শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
ঘুরে আসুন

পুঠিয়ার রাজবাড়ী

আন্নিকা হুসাইন
  ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

বাড়ি বরিশালে হওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পদচারণ কমই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির দিনগুলো নিমিষেই শেষ হয়ে যায় আপনজনদের পাশে কাটিয়ে। তাই ইচ্ছা থাকলেও আর যাওয়া হয়ে ওঠে না উত্তরে। তবে বেশি দিন ধৈযর্ ধরতে পারিনি। তিন বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে ছুটলাম বরেন্দ্রের পথে। আগে থেকেই সব ঠিকঠাক ছিলÑ কোথায় থাকব। পরিকল্পনা মোতাবেক সবাই সম্মত হলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আপুর রুমে উঠব। যেই ভাবনা সেই কাজ। খুব সকালে রওনা হলাম কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে। আগে থেকে কোনো টিকিট করা ছিল না, তবে পেতে সমস্যা হয়নি মোটেও। সকাল ৭টা নাগাদ আমাদের নিয়ে ন্যাশনাল ট্রাভেলসের গাড়ি ছুটল রাজশাহীর পথে। অনেক হইহুল্লোড়ের পর দুপুর ১টায় পৌঁছলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে। রাজশাহী শহর থেকে পুঠিয়া খানিকটা দূরে হওয়ায় সেদিন আর যাওয়া হলো না। তাই শহরেই অবস্থিত বরেন্দ্র জাদুঘর দেখলাম খুব আগ্রহ ভরে।

পরদিন সকালবেলা আপুসহ রওনা হলাম পুঠিয়ার উদ্দেশে। রাজশাহীর অন্যতম উপজেলা পুঠিয়া। রাজশাহী শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার আগে এবং রাজশাহী-নাটোর মহসড়ক থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত পুঠিয়া রাজবাড়ী। প্রায় আধ ঘণ্টা পরেই পৌঁছে যাই পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে ভ্যানযোগে রাজবাড়ী।

প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে পুঠিয়ার রাজবংশ বৃহত্তর রাজশাহী জেলার জমিদার বংশগুলোর মধ্যে তৃতীয়। দুবলহাটি (বতর্মানে নওগঁা জেলা) ও তাহিরপুরের রাজবংশের পরেই পুঠিয়ার অবস্থান। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আর ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, পুঠিয়ার জমিদারি মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫) প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভ্যান থেকে নেমে প্রথমেই চোখে পড়ে রাজবাড়ীর বড় একটি অংশ। জানা যায় ১৯৭৩ সাল থেকে এ বড় বাড়িটি লস্করপুর মহাবিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহার করত। প্রায় বছর খানেক আগে কলেজ কতৃর্পক্ষের কাছ থেকে প্রতœতত্ত¡বিভাগ এ রাজবাড়ীটির দখল নেয়। এ বাড়ির আঙিনায় ১০টি অপূবর্ কারুকাযর্খচিত মন্দির রয়েছে। এগুলো হলো দোলমন্দির, রথমন্দির, ছোট ও বড় শিবমন্দির, কালীমন্দির, গোপাল মন্দির, ছোট ও বড় গোবিন্দ মন্দির, ছোট ও বড় আহ্নিক মন্দির।

রাজবাড়ীর চারপাশ ঘিরে নিরাপত্তাচৌকি খনন (দীঘির মতো) করা আছে। এই দীঘির আয়তন প্রায় ৩০ একর। এ ছাড়া আছে ছয় একর আয়তনের একটি শ্যাম সাগর। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি তিন শতাধিক পযর্টক এখানে আসেন। কিন্তু অযতœ-অবহেলায় ও সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই অমূল্য প্রতœসম্পদ এমনটাই বলছিলেন স্থানীয় লোকজন।

এখানে পুকুরপাড়ে প্রথমেই আছে বিশাল আকারের শিবমন্দির। পুঠিয়ার রানী ভুবনমোহিনী দেবী ১৮২৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। চারদিকে ৬৫ ফুট দীঘর্ শিবমন্দিরটি একটি উঁচু ভিতের ওপরে নিমির্ত। এর চার কোণায় চারটি ও কেন্দ্রে একটি রতœ আছে।

মন্দিরের দোতলায় একটি মাত্র কক্ষ, যার চারপাশে দুই স্তরের বারান্দা বিদ্যমান। মূল কক্ষের ভেতরে আছে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। পুরো মন্দিরের দেয়ালে পৌরাণিক কাহিনীচিত্র খচিত। এশিয়ার অন্যতম বড় শিবমন্দির বলা হয় পুঠিয়ার এ মন্দিরকে। এর লাগোয়া পূবর্ পাশে গোল গম্বুজ আকৃতির আরেকটি ছোট মন্দির আছে।

