তরের বিশ্বাস। এখানে যুক্তি অথর্হীন।

ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের প্রাথমিক পযাের্য়ই নারী-পুরুষের সম্পকের্র মধ্যে পরিবতর্ন ঘটে। সম্পত্তিতে অধিকার না থাকার ফলে নারী এখনো পরজীবী হিসেবে সমাজে পরিচিত। শুধু তা-ই নয় এখনো অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা বস্তু বা পণ্য হিসেবে বিবেচিত। সুতরাং তার সত্তা, মেধা বা মননকে নয় বরং দৈহিক রূপকেই বড় করে দেখা হয়। শরৎচন্দ্র তার ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে লিখেছেনÑ ‘কি পরিমাণে তিনি সেবা পান না, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখে-কষ্টে । অথার্ৎ তাহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কি পরিমাণে তিনি রূপসী অথার্ৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তি কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন।’

সিমঁ দ্য ব্যুভুয়া তার ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’-তে দেখিয়েছেনÑ ‘বুজোর্য়ারা সেই পুরনো নীতিবোধকেই অঁাকড়ে ধরে থাকে যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি পারিবারিক সংবদ্ধতার নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে নারীর তেমন কোনো অধিকার নেই।’ আমাদের দেশের সব আইন পরিচালিত হয় সংবিধান অনুযায়ী, কিন্তু সম্পত্তিতে অধিকারের আইনের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় ধমীর্য় প্রথা। এ দেশের সমাজব্যবস্থায় মনে করা হয় বিয়েই হচ্ছে সম্পদহীন কন্যাসন্তানের চ‚ড়ান্ত গন্তব্য। ধমীর্য় বিধানও তাই বলে। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে একজন নারীর শুধু ঠিকানাই বদলায় না, তার পরিচয়ও বদলে যায়; অধিকাংশ ক্ষেত্রে নামটা পযর্ন্ত। আর এই বদলের মধ্য দিয়েই আমৃত্যু নারীকে বরণ করতে হয় পরিচয় সংকট। পাশাপাশি পুরুষকে কিছুই বদলাতে হয় না।

সম্পত্তির উত্তরাধিকার যেহেতু প্রজন্মের পর প্রজন্ম পুরুষ সন্তানের মাধ্যমে নিশ্চিত করার দরকার হয় সে কারণে কন্যাসন্তানের জন্মকে সামাজিক মনস্তত্ত¡ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না, তাকে স্বাগত জানাতে পারে না। আমাদের দেশের পরিবারগুলোয় এ অবস্থা অনেকটা মনোসামাজিক বিকারের পযাের্য় অবস্থান করছে।

অন্যদিকে আজকের যুগে এসেও নারীর মুখ কালো হয়ে যায় তখন তারা জানতে পারে তার গভের্ বেড়ে উঠছে কন্যাশিশুসন্তান। কারণ এখনো ঘরের পুরুষটিকে তারা সুখী করতে চায়, ঘরের পুরুষের কালো মুখ দেখতে তারা ভয় পায়। আত্মপরিচয়ের সংকটে থাকা নারীর মনস্তত্ত¡ গড়ে ওঠে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাবে। পুরুষের অত্যাচারে, নারী-পুুরুষের সব কাজে ‘হ্যঁা’ বলতে শিখেছিল কোনো বিবেচনা ছাড়াই। সে বুঝেছিল পুরুষের সব কাজে ‘হ্যঁা’ না বললে এ সমাজে বা পরিবারে তার অস্তিত্ব থাকবে না। হাজার বছর ধরে চচির্ত এ ব্যবস্থার ফলে নারীর মনোবিকাশ ভেঁাতা হয়ে পড়েছে। কোনো আত্মবিশ্লেষণ ছাড়াই নারী বিশ্বাস করে পুরুষের তুলনায় তার যোগ্যতার অভাব, বুদ্ধির ঘাটতি, কমর্দক্ষতার অভাব রয়েছে। এর ফলে নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ থেকেই মনে হয় পরিবারে পুরুষ হলো বুজোর্য়া আর নারী হচ্ছে সবর্হারা। নারীর সঙ্গে পুরুষের সম্পকর্ আসলে অধীনতার সম্পকর্।

সৃষ্টির ধারাবাহিকতাকে ধারণ করে পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখে যে নারী তার সাবির্ক পরিস্থিতি, তার বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া খুবই ভয়াবহ। এই চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় কেবল নারীর মনোবিকাশ নয়, পুরো সভ্যতার বিকাশই থমকে যেতে বাধ্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু নারী-পুরুষের সৃষ্টিশীলতায় যে সভ্যতা আজ গড়ে উঠেছে তাকে অথর্বহ করতে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। এই প্রয়াসকে এগিয়ে নিতে হলে প্রথমেই লিঙ্গ বৈষম্যকে দূরে ঠেলে দিয়ে সব শিশুর সমবিকাশের অধিকার নিশ্চিত করাই আমাদের কতর্ব্য হওয়া উচিত। এ কাজ কোনো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগে সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন গতানুগতিকতার বাইরে এসে সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি ঢেলে সাজানো, প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রচলিত সংস্কৃতির বাইরে সমঅধিকারের চচার্য় বাধ্য করানো। সবোর্পরি সমাজ ও পরিবারের মনোজগতের পরিবতের্নর জন্য দেশব্যাপী একটি ব্যাপক ধারাবাহিক কমর্সূচি গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<9280 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1