শিবমন্দির ছাড়িয়ে একটু দক্ষিণে গেলেই চোখে পড়বে চারতলাবিশিষ্ট দোলমন্দির। চতুথর্ তলার ওপরে আছে গম্বুজাকৃতির চ‚ড়া। প্রতি তলার চারপাশে আছে টানা বারান্দা। এটি আনুমানিক ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে নিমার্ণ করেন পুঠিয়ার আরেক রানী হেমন্ত কুমারী দেবী।

দোলমঞ্চের সামনের মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে মুখোমুখি দঁাড়িয়ে বিশাল প্রাসাদটিই পুঠিয়া রাজবাড়ী। রানী হেমন্তকুমারী দেবী তার শাশুড়ি মহারানী শরৎসুন্দরী দেবীর সম্মানাথের্ ১৮৯৫ সালে নিমার্ণ করেন এ রাজবাড়ী। ভবনের পূবর্ পাশে আছে রানীপুকুর। রাজবাড়ীর নারীদের গোসলের জন্য রানীপুকুরে আছে দেয়ালঘেরা শান বঁাধানো ঘাট।

রাজবাড়ীর প্রাচীরের ভেতরে পোড়ামাটির অলঙ্করণে ঢাকা গোবিন্দ মন্দির। বগার্কারে নিমির্ত এ মন্দিরের প্রতিটি পাশের দৈঘর্্য ১৪ দশমিক ৬ মিটার। কেন্দ্রীয় কক্ষ ছাড়াও মন্দিরের চারপাশে বাগার্কার চারটি কক্ষ আছে।

মন্দিরটি আড়াইশ বছরের পুরনো বলে প্রচলিত থাকলেও এর গায়ে চিত্রফলক দেখে ধারণা করা হয়, এটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিমির্ত। মন্দিরের দক্ষিণ পাশে প্রাচীরের বাইরে অলঙ্করণসমৃদ্ধ ছোট আরেকটি মন্দির রয়েছে।

রাজবাড়ীর পশ্চিম পাশে রয়েছে একটি দীঘি। তার পশ্চিম তীরেই রয়েছে পূবর্মুখী বড় আহ্নিক মন্দির। কারুকাযর্ মÐিত এ মন্দিরের নিমার্ণশৈলী বেশ আকষর্ণীয়। বড় আহ্নিক মন্দিরের পাশে দক্ষিণমুখী অবস্থানে আছে গোপাল মন্দির।

বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্য রাজবাড়ীগুলোর চেয়ে মোটামুটি সুরক্ষিত এবং নজরকাড়া স্থাপত্যে সজ্জিত পুঠিয়া রাজবাড়ী। পূণর্ অবয়বে বিদ্যমান এত মন্দিরের সমারোহ বাংলাদেশের অন্য কোনো রাজবাড়ীতে পরিলক্ষিত হয় না। ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে নিমির্ত এসব নান্দনিক স্থাপত্যের সৌন্দযর্ অবলোকনে প্রতিদিনই পুঠিয়ায় প্রতœপিপাসু, দেশি-বিদেশি পযর্টক ও সাধারণ দশর্নাথীের্দর সমাগম ঘটে। বাংলাদেশের পযর্টন শিল্প বিকাশে পুঠিয়ার রাজবাড়ী বড় সম্ভাবনাই বটে।

রাজবাড়ী ভ্রমণ শেষে ফিরে এলাম আগের পথেই। এর মধ্যেই কখন যে দুপুর গড়িয়ে বেলা হয়েছে, টেরই পাইনি। এদিকে ক্ষুধায় পড়িমরি অবস্থা।

কেউ চাইলে, রাজশাহীতে বিরতি না দিয়ে সরাসরিও যেতে পারেন পুঠিয়ার রাজবাড়ী। এ ক্ষেত্রে বাস দিয়ে যেদিক থেকেই আসুন না কেন, নেমে যেতে হবে পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ডে। এখান থেকে রিকশা বা পা ঝুলানো ভ্যানে চড়লে অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন রাজবাড়ী।

আবাসিক ব্যবস্থা : রাতে থাকার জন্য কোনো আত্মীয়ের বাড়ি না পেলে রাজশাহী শহরে যেতে হবে ভালো মানের হোটেলের জন্য। এখানে হোটেল নূর ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল নাইস, হোটেল প্যারডাইস, আল-দ্বীন ইত্যাদি হোটেল মিলবে। প্রতি ২৪ ঘণ্টার জন্য ভাড়া পড়বে ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পযর্ন্ত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<11373 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1